সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে বিপরীতমুখী দুই ছাত্র আন্দোলনের খবর সামনে এসেছে। একদিকে চলছে বামেদের নেতৃত্বে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে হোস্টেলের ফি বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন। অন্যদিকে এবিভিপি তথা হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার ছাত্ররা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে নেমেছে সংস্কৃত বিভাগে এক মুসলিম অধ্যাপকের নিয়োগের বিরুদ্ধে। বাম ভাবধারার ছাত্র আন্দোলন যখন শিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধিকে রুখে উচ্চশিক্ষাকে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গতির মধ্যে রাখতে চায়, শিক্ষার বেসরকারীকরণ ও পণ্যায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শিক্ষায় সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য আওয়াজ তোলে, তখন হিন্দুত্ববাদের প্রভাবাধীনরা ছাত্র আন্দোলনকেও ঠেলে দিতে চায় হিন্দু-মুসলিম ধর্মের লড়াই ও সাম্প্রদায়িকতার অন্ধ গলিতে।
গত ৫ নভেম্বর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংস্কৃত সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপত্র দিয়েছিল ফিরোজ খানকে। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা সাহিত্য একজন ‘মুসলিম শিক্ষকের’ কাছে পড়তে অসম্মতি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করে সঙ্ঘ মতাদর্শ প্রভাবিত একদল হিন্দুত্ববাদী ছাত্র। এই ঘটনা শুধু ভাষার সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করার ভুল প্রবণতাই দেখায়নি, সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যের বিকাশ ও বিশ্বজনীন চর্চার ইতিহাস সম্পর্কে তাদের চূড়ান্ত মুর্খতাকেই প্রকাশ করেছে।
এদেশে এবং বিদেশে আধুনিককালে সংস্কৃত চর্চাকে যারা জনপ্রিয় করে তোলেন তাদের নামের তালিকা তৈরি করতে বসলে যে নামগুলি অবধারিতভাবে চলে আসে — সেই ম্যাক্সমুলার, উইলিয়াম জোন্স, মনিয়ের উইলিয়ামস, ভিনসেন্ট স্মিথ, মরিস উইন্টারনিজ, এ এল ব্যাশম সহ অনেকেই হিন্দু ছিলেন না, একথা এই প্রতিবাদকারীদের মাথায় আসেনি। একথাও মাথায় আসেনি যে সংস্কৃত ভাষাকে কেবল ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত করে দেখলে এর মাধ্যমে যে বিভিন্ন ধারার জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রেখে গেছেন কৌটিল্য, পাণিনি, চরক, শুশ্রুত, আর্যভট্ট, বরাহমিহির সহ অসংখ্য পণ্ডিতেরা — তাকেই সমূলে বিনষ্ট করা হয়।
হিন্দুত্ববাদীদের এই প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভারতের ঐতিহ্য নিয়ে যে গৌরবের কথা তারা বলে, সে সম্পর্কে তাদের প্রকৃত কোনও বিশ্লেষণ বা অধ্যয়ন নেই। অতীত ভারতকে না জেনেই এর গৌরবের কথা তারা বলে এক সীমাবদ্ধ খণ্ডিত ও বিকৃত এক ধারণার ভিত্তিতে। অতীতের ভারতকে তারা মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চায়, কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাদের ইতিহাসজ্ঞানের অভাব বড় হয়ে দাঁড়ায়। তারা হয় জানেই না বা জেনেও রাজনৈতিক শঠতার লক্ষ্য থেকে এই তথ্য আড়াল করে রাখে যে ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের অসাধারণ পুঁথিগুলি মুসলিম আব্বাসীয় শাসনকালেই প্রথম ভারতের বাইরে অনুদিত হয়ে শুরু হয় এবং এই আরবী অনুবাদের হাত ধরেই তা বিশ্বজ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার অঙ্গ হয়ে ওঠে। প্রথম প্রখ্যাত মুসলিম চিকিৎসা-বিজ্ঞানী আল রাজি ভারতীয় সংস্কৃত ভাষায় রচিত চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেকগুলি বইকে অনুবাদ করেছিলেন বা সেগুলিকে অবলম্বন করে তার আরো বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। ব্রহ্মগুপ্তের লেখা ব্রহ্মসিদ্ধান্ত বইটি ছিল আব্বাসীয় আমলের জ্যোতর্বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম আকর। বিখ্যাত আরব গণিতবিদ আল খোয়ারিজমি ব্রহ্মগুপ্তের সূর্যসিদ্ধান্ত এবং আর্যভট্টের সূর্যসিদ্ধান্তর মতো গ্রন্থকে পাথেয় করেছিলেন।
জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা ধর্ম বা ভাষার সীমানাকে আমল না দিয়েই সব সময়ে এগিয়েছে এবং মানব মুক্তির পথ তৈরি করেছে। এই ইতিহাসকে বিকৃত করে যারা ছাত্র আন্দোলন তথা সমাজকে বিপথে চালিত করতে চায় নিজস্ব রাজনৈতিক লাভ ও ক্ষমতাকে কুক্ষীগত করার বাসনা নিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা ও তাদের জনবিচ্ছিন্ন করাটা এই সময়ের এক জরুরি কাজ।