দিল্লী থেকে বালি ... কিলোমিটারে যতদূরই হোক, উত্তেজনার মিটারে প্রায় গায়ে গায়ে ... সরাসরি লড়াইয়ের ময়দান দুটোই — গেরুয়া ফ্যাসিবাদ বনাম লাল প্রতিবাদ! জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পথে নেমেছিল কয়েকটা দিন আগে, সেটা যে তাদের নিজেদের হস্টেল ফি প্রায় ৩০০% বেড়েছে কেবলমাত্র তার বিরুদ্ধেই নয়, ওরা চিৎকার করেছিলো ‘নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৯-এর ছদ্মবেশে শিক্ষায় মোদী সরকারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার বদমায়েশির ছকের বিরুদ্ধে, সরকারী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইচ্ছাকৃতভাবে লাটে তুলে দিয়ে জিও ইউনিভার্সিটির অছিলায় আম্বানীদের পকেট ভরানোর আরেকটা চেষ্টার বিরুদ্ধে, আইআইটি মাদ্রাজের ছাত্রী ফতেমা লতিফের প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার বিরুদ্ধে। তাই ওদের রেয়াত করেনি বিজেপি সরকারের পুলিশ। বর্বরভাবে লাঠি, জলকামান চালিয়ে রক্তপাত ঘটিয়ে হসপিটালে পাঠিয়েছে, এমনকি দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদেরকেও, গ্রেফতার করেছে জেএনইউ ছাত্রসংসদের দুই প্রাক্তন সভাপতি কমরেড গীতা কুমারী এবং এন সাই বালাজী, বর্তমান সভাপতি কমরেড ঐশী ঘোষ সহ আরো অনেককে।
আর বাংলায় তো প্রশাসনকে পুরোপুরি কব্জা করা অবধি অপেক্ষার বালাইটুকুও নেই, এখন থেকেই বিজেপিকে প্রশ্ন করা যে কেউ ‘পাকিস্তানের দালাল’ তকমা পাচ্ছে। গত ১৯ নভেম্বর সেভাবেই হাওড়ার বালিতে প্রতিবাদরত এআইএসএ(আইসা) কমরেডদের উপর নেমে এল সরাসরি বিজেপির গুণ্ডাবাহিনীর নারকীয় হামলা। জেএনইউএর ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের দাবিগুলোরই সমর্থনে ও সেখানকার আন্দোলনকারীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্লোগান ও ফ্যাসিবাদী সরকারের কুশপুতুল দাহ করছিলেন ছাত্র-ছাত্রীরা। হঠাৎই সামনে এলো বিজেপির উঠতি গুণ্ডাদের ফতোয়া — “দেশে থেকে প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো যাবে না”। ওদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধরন কী হবে (যদিও অসাংবিধানিক বা বেআইনি কোনও পথে হয়নি) সেটাও নাকি ওরাই ঠিক করে দেবে! দেশটাকে নিজেদের একচেটিয়া সম্পত্তিভাবে আর কি। স্বাভাবিক ভাবেই রুখে দাঁড়ান ও প্রশ্ন করেন আইসা কর্মীরা, কিন্তু গেরুয়া ধর্মান্ধ ও কর্পোরেট দালালরা কবে আর যুক্তির কথা শুনেছে? অগত্যা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে শুরু করলো নির্বিচারে লাঠিসোঁটা নিয়ে মাটিতে ফেলে মারধোর, মহিলা কমরেডের শ্লীলতাহানি, চরম পুরুষতান্ত্রিক যৌনগন্ধী গালিগালাজ, মন্তব্য দীর্ঘ সময় ধরে।
ঘটনাচক্রে সেদিন বালিতে আইসার রাজ্য কমিটির বৈঠক ছিল, সেটা শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় প্রতিবাদী কর্মসূচী, ফলত প্রতিবাদ কর্মসূচীতে সামিল ছিলেন রাজ্য সম্পাদক স্বর্ণেন্দু মিত্র, সভাপতি নিলাশিস বসু সহ প্রায় পুরো রাজ্য কমিটি এবং হাওড়া জেলা নেতৃত্ব ও এলাকার ছাত্র-ছাত্রী কমরেডরাও। স্কুল, কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সহ তাদের সবার উপরেই চললো এই বর্বর হামলা। গুরুতর জখম হন শুভদীপ দাস ও স্বর্ণেন্দু, এছাড়া অন্যান্য কমরেডরাও ভালোরকম আহত হন কিন্তু এত অত্যাচারের মুখেও তারা হাত থেকে লাল পতাকা আর শ্লোগান ছাড়েননি শেষ পর্যন্ত। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় কমরেড শুভদীপকে, অন্যান্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। রাতে বালি থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়। কিন্তু বহু ঘটনার মতো প্রশাসন এক্ষেত্রেও দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় যত না মনোযোগ দিলো, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকলো পরবর্তী প্রতিবাদে বাধ সাধতে। কিন্তু গেরুয়া গুণ্ডারা নির্বোধ তাই মারতে এলো বালিতে আর আইসার আন্দোলন ছড়ালো অলিতেগলিতে। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত শরীরগুলো মেরুদণ্ডকে টানটান করে চারপাশ থেকে ছুটে আসা সঙ্গীসাথী কমরেডদের সাথে নিয়ে পরেরদিন অর্থাৎ ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় আবার নামলো পথে, হাতে আরো বেশি লাল ঝাণ্ডা, মুখে আরো সোচ্চার শ্লোগান, সরাসরি ক্ষমতার রাজনীতি ও প্রশাসনের বাধার চোখে চোখ রেখে। শতাধিক ছাত্রযুব, প্রবীণ, মহিলা, শ্রমিক দৃপ্ত পায়ে মিছিল শুরু করলেন আগেরদিনের ঘটনাস্থল জোড়া অশ্বথ্বতলা থেকেই। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ সহ জেলা নেতৃত্ব ও আইসার রাজ্য নেতৃত্ব। বাড়ির ছাদে, দরজায়, রাস্তার মোড়ে, দোকানে, জি টি রোডে সর্বত্র দলে দলে বেরিয়ে এসে বালির মানুষ দেখলেন ও অকুণ্ঠ সংহতি জানালেন এই প্রতিরোধের মেজাজে তৈরি থাকা সৃজনশীল মিছিলকে। নিমতলা, মেকল, বালিখাল ঘুরে পদযাত্রা শেষ হল জনবহুল বালি বাজারে। সেখানে সংক্ষিপ্ত পথসভায় প্রতিবাদে সমর্থনকারী বালির জনগণকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে প্রয়োজনে বারংবার পথে নামার কথা বললেন পার্থ ঘোষ, নিলাশিস বসু ও সিপিআই(এমএল)-র বালি-বেলুড় আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক মাধব মুখার্জী।
এই গোটা কর্মকাণ্ড বালি সহ গোটা বাংলার বুকে শিক্ষার বেসরকারীকরণ ও গেরুয়াকরণ রোখার, ‘আচ্ছে দিন’-এর নামে নতুন করে তৈরি হওয়া ৯০ লক্ষ বেকার ও বেড়ে চলা কৃষক আত্মহত্যার নির্মম সত্যিগুলোকে আরো মানুষকে কোণায় কোণায় জানিয়ে দেওয়ার, নোটবন্দী-জিএসটির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে পথে বসানোর চক্রান্ত ব্যর্থ করার, দেশজোড়া এনআরসি-র নাম করে দেশের মানুষকে ‘পরদেশী’ বানানোর চক্রান্ত ফাঁস করার আর দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু হত্যা ও পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গাবাজির গেরুয়া ষড়যন্ত্র চুরমার করার বার্তা দিয়ে দিলো। ফ্যাসিবাদ বনাম জনগণের দ্বন্দ্বে মানুষ তাঁদের প্রকৃত সহযোদ্ধাদের চিনতে পারছেন।