তোমাদের আছে সংসদ, আমাদের আছে রাজপথ. সংখ্যাগরিষ্ঠতার চোখ রাঙানি দিয়ে ঝড়ের বেগে তুমি পাশ করাতে পারো একের পর এক কানুন , আর আমরা, অগণিত জনতা, গণ বিস্ফোরণের প্লাবন তুলে ঐ সমস্ত কালা কানুনকে পরিণত করতে পারি ছেঁড়া কাগজে। বি--পু--ল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে তুমি ধরাকে সরা জ্ঞান করে ভেবেছিলে তোমার যাবতীয় পদক্ষেপকে ভারতের আপামর জনতা ঢালাও লাইসেন্স দিয়েছে।
কি রসিক ভারতের বহতা রাজনীতি!
ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে কল্পনাতীত সাফল্য নিয়ে মাত্র ছ’ মাস আগে ৩০৩ টি আসন নিয়ে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় আসে। ৩০৩ বা শব্দে উচ্চারণ করলে থ্রী নট থ্রী! পুলিশের বন্দুক থেকে যে থ্রী নট থ্রী বুলেট বের হয়। যে বুলেট দিন কয়েক আগে শুধুমাত্র যোগীর রাজ্যে কেড়ে নিল তরতাজা কুড়িটা প্রাণ। আর আজ, সেই মোদীর শাসনের বিরুদ্ধে দেশজোড়া মহাপ্লাবন। আরও একটি রাজ্য, ঝাড়খন্ড বিজেপির হাতছাড়া হল। নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপিকে দুরমুশ করে।
এরকম এক পরিস্থিতিতে আগামী ৮ জানুয়ারী সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘট হতে চলেছে। বিজেপি পরিচালিত বিএমএস এবং তৃণমূল পরিচালিত আইএনটিটিইউসি বাদে দশটি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ফেডারেশন সমূহের ডাকে এই ধর্মঘট। এই ধর্মঘট শ্রম আইনকে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ঢালাও বিলগ্নিকরণ-বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, মাসিক ন্যূনতম মজুরি ২১ হাজার টাকা ও মাসিক ১০,০০০ টাকা পেনশনের দাবিতে, সমকাজে সমমজুরি, কর্মসংস্থান, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে লাগাম টানা, এবং সর্বোপরি ক্যাব-এনআরসি-এনপিআর বাতিল করা প্রভৃতি দাবিতে সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে এই ধর্মঘটের পক্ষে সামিল করাতে হবে। ইতিমধ্যে কৃষক সংগঠনগুলো ৮ জানুয়ারী সারা ভারত গ্রামীণ বনধের ডাক দিয়েছে। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ওই দিন সারা ভারত ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান রেখেছে।
কর্পোরেটদের কাছে গোটা দেশকে তুলে দিতে, মুনাফা লোটার পথে বিন্দুমাত্র প্রতিবন্ধকতাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ৪৪টি কেন্দ্রীয় শ্রম কানুনকে মাত্র ৪টি শ্রম কোডে নিয়ে আসা হল। স্থায়ী কাজ, স্থায়ী শ্রমিকের এযাবৎ সমস্ত ধারণাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আনা হল একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য শ্রমিকদের নতুন এক বর্গ — ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট। নির্দিষ্ট এক সময়সীমা পর্যন্ত এরা কাজ করবে, তারপর অবাধে এদের ছাঁটাই করার পূর্ণ অধিকার থাকবে নিয়োগকর্তার। নতুন আইনের পরিভাষায় এটাকে ছাঁটাই হিসাবে গণ্য করা হবে না। নিয়োগ কর, ছাঁটাই কর, কর্পোরেটদের এই আব্দারকে মান্যতা দেওয়া হল এই শ্রম কোডে। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের উপর চালানো হল স্টিমরোলার। ধর্মঘটের অধিকারকে কেড়ে নেওয়া হল। মজুরি নির্দ্ধারণের ক্ষেত্রে দরকষাকষির এতদিনের অধিকার এবার আর থাকবে না। শ্রম বিরোধ নিরসনের পরিসরগুলোকে মারাত্বকভাবে সংকুচিত করে আমলাদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হল। সামাজিক সুরক্ষার উপর আঘাত হানল নতুন এই শ্রম কোড। সম কাজে সম মজুরির যে গুরুত্বপূর্ণ রায় সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় দিয়েছিল, তাও খিড়কি দরজা দিয়ে ফেলে দেওয়া হল আবর্জনার স্তুপে।
ঢালাও বেসরকারিকরণ-বিলগ্নীকরণ করে জাতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদকে আজ পুরোপুরি ধ্বংস করে দিল মোদী সরকার। রেলকে বেচে দেওয়ার তাগিদে গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনগুলোকে একে একে তুলে দেওয়া হচ্ছে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর হাতে। এমনকি, লোকাল ট্রেনগুলোকেও হস্তান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে তেজস এক্সপ্রেসকে বেসরকারি সংস্থার কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। বাদ নেই প্রতিরক্ষার মতো শিল্প। যার উপর নির্ভর করছে দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব। লক্ষ লক্ষ স্কীম কর্মীদের ‘ শ্রমিক ‘ হিসাবেই স্বীকৃতি দিল না এই ফ্যাসিস্ট সরকার। না আছে তাঁদের ন্যুনতম মজুরি, না সামাজিক সুরক্ষা। বিপরীতে, মিড-ডে-মিল ব্যবস্থাকেই এনজিও-দের হাতে তুলে দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে এই সরকার।
এ বছর আইএলও একশ বছরে পা দিল। আইএলও তার শতবর্ষে যে মূল থিম বা ফোকাসটা রেখেছে তা হল ‘লেবার গ্যারান্টিস্। তার স্বাক্ষরকারী সমস্ত দেশগুলোর কাছে আইএলও তুলে ধরেছে দুনিয়া জুড়ে প্রবলভাবে বেড়ে চলা অশ্লীল আর্থিক বৈষম্য কমাতে সর্বস্তরের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার ও দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ানো, শোভন কাজ, মজবুত সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা, মজুরীর ক্ষেত্রে জেন্ডার গ্যাপকে কমানো ( দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এ প্রশ্নে ভারতের রেকর্ড সবচেয়ে খারাপ)। কিন্তু, এই সমস্ত প্রশ্নে মোদীর ভারত একদম পেছন দিকে হাঁটছে। মজুরি-ট্রেড ইউনিয়নের পাশাপাশি কাজের স্থায়িত্বের অধিকারকে হরণ করেই এই সরকার ক্ষান্ত নয়। এবার সে গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের নাগরিকত্বের অধিকারকেও ছিনিয়ে নিতে নামিয়ে আনছে এনআরসি, এনপিআর, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। ভারতের সংবিধান আজ বিরাট হামলার মুখে দাঁড়িয়ে। আর, তার বিরুদ্ধেই আসমুদ্রহিমাচল সর্বস্তরের মানুষ, নানান ধর্মের-বর্ণের-স্তরের-সম্প্রদায়ের মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। এই চলমান লড়াই, এই গণউত্থানকে নতুন এক রাজনৈতিক মাত্রা দিতে আগামী ৮ জানুয়ারীর সাধারণ ধর্মঘটকে আমাদের সর্বাত্মকভাবে সফল করে তোলার জন্য কোমর বেঁধে নামতে হবে।
ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসকে ভেঁঙে, তিমিরবিনাশী নতুন এক জাগরণের যে উল্লসিত উদযাপনের শুরু হয়েছে আদিগন্ত জুড়ে, তাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে নতুন বছরে, আর ৮ তারিখের সর্বাত্মক ধর্মঘটকে সফল করাটাই হবে তার প্রথম ধাপ।