সঙ্ঘ-বিজেপির এনআরসি অভিযানের বিরুদ্ধে যখন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ দানা বাঁধছে তখন সেই ঐক্যকে ভাঙতে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করে। এই আইনের মাধ্যমে একদিকে হিন্দু সমাজকে আশ্বস্ত করা ও অন্যদিকে মুসলমান সম্প্রদায়কে একঘরে করা বিজেপির উদ্দেশ্য। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইনটি পাশ করে নেয় বিজেপি। এক দিন পেরোতে না পেরোতেই রাষ্ট্রপতিও এই হিন্দুরাষ্ট্রবাদী আইনটিকে অনুমোদন দিয়ে দেয়। কিন্তু রাস্তায় শুরু হয় প্রবল প্রত্যাখ্যান। জামিয়া মিলিয়া ইস্লামিয়ার ছাত্রীদের দৃঢ়তা আবার দেশব্যাপী সংহতি ও প্রতিরোধের সূত্রপাত ঘটায়।
নতুন এই নাগরিকত্ব আইন সবচেয়ে প্রত্যক্ষ আঘাত হেনেছে ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ও ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির মনে। সঙ্ঘ-বিজেপির একের পর এক হামলায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষেরা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। বামপন্থী দলগুলি দেশব্যাপী প্রতিরোধের ডাক দেয়। সাধারণ মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে পথে নামতে শুরু করেন। এরাজ্যে ন্যাশনাল হাইওয়ে, রেইল, টোল প্লাজা অবরোধ শুরু হয়। রাস্তায়, রেল লাইনে আগুন জ্বালিয়ে মানুষের ক্ষোভ নিজেকে দৃশ্যমান করতে চায়। সঙ্ঘ-বিজেপি এই প্রতিরোধকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও স্বতস্ফুর্ত বিক্ষোভের মাঝে নিজেরাই ছদ্মবেশে সরাসরি ঢুকে পড়ে ধ্বংসাত্মক ও বিভেদমূলক দৃশ্য তৈরি করার চেষ্টা করে। বিজেপির আইটি সেল ও তার দোসর মিডিয়া ট্রেনে আগুন লাগার পুরনো দৃশ্য ও অন্য ঘটনার রক্তাক্ত মহিলার দৃশ্য তুলে ধরে “প্রতিবাদের নামে মুসলমানদের সন্ত্রাস” হিসেবে প্রচার করতে থাকে। কয়েকটি জায়গার ভাঙচুরের ঘটনাকে হাতিয়ার করে, প্যানিক গুজব ও ঘৃণা ছড়াতে, সারা রাজ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় রেল দপ্তরের নির্দেশে। এবং এই পরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্ব হিসেবে দেশের প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন: “পোষাক দেখেই চেনা যায় কারা এসব করছে”। দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে এরকম ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক উক্তি দেখিয়ে দেয় যে বিভাজন ছড়াতে কতটা মরিয়া সঙ্ঘ পরিবার।
কিন্তু এযাত্রা বোধহয় সফল হচ্ছে না ওরা। এনআরসির বিরোধিতায় যে সম্প্রদায় নির্বিশেষে ঐক্য গড়ে উঠছিল তা নতুন নাগরিক আইন দিয়ে ভাঙা যাচ্ছে না। বরং এই আইনের বিরুদ্ধে গভীরতর ঐক্য গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষত দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইস্লামিয়াতে ১৫ নভেম্বরের ঘটনার পর ছবিটা দ্রুত বদলে যেতে থাকে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী সংসদে আসার দিন থেকেই জামিয়া-তে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ ও দৃঢ়। প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন ছাত্রছাত্রী ক্লাস বয়কট, পরীক্ষা বয়কটে সামিল হচ্ছিল। জামিয়া ভার্সিটির এই ক্রমবর্ধমান ঐক্য বিজেপির পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে “ইস্লামিয়া” শব্দটি থাকার কারণে দূরের মানুষ হয়তো একে কেবল ইসলাম ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে তো তা নয়, সব ধর্মের ছাত্রছাত্রীরাই পড়েন এখানে। “আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি” সম্পর্কেও এরকম ভ্রান্ত ধারণা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। যাই হোক, জামিয়ার দৃঢ়বদ্ধ প্রতিবাদ অন্যত্রও ছড়াতে শুরু করে। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরাও নয়া আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। এই রকম পরিস্থিতিতে ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশ জামিয়া ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। তাণ্ডব চালায়। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, কাঁদানে গ্যাস, লাঠি, গুলি এমনকি ছাত্রীদের যৌন হেনস্থা করার ঘটনা সামনে আসে।
সন্ধ্যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় জামিয়া ভার্সিটিতে নির্মম পুলিশী হামলার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের দৃঢ় প্রতিরোধ দেশজুড়ে যুবসমাজকে জাগিয়ে তোলে। শীতের রাতে ভারতের প্রায় সবকটি ভার্সিটি ক্যাম্পাসের হাজার হাজার ছাত্রী ও ছাত্র জামিয়ার সমর্থনে, সঙ্ঘ-বিজেপির এজেন্ডার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে রাস্তায় নেমে পড়ে। কলকাতায় যাদবপুর ও আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাতভর মশাল মিছিল, মিছিল ও মানববন্ধন গড়ে তোলে। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় বেরোতে চাইলে সেখানে পুলিশ হামলা চালায়। দিল্লিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার ঘেরাও করে আটক ছাত্রছাত্রীদের মুক্ত করে জেএনইউ-ডিইউ-এর ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকারা। দিল্লিবাসী বহু সাধারণ মানুষ রাতের বেলাতেই জামিয়ার গেটে হাজির হয়ে ছাত্রছাত্রীদের সমর্থন জানায়। পরবর্তী দু দিনের মধ্যে ভারতের আইআইটিগুলি, ফিল্ম ইনস্টিটিউট, মেডিক্যাল কলেজ সহ বহু বিশ্ববিদ্যালয় পথে নামে। ইউরোপ আমেরিকার ২০টির বেশি ভার্সিটি জামিয়ার পাশে, সিএএ-র বিরুদ্ধে কর্মসূচী নেয়। শিল্পী সাহিত্যিক অভিনেতাদের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত প্রতিবাদের ঢল নামে।
নাগরিকত্ব আইনে বিজেপি যে সংশোধনী এনেছে তা গোটা দুনিয়া জুড়ে ধিক্কৃত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ এই আইনকে “বৈষম্যমূলক” আখ্যা দিয়ে ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার। অনেকেই এই আইনকে “গণহত্যার প্রস্তুতি” বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু সংগঠনগুলি ভারতের এই আইনের নিন্দা জানিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই আইন নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং নাগরিকদের ধর্মীয় লাইনে বিভাজিত করার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ঐক্য গড়ে তুলেই ভারতের নাগরিকেরা এই বিভেদকামী এজেন্ডাকে প্রতিহত করবে। জামিয়া থেকে যে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের বার্তা দেশের তরুণ প্রজন্ম জাগিয়ে তুলেছে তাকে গ্রামগঞ্জে কৃষক-শ্রমিকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াই কমিউনিস্ট কর্মীদের আশু কর্তব্য। একমাত্র তবেই সঙ্ঘ-বিজেপির ফ্যাসিবাদী এজেন্ডাকে নির্ধারকভাবে পরাজিত করা সম্ভব।