বেঙ্গালুরু থেকে সৌরবিজয় সরকার জানিয়েছেন যে তাঁরা অল ইন্ডিয়া পিপলস ফোরাম (এআইপিএফ)- এর পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল গত ১৬ নভেম্বর শহরের রামমূর্তিনগর এলাকায় বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের সাথে দেখা করতে যান। এইসব শ্রমিক ও এলাকার মানুষদের সাথে কথা বলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জানা যায় বলে জানিয়েছেন তিনি —
“এইসব অভিবাসী শ্রমিকেরা বিগত সময়ে গড়পড়তা ৭/৮ বছর যাবৎ বিবিএমপি (বৃহৎ বেঙ্গালুরু মহানগর পালিকা)-র অধীনে চুক্তি শ্রমিক হিসেব রাস্তায় জমা ময়লার স্তুপ সাফাইয়ের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। শহরের একদম প্রান্তে অত্যন্ত সংকীর্ণ ও নোংরা বস্তিতে চরম দরিদ্র এই মানুষগুলির বাস। একজন মহিলা চা- বিস্কুটের গুমটি চালান। তাঁদের হিসেব অনুযায়ি রামমূর্তি নগর ও কেআরপুরম এলাকায় সব মিলিয়ে এরকম প্রায় চার হাজার মানুষের বাস যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। সম্প্রতি পুলিশ রেইডের কারণে তাঁদের অধিকাংশই এখন ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছে। অনেকে তামিল নাড়ু ও জম্মুর দিকে চলে গেছে কাজের সন্ধানে। যারা ভয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাঁরা অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের বর্ডারে আটক বলে জানেন তাঁরা। এদের মধ্যে বেশ কিছু শিশুও আছে। বস্তিবাসীদের অনেকেই কিছু রোজগার করে নিজের দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। ফিরে যেতে চাইলে বর্ডারে কেন তাঁদের আটকানো হচ্ছে সে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।”
প্রাথমিকভাবে এই কথাগুলি জানানোর সাথে সাথে কমরেড সৌরবিজয় সরকার এও জানিয়েছেন বেঙ্গালুরুর বেশ কয়েকটি এলাকাতেই অনুরূপ টিম গেছে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই এআইপিএফ-এর পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করা হবে। তিনি অভিমত ব্যক্ত করে জানিয়েছেন:
“অভিবাসী শ্রমিক এবং এনআরসি-র প্রশ্ন আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণী তথা শ্রেণী সংগ্রামের প্রশ্ন। তার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে ভারতে সঙ্ঘ-বিজেপির মুসলমান বিদ্বেষ-অভিযানের প্রশ্নটি। তবে শেষ বিচারে মূল প্রশ্নটি হল শ্রেণী ও মানবতার প্রশ্ন। সাত-আট বছর ধরে বসবাস করা মানুষগুলির জন্য নাগরিকত্বের দাবি তোলা উচিৎ আমাদের। তাছাড়া, কেউ স্বেচ্ছায় নিজের দেশে ফিরে যেতে চাইলে কেন তাকে আটক করা হবে? তাঁরা কাগজপত্র ছাড়াই এসেছিলেন একথা ঠিক, কিন্তু বেঙ্গালুরু মহানগর পালিকা (কর্পোরেশন) তো তাদের দিয়েই দীর্ঘদিন কাজ করিয়ে নিয়েছে। এই দায় তো কর্তৃপক্ষ বা সরকার অস্বীকার করতে পারে না! এখন এই অভিবাসী শ্রমিকদের ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। তার ওপর আবার ডিটেনশন করে অতিরিক্ত অত্যাচার কেন?”
এদিকে বেঙ্গালুরু থেকে যে বাঙালি শ্রমিকদের গত ২৩ নভেম্বর হাওড়া স্টেশনে আনা হয়েছিল তাঁদের একাংশকে হাওড়ার নিশ্চিন্দা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই খবর পেয়ে পার্টির হাওড়া জেলার কর্মীরা সেখানে যান। নীলাশিস বসু জানিয়েছেন:
“আজ বালি নিশ্চিন্দা থানায় যাওয়া হয়। থানা কোনও তথ্য দিতে অস্বীকার করে। তারা বলে কিছু তারা জানাতে পারবেনা। ওসি থানায় ছিলেন না, ওসি’র নাম্বার চাইলেও প্রথমে থানা দিতে চায়নি। চাপ দেওয়ার পর ওসি’র নাম্বার পাওয়া যায়। কিন্তু ওসি বলেন তিনি কিছু বলতে পারবেন না। কোনও তথ্য দিতে পারবেন না। যা বলার বিডিও বলবেন। তখন আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয় ওই মানুষগুলো কিভাবে আছেন, ঠিকমতো পরিষেবা পাচ্ছেন কিনা, খাবার, চিকিৎসা পাচ্ছেন কিনা, কোথায় আছেন এগুলো অন্তত জানানো হোক। তিনি শুধু বলেন তারা ভালো আছে, খাবার পাচ্ছে। আর কিছু তিনি বলতে পারবেন না। আমরা তখন বিডিও-কে ফোন করি, তিনি ফোন ধরেননি। আজ রবিবার হওয়ায় বিডিও অফিসও বন্ধ। প্রতিনিধি দলে ছিলেন দেবব্রত ভক্ত, কল্যাণ গোস্বামী, তপন ঘোষ এবং নীলাশিস বসু।”
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে ২৩ রাতেই হাওড়া স্টেশনে গিয়ে আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু রেল পুলিশ বা রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে কোনও তথ্য দিতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশের বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে “পুশব্যাক” আটকাতে বাংলাদেশ সরকার প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বিশেষ নির্দেশিকা দিয়েছে। নির্দিষ্টভাবে এই ৫৭ (৫৯?) জনের বিষয়েও লিখেছে কাগজগুলি। জনকন্ঠ পত্রিকা লিখেছে, “সীমান্তের অধিবাসী ও জনপ্রতিনিধিদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সীমান্তবাসীরা জানায় আজকালের মধ্যে যে কোনো এলাকা দিয়ে বিএসএফ ৫৭ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করাতে পারে সে জন্য বিজিবিসহ এলাকাবাসী সতর্ক রয়েছে। খবর প্রকাশ পেয়েছে নতুন করে আরও ৫৭ জনকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে ভারতের কর্নাটক প্রদেশের সরকার। শুক্রবার সকালে এদের ট্রেনে চাপানো হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। আটকদের মধ্যে রয়েছেন ২২ পুরুষ, ২৫ মহিলা এবং ১০ শিশু।” ভারতে এনআরসি শুরু হওয়ায় ভারত থেকে বাংলাদেশে “অনুপ্রবেশ” শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার এবং এই “পুশ ইন” আটকাতে তৎপর হয়েছে।
সিপিআই(এমএল)-এর রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ এক প্রেস বিবৃতিতে জানান যে নিশ্চিন্দায় কি তাহলে বেনামে ডিটেনশন ক্যাম্প চালু হয়ে গেল? “পুশব্যাক” ও “পুশইন রোধ”-এর মাঝে কোথায় হারিয়ে যাবে হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক? নির্দিষ্ট এই ৫৯ (অথবা ৫৭) জনের, যাদের মধ্যে অনেক শিশুও আছে, সকলেই বাংলাদেশের কি না তাও নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়নি। মানুষগুলিকে এভাবে চোখের আড়াল করে দেওয়া কেবল মাত্র কিছু ব্যক্তিকে হাপিশ করে দেওয়ার প্রশ্ন নয়, বরং অন্তর্বস্তুতে এ আসলে আমাদের অস্তিত্ববোধ ও পরিচিতিকেই হাপিশ করে দেওয়া। না রুখতে পারলে তা চরম সামাজিক ক্ষতি করবে। কোনও মানুষই বেআইনি নয়। মানুষ বেআইনি হতে পারে না। অন্যদিকে এভাবে, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ না দিয়ে কাউকে “পুশব্যাক” করাটা চরম বেআইনি। একে রুখতে হবে। এ কেবল ঐ বিপন্ন মানুষগুলির বিষয় নয়, সমগ্র সমাজের বিষয়। তথ্য গোপন রাখা মানে তো মানুষগুলিকেই গায়েব করে দেওয়া। প্রশাসনের এই আচরণের বিরুদ্ধে ঘেরাও কর্মসূচী নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন রাজ্য সম্পাদক।
দৈনিক সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী কর্ণাটক থেকে নিয়ে আসা উপরোক্ত “বাংলাদেশীদের” দু’নম্বর জাতীয় সড়কের পার্শ্বভূমি বালির সমবায় পল্লীতে জলাশয় ও গাছপালা ঘেরা একটি তিনতলা বাড়িতে রাখা হয়েছে। সঙ্গে থাকছে জনা চল্লিশেক কর্ণাটকী পুলিশ। বাড়িটি দুর্গাপুর-অভয়নগর দু’নম্বর পঞ্চায়েতের তৈরি, রাজ্য সরকার বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। সরকারি সূত্র আশ্বস্ত করতে জানাচ্ছে বাংলাদেশীদের প্রতি “মানবিক” ব্যবহারই করা হচ্ছে, মাছে-ভাতে রাখা হচ্ছে। কিন্তু সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে কেন সেই প্রশ্নের কোনো প্রত্যুত্তর মিলছে না। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর এক প্রতিনিধিদল গিয়েছিল প্রত্যক্ষদর্শী হতে ও কিছু ওষুধপত্র দিতে। কোনোটারই অনুমোদন মেলেনি। ফলে, সমাদরে রাখার সরকারি দাবি বুঝে ওঠার উপায় নেই। ঘটনার পরিণতি কোন খাতে গড়াবে, এখানে যেমন গৃহবন্দী রাখা হচ্ছে তেমনই রাখা হবে, নাকি ফের কর্ণাটকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, নাকি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে, সবটাই থাকছে ধোঁয়াশায়। তাই পরিস্থিতি দাবি করছে বাইরে থেকে যথাসাধ্য নজরদারি রাখার। প্রকৃত মানবাধিকার স্বীকার করে বাংলাদেশীদের মুক্তির স্বাদ পেতে দেওয়া ও গন্তব্যের প্রশ্নে তাদের পছন্দকেই সম্মান দেখানো উচিত। তার জন্য প্রয়োজনে দেশের ভেতরে দ্বিপাক্ষিক-ত্রিপাক্ষিক এবং বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ আলাপ-আলোচনা করা উচিত।