জেএনইউর ছাত্র-ছাত্রীদের সুদৃঢ় সংগ্রাম শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটিকে রাজনৈতিক বৃত্তের কেন্দ্রে এনে ফেলেছে।
ভারতে উন্নত মানের যে ক’টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করার সুযোগ আছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মধ্যে অন্যতম। গরিব ও প্রান্তিক অবস্থা থেকে উঠে এসে চমৎকার আধুনিক ব্যবস্থায় অধ্যয়ন ও গবেষণায় অংশ নিতে পারার মতো প্রতিষ্ঠান দেশে অল্প কয়েকটিই আছে। এখন মোদি সরকার নিয়োজিত উপাচার্য মহাশয় গরিব ছেলে-মেয়েদের জন্য জেএনইউ-র দরজা বন্ধ করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। বলাই বাহুল্য, হাতিয়ার-ফি বৃদ্ধি। ব্যাপক ফি বৃদ্ধি। হষ্টেলের সিট রেন্ট অনেক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া, হস্টেলের জল, ইলেক্ট্রিক সহ সবকিছুর জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর উচ্চ হারে পরিষেবা মূল্য ধার্য করা।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির নিয়মে দীর্ঘদিন যাবৎ বলবৎ আছে গরিব ও প্রান্তিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারের নীতি। ৪০% ছাত্র-ছাত্রী আসে এমন পরিবার থেকে যাদের মাসিক উপার্জন ১২,০০০ টাকার নীচে। এখন হষ্টেলের ভাড়া যা বাড়ানো হচ্ছে, পরিষেবার খরচের নামে যে টাকা চাওয়া হচ্ছে তাতে এই সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের পুরো ইনকামই চলে যাবে সেই টাকা মেটাতে। তাতেও কম পড়বে। এইসব পরিবারের ছেলে-মেয়েরা আজন্ম প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে উন্নত মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চান্স পেলেও তার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। জেএনইউএর ভর্তির নিয়মে মেয়েদের জন্যও বিশেষ সুবিধা থাকায় এখানে অর্ধেকের বেশি পড়ুয়া গবেষক মেয়েরাই। হস্টেলের ফি বৃদ্ধি ও বেসরকারীকরণের ফলে তাঁরাও হস্টেল ও ভার্সিটি থেকে উৎখাত হয়ে যাবেন।
জেএনইউর ছাত্র-ছাত্রীরা তো কেবল নিজেদের কথা ভেবেই লড়ছে না। জেএনইউ-তে দীর্ঘস্থায়ী ও দৃঢ় ছাত্র-আন্দোলনের শক্তিশালী ধারা বর্তমান। যদি সেখানেই হস্টেল পরিচালনা ব্যবসার লজিকে বদলে দিতে সফল হয় সরকার, তাহলে কম খরচের অন্যান্য উন্নত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি) দ্রুতই একই রকম বদল এনে ফেলতে পারবে। ছাত্র-ছাত্রীরা এই সার্বিক বিপদের বিরুদ্ধেই লড়ছে। বড়লোক শ্রেণীর জন্য উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা কুক্ষিগত করে রাখার বিরুদ্ধে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুযোগ সমস্ত ভারতীয়দের জন্য খোলা রাখা নিশ্চিত করতে লড়ছে ছাত্র-ছাত্রীরা।
মোদি সরকার জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধই ঘোষণা করেছে যেন — ক্যাম্পাসে প্যারামিলিটারি সিআরপিএফ ট্রুপ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আর দিল্লীর রাস্তায় যখনই পড়ুয়ারা সোচ্চার হয়েছে তাদের কথা মানুষকে জানাতে, তখন মোদি সরকার পুলিশ দিয়ে নৃশংসভাবে লাঠিপেটা করেছে ছাত্র-ছাত্রীদের। দিল্লী পুলিশ কেন্দ্র সরকারের অধীন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লী পুলিশের মন্ত্রী। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদ চলাকালীন সেই পুলিশ বেআইনিভাবে নিভিয়ে দেয় রাস্তার সব আলো, অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর, নির্মমভাবে পেটায়, এক অন্ধ ছাত্রকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে তার বুকের ওপর বুট-পরা পায়ে লাফায়, ছাত্রীদের যৌন হেনস্থা করে।
জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীরা তবু ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ রেখেছে তাঁদের আন্দোলনের রূপ। এবং চিন্তা চর্চা ধারণার জগতে ইতিমধ্যেই জিততে শুরু করেছে তাদের সংগ্রাম। সঙ্ঘ-বিজেপির অপপ্রচার যন্ত্র ও বড়ো বড়ো কিছু টিভি চ্যানেল জেএনইউ-এর ছাত্র-ছাত্রীদের একগুচ্ছ ব্যয়বহুল বোঝা ও জেএনইউ-কে করদাতার টাকায় এক বেকার খরচ হিসেবে তুলে ধরতে রাতদিন প্রচার চালিয়েছে। তাদের অপপ্রচার সবচেয়ে কুৎসিত চেহারা নেয় ছাত্রীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রীদের বিরুদ্ধে চরম নারীবিদ্বেষী প্রচার চালায় তারা। কিন্তু জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকারা এই মিথ্যার জাল সরিয়ে প্রকৃত সত্য সামনে আনতে পেরেছেন। একথা এখন অধিকাংশ মানুষ জেনেছেন ও মেনেছেন যে লড়াইটা আসলে গরিব মানুষ তাদের ছেলে-মেয়েদের কলেজ ভার্সিটিতে পড়াতে পাঠাতে পারবে কি না সে প্রশ্নকে ঘিরে। করদাতারাই প্রশ্ন তুলছেন যে, ১,০০,০০০ কোটি টাকা শিক্ষা সেস ফান্ড অব্যবহৃত পেলে রেখে কেন বলছে যে উচ্চশিক্ষার খরচ চালানোর পয়সা সরকারের নেই? তাঁরা আরও প্রশ্ন তুলেছেন যে, প্রতি বছর কয়েক লক্ষ কোটি টাকা কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব করে দেওয়া হয় কেন? সেই টাকা একত্র করলে তো শত শত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানো যায়!
জেএনইউ স্টুডেন্টরা ফি “রোল ব্যাক”-এর ধাপ্পা বা “বিপিএল স্টুডেন্টদের জন্য কনশেসন”- এর চালাকি উন্মোচিত করেছে। বাস্তবে এসব প্রস্তাব গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কোনও সুরাহা নয়।
জেএনইউ-এর ছাত্র-ছাত্রীদের ঐক্যের চাপে এমনকি সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন এবিভিপিও যে আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছে। এবং ছাত্র-ছাত্রীদের তোলা দাবিগুলির মিমাংসা করতে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু জেএনইউ-র ভিসি এমনকি এই কমিটির মিটিংও এড়িয়ে যায়। জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের দিক থেকে পরিষ্কার। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে অবিলম্বে হস্টেল ফি বৃদ্ধি প্রত্যাহার করে নিতে হবে আর আলোচনার জন্য কোনও কমিটি হলে তাতে জেএনইউ স্টুডেন্টস ইউনিয়নের প্রতিনিধি অবশ্যই থাকতে হবে।
জেএনইউ-এর আন্দোলন দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে, সারা দেশে ও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে। সঙ্ঘ ও বিজেপি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ভয় করে। কারণ, বিরোধী দলগুলির তোলা প্রশ্ন ইডি বা সিবিআই রেইডের ভয় দেখিয়ে দমিয়ে দেওয়া গেলেও তাদের তোলা প্রশ্নগুলিকে সেভাবে দমানো যায়না। তারা মোদি সরকারের গরিব-বিরোধী শিক্ষা-বিরোধী চেহারা উন্মোচিত করে দিচ্ছে। ভারতের জনতাকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, দেশের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতের জন্য।