জেএনইউ আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান! দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খোলা রাখুন!

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দীপনাময় লড়াই শিক্ষার অধিকারের ইস্যুটাকে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের একেবারে কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। দিল্লীর জেএনইউ হল ভারতে গুটিকয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঁচু মানের শিক্ষা লাভ করাটা দরিদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েদের সাধ্যের মধ্যে থাকে। তবে মোদী সরকারের নিয়োগ করা উপাচার্য হোস্টেল ঘরের ভাড়া চড়া হারে বাড়িয়ে এবং হোস্টেলের সুযোগ-সুবিধার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটিয়ে — যার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক বেশি পরিষেবা মূল্য, এবং চড়া হারে জল ও বিদ্যুতের বিল মেটাতে হবে — দরিদ্রদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করার উপক্রম করেছেন।

জেএনইউ-তে দীর্ঘদিন ধরে চালু ভর্তি নীতি দরিদ্র এবং প্রান্তিক ঘরের ছেলে-মেয়েদের ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দেয়, সেই নীতির কল্যাণে এমন ৪০ শতাংশ পরিবারের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়তে আসে যাদের মাসিক আয় ১২০০০ টাকারও কম। ফি এবং পরিষেবা মূল্যের বৃদ্ধির পর ঐ সমস্ত পরিবারের অভিভাবকরা তাঁদের ছেলে বা মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখতে চাইলে হোস্টেল ফি বাবদ তাঁদের মাসিক আয়ের সমগ্ৰের চেয়েও বেশি খরচ করতে হবে! জেএনইউ-র ভর্তি নীতির আর একটা সুফল হল জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীদের অর্ধেকই ছাত্রী : ফি বৃদ্ধি এবং হোস্টেলগুলোর বাণিজ্যিকীকরণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের উৎখাত করবে।

জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীরা শুধু নিজেদের জন্য লড়াই করছে না। যে জেএনইউ-তে ছাত্র আন্দোলন এত শক্তিশালী সেখানে হোস্টেলের বাণিজ্যিকীকরণ সফল হতে পারলে অন্যান্য যে সমস্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি কম রয়েছে (বিএইচইউ, এএমইউ, এইচসিইউ সহ) সেগুলোর পরিণতিও জেএনইউ-র মতনই হবে। জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীরা এটা সুনিশ্চিত করার জন্যই লড়াই করছে যে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রতিটি ভারতবাসীর অধিকার, তা শুধু ধনীদের জন্য সুরক্ষিত কোনো বিশেষ অধিকার নয়।

মোদী সরকার জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে — জেএনইউ ক্যাম্পাসে সিআরপিএফ বাহিনীকে ঢুকতে দিয়েছে, জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীরা যখনই দিল্লীর রাস্তাতে প্রতিবাদ জানিয়েছে তখনই তাদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। যে দিল্লী পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সেই দিল্লী পুলিশ বেআইনিভাবে রাস্তার আলো নিভিয়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে তাদের নির্মমভাবে প্রহার করে। এক দৃষ্টিহীন ছাত্রকে রাস্তার ওপর ফেলে পুলিশ বুট দিয়ে লাথি মারে। ছাত্রীদের ওপরও যৌন হেনস্থা চালানো হয়।

হিংসার কাছে মাথা নত না করে জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এরই সাথে তারা ধারণার মধ্যে লড়াইটাতেও জয়ী হচ্ছে। প্রভাবশালী টিভি চ্যানেলগুলো সহ সংঘের প্রচার যন্ত্র জেএনইউ-কে করদাতাদের অর্থের অপচয় রূপে তুলে ধরছে এবং জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীদের এমনভাবে চিত্রিত করছে যেন তারা অন্যের ঘাড় ভেঙ্গে খাওয়া পরজীবী। তারা যখন জেএনইউ-র ছাত্রীদের চরম নারী-বিদ্বেষী ভাষায় নিশানা করে তখন তাদের আক্রমণ কুৎসিততম রূপ নেয়। তবে বাস্তবটা হল, জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকরা মিথ্যার জিগিরকে ছিন্ন করে সত্যিটাকে তুলে ধরেছেন। এখন ব্যাপক সংখ্যক মানুষই স্বীকার করেন যে, লড়াইটা আসলে হল নিজেদের ছেলে-মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে দরিদ্র মানুষদের সক্ষম করে তোলা। করদাতা নাগরিকরা এখন প্রশ্ন তুলেছেন, যে সরকার দাবি করছে যে উচ্চ শিক্ষায় ব্যয় করার জন্য অর্থ তাদের নেই সেই সরকার শিক্ষা সেস বাবদ সংগ্ৰহ করা ১,০০,০০০ কোটি টাকা ব্যয় না করে রেখে দিয়েছে কেন। তাঁরা আরও প্রশ্ন করছেন, প্রতি বছর লক্ষ-লক্ষ কোটি টাকা কর্পোরেট কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে কেন, যেগুলো সংগ্ৰহ করা হলে সরকার কয়েক শত বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ যোগাতে পারত।

জেএনইউ-র ছাত্ররা বর্ধিত ফি “প্রত্যাহার” এবং “ বিপিএল ছাত্রদের জন্য সুবিধা”এর ধাপ্পাকে উন্মোচিত করেছে। বস্তুত, তথাকথিত এই প্রত্যাহার এবং সুবিধা দান জেএনইউ-র প্রকৃত কোন ছাত্র-ছাত্রীরই সুবিধা করতে পারে না।

জেএনইউ-র ছাত্র সম্প্রদায়ের ঐক্যের সামনে সংঘের নিজের ছাত্র শাখা এবিভিপি-ও যে আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার দাবি করতে বাধ্য হচ্ছে, এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক একটা কমিটি গঠন করেছে, আপাতদৃষ্টিতে যার উদ্দেশ্য ছাত্রদের তুলে ধরা ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তি করা। সংবাদে প্রকাশ, জেএনইউ-র উপাচার্য এই কমিটির একটা বৈঠকে যোগ দেওয়াকেও এড়িয়ে গেছেন। জেএনইউ-র ছাত্রদের দাবিতে কোনো ধোঁয়াশা নেই — ফি বৃদ্ধি এবং হোস্টেলের বাণিজ্যিকীকরণের প্রত্যাহারকে অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে এবং যে কমিটি এই ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করবে তাতে জেএনইউ ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।

জেএনইউ-র আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে এবং ছাত্রদের মধ্যে। সংঘ এবং বিজেপি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঘৃণা করে, কেননা, ভারতের প্রধান বিরোধী দলগুলোর মতো তাদের তোলা প্রশ্নগুলোকে সিবিআই এবং ইডি-কে দিয়ে হানাদারি চালানোর হুমকি দিয়ে দমন করা যাবে না! তারা মোদী সরকারের দরিদ্র-বিরোধী, শিক্ষা-বিরোধী মুখকে উন্মোচিত করছে। যে ছাত্র আন্দোলন ভারতের যুবকদের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করছে, ভারতের জনগণকে তার প্রতি অবশ্যই সংহতি জানাতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৯ নভেম্বর ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-38