সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকা ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ কর্মসূচিতে দেশজুড়ে বিরাট সাড়া মিলেছে। দেশব্যাপী সংগ্রামী কৃষক ঐক্যের জাগরণ সংগঠিত হতে দেখা গেল। পশ্চিমবঙ্গেও সর্বস্তরের মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে উজ্জীবিত হয়ে ওঠা বনধ পালিত হল । রাজ্য জুড়ে কৃষক, কৃষি শ্রমিক, শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও কর্মচারী, ছাত্র, যুব, ব্যবসায়ী, মহিলা সংগঠন, এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক ও অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে। বেসরকারি বাস ও যানবাহন একরকম বন্ধই ছিল। দোকান, বাজার, ব্যাংক, বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলি বন্ধ ছিল। অন্তত রাজ্যের ২৪টা জায়গায় জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ ছিল।
বাংলার সব জেলার সব ব্লক এবং প্রধান শহরগুলির জায়গায় জায়গায় ব্যাপক সমাবেশ, প্রতিবাদ সভা, মিছিল, রাস্তা অবরোধ এবং রেল অবরোধ হয়েছে।
রাজধানী কলকাতায়, অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির ব্যানারে কৃষক সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে পথসভা করে এবং অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির প্রধান ও দীর্ঘ মিছিলটি মৌলালী মোড় থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত যাত্রা করে ডোরিনা ক্রসিং অবরোধ করে। সেখানে বিভিন্ন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুব, মহিলা, ব্যাঙ্ক কর্মচারী এবং অন্যান্য গণ সংগঠনের নেতৃত্ব মোদী সরকারের নীতির সমালোচনা ও বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। কৃষি ও কৃষক স্বার্থ বিরোধী তিনটি আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করা, কৃষিতে কোম্পনীরাজ কায়েম না করা, ফসলের উৎপাদন ব্যয়ের দেড়গুন সহায়ক মূল্য দেওয়া ইত্যাদি দাবিতে মিছিলে শ্লোগান ওঠে, বক্তারা সোচ্চার হন। এছাড়া দাবি তোলা হয়, মানিটাইজেশনের নামে পাইপলাইন প্রজেক্ট বাতিল করতে হবে।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী পাঞ্জিপাড়া, রায়গঞ্জ, করণদিঘি (উওর দিনাজপুর), কুলতলি, ভাঙড় (দক্ষিণ ২৪ পরগণা), ভান্ডারটিকুরি, শিরীষতলা, জাহান নগর, নিমো, বর্ধমান শহর, কালনা, আসানসোল, ধুবুলিয়া, কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়া শহর সহ পাঁচাল, পুরুলিয়া শহর, ঝাড়গ্রাম, শিলিগুড়ি, নকশালবাড়ি সহ আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বীরভূম জেলার শতাধিক জায়গায় ব্যাপক বিক্ষোভ, সমাবেশ এবং তীব্র প্রতিবাদী কর্মসূচি সংঘটিত হয়েছে।
বিভিন্ন কৃষক নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অবৈধভাবে পাস করা ৩টি কালা আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত কৃষকের সব ফসলের জন্য এমএসপি নিশ্চিত করার জন্য একটি নতুন আইন কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা পাস না করা হবে, ততদিন কৃষকদের বিক্ষোভ এবং সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বক্তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াগুলিকে ধ্বংস করার, গণতান্ত্রিক অধিকারকে পদদলিত করার, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে দেওয়ার, জাতীয় সম্পদকে বিক্রি করার এবং দেশের যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অস্থিতিশীল করার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচেষ্টার বিরোধিতা ও নিন্দা করেন। “কর্পোরেট ভাগাও, দেশ বাঁচাও” শ্লোগান বারবার উত্থাপিত হয়। মোদী সরকারের কর্পোরেটপন্থী, কৃষকবিরোধী এবং শ্রমিকবিরোধী মনোভাবের তীব্র নিন্দা করা হয়।
দৃঢ়ভাবে দেশের কৃষকদের পাশে দাঁড়াবার জন্য এবং তাদের সংগ্রামী মনোভাবকে উৎসাহী সমর্থনের জন্য বাংলার জনগণকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ও কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত কৃষকদের এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে, এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা।
কেন্দ্র এবার থাবা বাড়াতে চলেছে সমবায় ব্যবস্থার দিকে। ধূয়ো তুলছে — নতুন সমবায় পলিসি চাই, চাই নতুন সমবায় আইন। বহুরাজ্যিক সমবায় ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ঘোষণা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, তিনি সমবায় মন্ত্রকেরও মাথায়। ইতিমধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মজুদ অর্থভান্ডারের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পলিসি বানিয়ে নেওয়া সারা। আর, সংকোচন ও বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার একই প্রক্রিয়ায় সুপরিকল্পিত উধাওকরণ ও একীকরণ প্রক্রিয়ার দাপাদাপিও শুরু করে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর এখন নিশানা বানানো হচ্ছে সমবায় ব্যবস্থাকে। গত জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সমবায় মন্ত্রক প্রায়োজিত ‘জাতীয় সমবায় সম্মেলন’ মঞ্চ থেকে ঘোষণা শুনিয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী অমিত শাহ। কত কীই না বলা হচ্ছে! ‘যুক্তি’ দেওয়া হচ্ছে, বিশেষত পিএসিএস বা প্রাথমিক কৃষি সমবায় সংস্থাগুলির আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণই লক্ষ্য। এখন গড়ে গোটা দশেক গ্রাম ভিত্তিতে একটি করে সমবায় রয়েছে। নয়া আইনে সমবায় গঠন হবে নাকি প্রতিটি গ্রাম পিছু একটি করে। এখন মোট সমবায়ের সংখ্যা পঁয়ষট্টি হাজার, সংখ্যাবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা তিন লক্ষাধিক, সময় ধরা হবে পাঁচ বছর, ২০২৬ পর্যন্ত। তার মানে, ফিবছর গড়ে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি সংখ্যায় সমবায় তৈরি করা হবে!
যখন নতুন করে সমবায় মন্ত্রক তৈরি করা হল তখন বলা হয়েছিল এটা মূলত রাজ্যের এ্যক্তিয়ারভুক্ত, কেন্দ্র বিশেষ নাক গলাবে না। এখন সম্পূর্ণ বিপরীত সুর। পুরোদস্তুর হস্তক্ষেপ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। বাহানা বানানো হচ্ছে সমবায় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং বয়স্ক কর্মচারীদের আধিক্য মুক্ত করে এর অর্থব্যবস্থায় দ্রুত লেনদেনের সঞ্চালন, পেশাদারিত্ব, কর্পোরেট ধাঁচের পরিচালন শৈলী কিভাবে নিয়ে আসা যায় সেসবই নাকি উদ্দেশ্য। বলা হচ্ছে, নয়া উদ্যোগের লক্ষ্য হল প্রধানমন্ত্রীর ‘ভোকাল ফর লোকাল’ রণনীতির ভিত্তিতে ‘'আত্মনির্ভর ভারত'’ নির্মাণযজ্ঞ শুরু করা। ঘটনা ও প্রবণতাও হল যে, চলমান সমবায় ব্যবস্থায় গভীরে গেঁড়ে রয়েছে চরম আমলাতান্ত্রিক পরিচালন রীতি, দুর্নীতি ও দলতন্ত্র। সারা দেশের ছয় লক্ষাধিক গ্রামজুড়ে লক্ষ লক্ষ (একশ বত্রিশ মিলিয়ন) মানুষের অংশগ্রহণে হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার চলে এর মাধ্যমে। তার মধ্যে দুর্নীতি, জালিয়াতি, স্বজনপোষণ, দলতন্ত্র সবই বেশ গুরুতর মাত্রায় জড়িয়ে রয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে মূলত ক্ষমতাসীন শাসকদলের হাতেই রয়েছে নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। আর, যেসব রাজ্যে বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার সেখানে তো জবরদস্তি আরও বেশি। এসবের মূলোৎপাটন লাগাতার গণতদারকি ও গণআন্দোলনের দাবি জানায়। কিন্তু কোনও অর্থেই কেন্দ্র তথা কেন্দ্রের শাসকদলকে এর ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করতে দেওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সমবায় ব্যবস্থায় ‘নতুন দিন’ নিয়ে আসার ভূয়ো প্রতিশ্রুতি গেলাতে মোদী সরকারের ও আপন ঢাক পেটাচ্ছেন। বলছেন, তিনি নিজে গুজরাটে সমবায় দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে ‘সুদিন ও সুস্বাস্থ্য’ এনে দিয়েছেন! চোরের বাবার বড় গলা। খোদ স্বরাষ্ট্র মায় সমবায় মন্ত্রীপুত্র অবৈধ উপায়ে নিজ ব্যবসায় বাৎসরিক ছিয়াসী শতাংশ মুনাফা কামিয়ে উপরন্তু বিসিসিআই-এর শীর্ষাসনাসীন হয়েছেন। মন্ত্রীর নিজেরও রয়েছে গুজরাটের সমবায় পরিচালনায় জড়িয়ে দুর্নীতির কলঙ্ক। তাছাড়া যে সরকার কৃষি ও কৃষক বিরোধী নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছে, কৃষি ও কৃষক সমাজকে কর্পোরেটের গোলামে পরিণত করতে চাইছে, ন্যূনতম সরকারি সহায়ক মূল্য দিতে রাজী নয়, কৃষকদের দশ মাস যাবত পথে বসিয়ে রাখছে, ‘মানিটাইজেশনে’র নামে মুদ্রারাক্ষসের মতো দেশের একগুচ্ছ সম্পদ বেচে দিতে চাইছে কর্পোরেটদের কাছে; তার আবার প্রাথমিক কৃষি সমবায় নিয়ে ‘দরদ’ আসে কোথা থেকে! প্রকৃত উদ্দেশ্য হল সব অর্থেই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। তাই সমবায় নিয়ে কেন্দ্রের এত নতুন ঔৎসুক্য, বলাবাহুল্য বিজেপিরও।
২০২২’র প্রথম দিকেই উত্তর প্রদেশের নির্বাচন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই যোগী আদিত্যনাথের অপশাসনের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্তরের জনগণের সংগ্রামী ঐক্য ও সংকল্প ব্যাপক ও দৃঢ়তর হচ্ছে।
এই ঐক্য ও সংকল্পের সবচেয়ে উৎসাহজনক বহিঃপ্রকাশ নিঃসন্দেহে মুজাফ্ফরনগরের কৃষক মহাপঞ্চায়েত — যেখানে লাখে লাখে কৃষক যোগী-মোদী শাসনের বিরুদ্ধে যথার্থই এক রণহুঙ্কারে সমাবেশিত হয়েছিলেন। যে বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে উঠে আসে তা হল, কৃষকেরা কেবল তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বা হরিয়ানায় বিজেপি সরকার দ্বারা কৃষকদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এমনটা নয়; তাঁরা একই সাথে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের রাজনীতিকে নির্ধারকভাবে প্রত্যাখ্যানও করেছেন, যে রাজনীতি লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিম ইউপি’তে মোদী ও বিজেপিকে বিজয় হাসিল করতে সাহায্য করেছিল।
একদিকে কৃষকেরা যখন লড়াইয়ের রাস্তা দেখাচ্ছেন, শ্রমিকরাও তখন পিছিয়ে নেই। সরকারি কর্মচারি, শিক্ষক, অফিসার ও পেনশনারদের ১০০’র ওপর সংগঠন একসাথে এসে একটি ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গঠন করেছে। ইউপি’র যোগী আদিত্যনাথ নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছ থেকে তাঁরা লাগাতার যে লজ্জাজনক দুর্ব্যবহার পেয়ে আসছেন তার বিরুদ্ধে নিজেদের কথা আরও জোরালো ভাবে তুলে ধরতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন তাঁরা। তাঁরা ক্রুদ্ধ। কারণ সরকার সমস্ত কর্মচারি ও শিক্ষকদের মহার্ঘ্য ভাতা কেড়ে নিয়েছে, সব মিলিয়ে যার পরিমাণ ১০,০০০ কোটি টাকা; পরিবহন ভাতা সহ আরও অন্ততপক্ষে দশ ধরনের যেসব ভাতা কর্মচারিরা এতদিন পেয়ে আসছিলেন সেই সব ভাতা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। চুক্তি-শিক্ষকেরা এবং ‘শিক্ষা মিত্র’ শিক্ষকেরা এখন পাচ্ছেন সাকুল্যে ১০,০০০ টাকা প্রতি মাসে, আগে যা ছিল মাসে ৪৫,০০০ টাকা। এরফলে এক বড় সংখ্যক শিক্ষক বঞ্চনা ও হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন; সরকারি ফাণ্ড না পাওয়া স্কুলগুলির শিক্ষকেরা আর সাম্মানিক ভাতাটুকুও পাচ্ছেন না; এবং কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়গুলির ২,০০০’র বেশি শিক্ষক ছাঁটাই হয়ে গেছেন। বেসিক স্কুলগুলির অধ্যক্ষের পদ তুলে দেওয়া হয়েছে, শিক্ষকদের প্রমোশনের সুযোগ আর থাকছে না। আর, সর্বোপরি, বুনিয়াদি শিক্ষা দপ্তরের ১,৬০০’র বেশি শিক্ষক ও কর্মচারি কোভিড১৯’এর মধ্যে মারা গেছেন কারণ দ্বিতীয় ঢেউয়ের চুড়ান্ত সময়ে, অসুস্থতা সত্ত্বেও, তাঁদের নির্বাচনে ডিউটি করতে বাধ্য করা হয়।
উত্তরপ্রদেশের যুবরাও যোগী ও মোদী শাসনকে ক্ষমা করে দেওয়ার মেজাজে নেই আর। এই শাসনে ইউপি’তে ও সারা দেশে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ বেকারত্বের রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ছাত্র-যুব গ্রুপগুলি একত্রিত হয়ে ইউপি’র রাজধানী লক্ষ্নৌয়ে ‘কাজের অধিকার’ কনভেনশন সংগঠিত করেছে। তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়েছেন যে ২০১৬ থেকে ২০১৯’র মধ্যে বেকারত্বের জ্বালায় দেশে আত্মহত্যার হার ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)’র এই পরিসংখ্যান দেশে কোভিড১৯’এর ধাক্কা আসার আগের। একথা স্পষ্ট যে শেষ দু’বছরে এরকম আত্মহত্যার সংখ্যা অনেক বেড়েছে বৈ কমেনি। বেকারত্বের হার নাকি রাজ্যে ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছে — সিএম যোগীর এই মিথ্যাচারের দিকে আঙ্গুল তুলে ছাত্র-যুবরা দাবি করেছেন যে, কাজ হারানোর তথ্য পরিসংখ্যান নিয়ে এভাবে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া থেকে সরকার বিরত হোক এবং ইউপি’র জনতাকে বিপর্যস্ত করা এই কর্মহীনতার সংকটকে স্বীকার করুক। বিশেষত তাঁরা দাবি করেছেন যে বর্তমান সরকারি ফাঁকা পদগুলি পুরণ করতেই সরকার কেন ব্যর্থ হয়েছে, তার উত্তর আগে দিক সরকার। এই প্রশ্নে চূড়ান্ত দুর্নীতি চলছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘পুলিস গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যুরো’র সংকলিত এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে রাজ্য পুলিশের শূন্যপদের বিচারে দেশের মধ্যে এক নম্বরে আছে ইউপি (১,১১,৮৬৫ শূন্যপদ)।
দুর্নীতিকে একবিন্দু জায়গা না দেওয়ার যে দাবি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ করে থাকেন তা ভাঁড়ামোতে পরিণত হয়েছে। বেসিক এডুকেশন দপ্তরের মহাপরিচালকের একটি চিঠি উন্মোচিত করে দিয়েছে ৯ কোটি টাকার আর্থিক তছরুপের ঘটনা, যে অর্থ দলিত বালিকাদের কস্তুরবা বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য ধার্য তহবিল থেকে অপসারিত করা হয়েছে। দুর্নীতির আরেকটি ঘটনা সামনে এসেছে রাজা কিং জর্জ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিকে কেন্দ্র করে। সেখানে কোভিড১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত চিকিৎসা সরঞ্জাম অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক অনেক বেশি দামে কেনা হয়েছে। এমনকি বিজেপির বর্তমান এমএলএ’র পুত্রও অভিযোগ তুলেছেন যে যোগী আদিত্যনাথের শাসনে দুর্নীতি এক ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে।
অপরাধ দমন করার বিষয়ে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বড়াই করা তো আরও নিষ্ঠুর পরিহাস। আইন শৃঙ্খলা সম্পূর্ণতঃ ভেঙে পড়া, মুসলমানদের নিত্যদিন মবলিঞ্চিং-এর শিকার হওয়া আর রাজ্যজুড়ে ধর্ষণের রমরমার বিপ্রতীপে এই পরিহাস আরও প্রকট হয়ে ওঠে। হাথরাস গণধর্ষণ ও হত্যার একবছর পূর্ণ হয়ে গেল। প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে গভীর রাতে সেই দলিত মেয়েটির দেহ জোর করে জ্বালিয়ে দেওয়ার কাজে ধরা পড়েছিল ইউপি পুলিশ। ভিক্টিমের পরিবার এখনও ন্যূনতম বিচার পাননি, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ, চাকরি ও বাড়ির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কিছুই পাননি তাঁরা। এনসিআরবি’র হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে খুন, নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ ও দলিতদের ওপর নৃশংসতার তালিকায় ইউপি সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে; আর ধর্ষণের নিরিখে রাজস্থানের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন ইউপি পুলিশের ‘মিশন শক্তি’র ফলে ২০২০ সাল থেকে ইউপি’তে মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধ অনেক কমে গেছে। কিন্তু এটা ডাহা মিথ্যা। বাস্তবে, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের নির্দিষ্ট কিছু ক্যাটেগরির, মূলত ‘স্বামী বা আত্মীয়দের দ্বারা নিষ্ঠুরতার’ অভিযোগ, নথিভুক্ত হওয়া সারা দেশেই ২০২০ সালে কমেছে। এটা মোটেই বড়াই করার মত কোনও বিষয় নয়। বরং এটা একটা ব্যর্থতা। লকডাউনের মাঝে গাহর্স্থ্য হিংসার ঘটনা বেড়েছে, কিন্তু পুলিশের কাছে পৌঁছনো বা মহিলা সংগঠনগুলির সহযোগিতা পাওয়া লকডাউনের সময় মুশকিল হয়ে পড়ায় সেই হিংসার অভিযোগ নথিভুক্ত করা তুলনায় অনেক কম হয়েছে।
এনসিআরবি তথ্য পরিসংখ্যান নিশ্চিতভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে ভারতের সবচেয়ে অত্যাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসন হল যোগীরাজ, নৃশংস অগণতান্ত্রিক ইউএপিএ ও রাজদ্রোহ আইন প্রয়োগের নিরিখে ইউপি সর্বোচ্চ চারটি রাজ্যের মধ্যে পড়ে (অন্য তিনটি হল মনিপুর, আসাম ও ঝাড়খণ্ড) এবং ইউপি হল একমাত্র রাজ্য যেখানে কোনওরকম চলমান সশস্ত্র অভ্যুত্থানের গল্পও নেই বিপুল সংখ্যায় এই আইনগুলি প্রয়োগের বাহানা হিসেবে।
সংখ্যালঘু, মহিলা ও দলিতদের ওপর হিংস্রতার মাপকাঠিতে যোগী শাসন সবার থেকে আলাদা পরিচিতি পেয়ে গেছে, আইন কানুনের তোয়াক্কা না করা পুলিশ বাহিনী, ধর্ষকদের সুরক্ষা দেওয়ার তৎপরতা, কর্মহীনতায় ও অনাহারে মৃত্যু, কোভিড১৯ মোকাবিলায় সবচেয়ে খারাপ রেকর্ডে, যা গঙ্গায় ভেসে যাওয়া লাশের প্রবাহে সামনে আসে, বুনিয়াদি নাগরিক অধিকারের ওপর দমন পীড়নে। এই সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে সরকারের একমাত্র উত্তর আসে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ও হিংস্রতায়। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক ও যুবরা আশা জাগিয়েছে যে, ইউপি’র জনতা এই সাম্প্রদায়িক, দুর্নীতিগ্রস্ত, অপদার্থ ও অত্যাচারী অপশাসনের অবসান ঘটিয়ে যোগী আদিত্যনাথকে বিদায় করবে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২১ সেপ্টেম্বর '২১)
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন টিম আসামের দরং জেলার ধলপুরে কুখ্যাত উচ্ছেদক্রিয়া ও হত্যার স্থান পরিদর্শন করেছে। দলে ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য কবিতা কৃষ্ণান, বিহারের সিপিআই(এমএল) বিধায়ক রামবলি সিং যাদব, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং কর্ণাটক রাজ্য সম্পাদক ক্লিফটন ডি’রোজারিও, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং আসাম রাজ্য কমিটির সদস্য বলিন্দ্র সইকিয়া। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বিহারের যুবকর্মী রবি রঞ্জন, এআইকেএস নেতা জয়ন্ত গগৈ, জিপাল কৃষক শ্রমিক সংঘের নেতা প্রণব দোলে, সংগ্রামী কৃষক শ্রমিক সংঘের নেতা দীনেশ দাস এবং জহিরুল ইসলাম।
তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রাপ্ত তথ্য হল, মঈনুল হককে হত্যা করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে
(১) যে মুখ্যমন্ত্রী সাম্প্রদায়িক উচ্ছেদনীতির জন্য দায়ী এবং যার ভাই দরং-এর এসপি এই হত্যাকাণ্ড চালান, সেই মুখ্যমন্ত্রীকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে।
(২) পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া [(২০১৪) ১০ এসসিসি ৬৩৫] (পুলিশ এনকাউন্টার হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে) মামলায় ২৩-০৯-২০১৪ তারিখে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। মঈনুল হক এবং শেখ ফরিদের হত্যার বিষয়ে এফআইআর নিবন্ধন হওয়া উচিত। এই বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র তদন্ত অবশ্যই কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে অন্য থানার সিআইডি বা পুলিশ দল দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপাদান সহ ফরেনসিক এবং ব্যালিস্টিক বিশ্লেষণের দ্রব্যাদি/অস্ত্র সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে সমর্পণ করতে হবে।
(৩) গুলি চালানোয় ও অগ্নিসংযোগে জড়িত দরং-এর এসপি এবং পুলিশ কর্মীদের বরখাস্ত করতে হবে, গ্রেপ্তার করতে হবে এবং হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার চেষ্টাসহ উপযুক্ত সমস্ত অপরাধমূলক ধারায় অভিযুক্ত করতে হবে।
(৪) কোনো অজুহাতে দরিদ্রদের আর উচ্ছেদ করা যাবেনা। এর পরিবর্তে উচ্ছেদ করুন সেই সব অতি ধনী ব্যক্তিদের যারা বনভূমি অঞ্চলে রিসর্ট তৈরি করেছে, যেসব চা কোম্পানি চা বাগান স্থাপনের জন্য অবৈধভাবে ৬,৩৫৪ একর জমি দখল করেছে, যে সব শিল্পপতিরা আদিবাসীদের জমি জবরদখল করেছে এবং গুয়াহাটিতে সরকারি জমিতে যারা বিজেপি অফিস নির্মাণ করেছে।
(৫) সাম্প্রদায়িক প্রচার বন্ধ করুন, এসব দাবি করে মন্দিরগুলি ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ দ্বারা দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে দরং-এ মন্দিরটি এমন একটি এলাকায় বরাবর নিরাপদে আছে যেখানে প্রায় ৯৯% পরিবার মুসলমান। মন্দিরের হিন্দু তত্ত্বাবধায়ক পার্বতী দাসকেও ভূমি নীতির অধীনে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যদি সরকার পবিত্র স্থান (‘সাত্রগুলি’) সংরক্ষণের কথা বলে — তাহলে কেন সরকার বিমানবন্দরের কাছে জমি দখল অভিযানে ‘কৈটা সিদ্ধি সত্র’কে ধ্বংস করছে?
(৬) স্থানীয় জনগণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের ত্রাণ সাহায্য করছেন, কিন্তু সরকারকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে এবং চিকিৎসা শিবির, পানীয় জল, খাদ্য, আশ্রয় এবং স্বাস্থ্যবিধি সহ ত্রাণ সরবরাহ করতে হবে।
(৭) দরং-এ সব উচ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের তাঁদের জমিতে পুনঃস্থাপন করতে হবে এবং তাঁদের বাড়িগুলি পুনর্নির্মাণ করে দিতে হবে।
আসামে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশ জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বর কলকাতায় আসাম ভবনের সামনে বহু সংগঠনের কয়েকশ কর্মী ও অনেক স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণকারি সারা দিন ব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং ডেপুটেশন দেয়। একুশের ডাক প্রচারাভিযান, বন্দীমুক্তি কমিটি ও বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ মূল উদ্যোগ নেয়। নো এনআরসি মুভমেন্ট, জাতীয় বাংলা সম্মেলন, ফ্রেণ্ডস অব ডেমোক্রেসি, ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা ইত্যাদি মঞ্চ, আইসা, আইপোয়া, আরওয়াইএ, এআইআরডব্লিউও ইত্যাদি গণ সংগঠন, সহমন, ভাষা ও চেতনা সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ, নেহাই সাংস্কৃতিক মঞ্চ ইত্যাদি সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং স্বরাজ অভিযান ও পিএফআই সহ বিভিন্ন ধরণের গণরাজনৈতিক সংগঠনের আহ্বানে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত আসাম ভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্ল্যাকার্ড নিয়েও কমরেডরা উপস্থিত ছিলেন। একাধিক সংগঠন আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ায়। সমস্ত সংগঠনের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখা হয়। বন্দীমুক্তি কমিটির ছোটন দাস বিক্ষোভ সভা পরিচালনা করেন। একাধিক সংগঠন ডেপুটেশন আকারে দাবিগুলি তুলে ধরে। মূল দাবি ছিল আসামের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ, দরং এসপি'র গ্রেপ্তারি ও ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং উচ্ছেদ বন্ধ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। একই দিনে হুগলির ধনিয়াখালিতে পার্টি বিক্ষোভ দেখায়। সারা দেশে বিভিন্ন জায়গার সাথে সাথে দিল্লির যন্তরমন্তরেও পার্টি বিক্ষোভে সামিল হয়, সেখানে বক্তব্য রাখেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি আসামের নৃশংস এই গণহত্যাকে ‘ফ্যাসিবাদের উলঙ্গ নৃত্য’ বলে অভিহিত করে বলেন, এই ঘটনাকে এক চূড়ান্ত সতর্কতা সংকেত হিসেবে দেশের মানুষ গ্রহণ করুক ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্রিয় হোক।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নবনিযুক্ত রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ডাকা ভারত বনধে এ রাজ্যে ভালোই সাড়া পাওয়া গেল। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে কৃষক সংগঠনগুলোর ডাকা প্রথম এই রাজনৈতিক বনধে বিজেপি বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র-যুব-মহিলা ও নাগরিক সমাজ অভূতপূর্ব ভাবে এগিয়ে এসে তাকে সফল করে তুললেন।
দক্ষিণবঙ্গে বিভিন্ন জেলা ও শহরতলীতে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই বনধে সামিল হন, বেশ কিছু স্থানে রেল অবরোধ হয়। কৃষকেরা বনধে সামিল হয়ে রাজ্যের নানা জায়গায় মিছিল করে প্রায় ২৩-২৫ জায়গায় জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন, ধর্মতলায় পথ অবরোধ ও বেশ কিছু জেলায় ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসের স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হয়। কৃষি পণ্যের বাজারগুলোতে বনধ সর্বাত্মক হয়েছে।
মোদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের তীব্র ক্ষোভ এই বনধের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। বাংলার মানুষ যেভাবে কৃষকদের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে বনধকে সফল করলেন তার জন্য রাজ্যবাসীকে আমরা অভিনন্দন জানাই।
এই বনধের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের মানুষ তিনটি কৃষি আইন, চারটে শ্রম কোড, বিদ্যুত আইন সহ সেই সমস্ত জনবিরোধী আইনগুলোকে ছেঁড়া কাগজে পরিনত করলেন, অতিমারির সুযোগে মোদী যেগুলোকে গায়ের জোরে পাশ করায়। অবিলম্বে এই আইনগুলোকে খারিজ করতে হবে।
আগামী ২০২৪-র নির্বাচনে এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেই এর সমুচিত জবাব দিতে হবে।
২৮ সেপ্টেম্বর, গত বছর একই দিনে আইসার ডাকে, শহীদ-এ-আজম ভগৎ সিংহের জন্মবার্ষিকীতে, নতুন শিক্ষানীতি ২০২০’র বিরোধিতায় মিছিল কর্মসূচি হয়েছিল কলেজস্ট্রিট চত্ত্বরে। এবছর, ওই দিনই, ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের ভ্যাক্সিনেশনের দাবিতে এবং হোস্টেল-ল্যাব-লাইব্রেরী সহ কোভিড বিধি মেনে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবিতে কলেজস্ট্রিটে মিছিল করে গিয়ে, পুলিশের চোখে চোখ রেখে ১৪৪ ধারা অমান্য করে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাস্তা অবরোধ করে, বৃষ্টি বিঘ্নিত দিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন-মঞ্চ-পত্রিকা-ইউনিয়নের ডাকে কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।
এই কনভেনশন বিভিন্ন দিক থেকেই ছিল নতুন ও অভিনব। এত ধরনের ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং আরও বহু ধরনের সংগঠনের সাথে হাত মেলানো এক নতুন প্রসারমান ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-যুব আন্দোলনের নয়া সূচনা বলা চলে। আইসা যাদবপুর ইউনিট এই লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। অন্যদিকে, রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে প্রায় তিন ঘন্টা চলা এই কনভেনশন ছাত্রছাত্রীদের দৃঢ় ও সাহসী সঙ্কল্পের জোরালো বার্তা দিয়েছে সরকারকে।
কনভেনশনে আইসা-র পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট সভাপতি রুদ্র প্রভাকর দাস এবং কলকাতা জেলা সম্পাদক সৌমেন্দু মিত্র, যাদবপুর আর্টস ফ্যাকাল্টি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শুভায়ন, এবিপিটিএ-র পক্ষ থেকে পিনাখ রায়, এআইডিএসও-র পক্ষ থেকে সৌপ্তিক, মিহির রায়চৌধুরী স্মারক লাইব্রেরির পক্ষ থেকে অত্রি, পিএসইউ-র পক্ষ থেকে দেবজ্যোতি, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অদ্রিজা, বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে রণজয়, রিফ্র্যাকশান পত্রিকার পক্ষ থেকে দেবার্ঘ্য, আরএসএফ’র তরফে অয়ন, আনলক ক্যাম্পাস প্রচারের পক্ষ থেকে তথাগত, শহীদ প্রশান্ত পাল পাঠশালার তরফে সায়ন্তন, স্কীম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শীলা দে, শিক্ষক ঐক্য যুক্ত মঞ্চের তরফে ছবি চাকী, সনজিৎ মুর্মু পাঠশালার তরফে প্রতাপ, এসএফয়াই-এর কলকাতা জেলা সম্পাদক আতিফ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় লোকালের পক্ষ থেকে শুভদীপ ও রাজ্য কমিটি সদস্য শিল্পী। কনভেনশন পরিচালনা করে আইসার বর্ষা বড়াল ও এসএফআই-এর ইমরাজ।
আগের বছর অতিমারীর সময় পার্লামেন্টকে বন্ধ রেখে, ছাত্রছাত্রী-অভিভাবক-শিক্ষকদের সাথে কোনো রকম আলোচনা না করে যে নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে এসেছিল কেন্দ্রীয় সরকার, তারই নীল নকসা রূপায়িত হচ্ছে। শুধু আমাদের নিজেদের ক্যাম্পাস বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নয়, পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বন্ধ করে রেখে কেন্দ্রের ছক রূপায়িত হচ্ছে। গ্রামীণ ক্ষেত্রে প্রাইমারি শিক্ষায় প্রায় ৬০% পড়ুয়া একটা বা দুটোর বেশি অক্ষর চিনতে পারছে না। তাদের দোষ না, দীর্ঘদিন শিক্ষার পরিসর থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়ে এবং অনলাইন ক্লাসের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। গ্রামীণ এলাকায় ৪৬% ছাত্রছাত্রী গত এক, দেড় বছরে শিক্ষকের মুখই দেখেনি। এই লড়াই যতটা প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকা পড়ুয়াদের, তেমনই শিক্ষক-কর্মচারী সহ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে জীবনযাত্রা অতিবাহিত করে যে মানুষগুলো তাদের প্রত্যেকের। আগামী দিনে আমাদের দাবি না মানা হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যেতে পিছপা হবো না, এমনই ডাক উঠে আসে কনভেনশন থেকে।
- দীপায়ন
১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের ডাকে ২৪ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী পালিত হল আশা, অঙ্গনওয়ারী, মিড-ডে-মিল সহ প্রকল্প কর্মীদের ধর্মঘট।
আহ্বায়কদের অন্যতম এআইসিসিটিইউ পরিচালিত সারা ভারত প্রকল্প কর্মী ফেডারেশন (এআইএসডব্লিউএফ) ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগর শাখার কর্মীরা বিক্ষোভ ও ডেপুটেশনে সামিল হন। এই কর্মসূচি থেকে প্রকল্প কর্মীদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি, ন্যূনতম মজুরি, ভবিষ্যত সুরক্ষার নানা দাবিতে ধর্মঘট চলছে বলে ঘোষণা করা হয়। বিজেপি সরকারের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জনমুখী পরিষেবাগুলিতে মহিলাদের বেগার খাটানোর এবং বর্তমানে সেটাও তুলে দেবার নানা অপচেষ্টা প্রতিহত করার ডাক দেওয়া হয়। এক প্রতিনিধিদল স্থানীয় পৌরসভায় দাবিগুলো নিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করে।
ফেডারেশনের রাজ্যনেত্রী জয়শ্রী দাস ঐ দাবিগুলি নিয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির ডাকা ভারত বন্ধে কর্মীরা সামিল হবেন বলে জানান।
সোনারপুর থানার একদল পুলিশ কর্তা ও সিভিক ভলান্টিয়ার বাহিনী মবলিঞ্চিং চালালো বেনিয়া বৌ গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর। কোনো এক হোসেন আলি নামক আসামীকে ধরতে আসার নাম করে অন্য এক থানার (অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগণা) পুলিশ কনস্টেবল সুরাফ হোসেনের (বেনিয়া বৌ গ্রামে তাঁর বসত বাড়ি) সঙ্গে অনাবশ্যক বচসা বাধিয়ে তাঁর ওপর সিভিল পোশাকে মদ্যপ অবস্থায় চড়াও হয় এসআই সোমনাথ দাস। পুলিশরা ছিল সাদা পোশাকে, সিভিকরা ছিল পুলিশের পোশাকে চটি পায়ে। বাড়ি ও এলাকার লোকজন ছাড়াতে এলে সোমনাথ দাস ফোন করে থানা থেকে বাহিনী ডেকে আনে। প্রি-ইন্সপেক্টর প্রিয়া সেনের নেতৃত্বে বাহিনী লাঠিচার্জ করে বহু মানুষকে আহত করে সরিয়ে দেয়। তারপর গোটা বাহিনীর সবাই মিলে সুরাফকে পাশের খেলার মাঠে প্রকাশ্যে উলঙ্গ করে প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে পাশবিক অত্যাচার চালায়। ঘৃণাপূর্ণ সাম্প্রদায়িক গালাগালি করে। সুরাফ অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে আবার মার শুরু হয় থার্ড ডিগ্রির স্তরে। তাঁর পরিবারের লোকজন বাধা দিতে এলে তাঁদেরকেও পেটানো হয়। তাঁর অন্তঃসত্বা স্ত্রী তানিয়া পারভীনকে পুলিশ ধাক্কা মেরে বাড়ির সিঁড়িতে ফেলে দিলে, সেই আঘাতে তাঁর গর্ভ নষ্ট হয়। প্রকাশ্যেই সুরাফের ওপর যৌন নির্যাতন চালায় উন্মত্ত প্রিয়া সেন নিজে। সুরাফের কন্যাকে চড় মেরে তার স্কুলের ক্লাস করার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয় পুলিশ। সুরাফের হাতের আঙ্গুল প্রিয়া সেন জুতো দিয়ে থেঁতলে দেয়, যৌনাঙ্গে ক্ষত সৃষ্টি করে। তারপর তাঁকে মারতে মারতে গরুর দড়ি দিয়ে পশুর মতো বেঁধে গাড়ীতে তুলে থানায় নিয়ে যায় বাড়ির লোকজন সহ। তাঁদের বিরুদ্ধেই সরকারি কাজে বাধাদান সহ অনেক কঠিন কেস দেওয়া হয়। ঐদিন প্রকাশ্যে নিরপরাধ মানুষকে পুলিশের থার্ড ডিগ্রী নির্যাতনের সাক্ষী থাকলেন ঐ গ্রামের আমজনতা।
সুরাফ হোসেন একজন জাতীয়স্তরের প্রতিভাবান ফুটবল। মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একদা খেলোয়াড়, আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচ অনেকবার খেলেছেন। গুড কন্ডাক্টের কারণে মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে রাজ্যস্তরের পুলিশ বিভাগের পুরস্কারও পেয়ছেন। এমন মানুষের প্রাণনাশের সম্ভাবনা ছিল সেদিন ঐ অত্যাচারে।
খবর পেয়ে আমাদের পার্টির পক্ষে চারজনের এক প্রতিনিধি দল বেনিয়া বৌ গ্রামে গিয়ে সুরাফ ও তাঁর পরিবারের সাথে দেখা করে। আরও অন্যান্য কিছু সংগঠন, এপিডিআর, সেভ ডেমোক্রেসি, বন্দীমুক্তি কমিটি, জামাতে উলেমা-এ হিন্দ্ নিজেদের স্বাধীন উদ্যোগে ঐ গ্রামে আক্রান্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিলেন, তাঁরা পরস্পর যোগাযোগ করে ২১ আগষ্ট সোনারপুর থানা ঘেরাও করেন। থানা গেটে বিক্ষোভসভা চলে, ভেতরে চলে ডেপুটেশন। একুশের ডাক, ছাত্রসংগঠন আইসা প্রভৃতি কয়েকটি সংগঠনের যৌথ প্রতিনিধিদল ভেতরে যান। সেকেন্ড অফিসার ডেপুটেশন গ্রহণ করার সময় ঘটনাটিকে অনভিপ্রেত বলে স্বীকার করেন এবং আইনী পথে বিচারের রায়কে স্বাগত জানাবেন বলেন। কিন্তু কেস তারা তুলতে নারাজ। অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ তারা বজায় রাখল। দ্রুততার সাথে মুখ্যমন্ত্রী, মানবাধিকার কমিশন সহ প্রশাসনের সমস্ত প্রাসঙ্গিক স্থানে সুরাফ ও তানিয়ার পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়।
গণমাধ্যমগুলির নিশ্চুপতা লক্ষনীয়। উল্টে ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় জেলবন্দী থাকায় সুরাফ হোসেন নিজেই অশোকনগর থানার চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে আছেন নিয়মানুযায়ী। যদিও অশোকনগর থানা জানিয়েছে তাঁরা বিষয়টিতে সুরাফ হোসেনের পক্ষেই থাকবেন ও তাঁকে নিয়মিতকরণের চেষ্টা চালাবেন।
এরমধ্যে বেনিয়া বৌ গ্রামে বিভিন্ন সংগঠন যৌথভাবে গ্রামে একাধিক সভা, ঘরোয়া পরিকল্পনা মিটিং, হ্যান্ডবিল প্রচার, মাইক প্রচার, পোস্টারিং, সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচার ইত্যাদি নানা কর্মসূচি নেওয়া চলছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর, বারুইপুরে বড় জমায়েত ও মিছিল করে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলাশাসকের কাছে বিক্ষোভ-ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনরকমের সদর্থক সরকারি পদক্ষেপের ইঙ্গিত মেলেনি।
পশ্চিমবঙ্গকে উত্তরপ্রদেশ হতে দেওয়া যাবেনা। আমলা-প্রশাসনের মাধ্যমে বাংলায় আরএসএসের অনুপ্রবেশের অপচেষ্টাকে নির্মূল করতে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে জোট বাঁধতে হবে। যেখানেই অত্যাচার সেখানেই প্রতিরোধ, এই হোক আজকের এধরণের ঘটনাবলীতে মানুষের মূলমন্ত্র।
- নবকুমার বিশ্বাস
২১ সেপ্টেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলায় বহরমপুরে ১১টি ব্লক থেকে আসা বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে কর্মী সভা হয়। প্রায় একশোর মতো শ্রমিকরা উপস্থিত ছিলেন, যাদের ৯০ শতাংশই নারী শ্রমিক। এর মধ্যে বেশিরভাগই মুসলিম সম্প্রদায় থেকে আসা। উপস্থিত ছিলেন বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের রাজ্য সভাপতি, সম্পাদিকা এবং সহ সম্পাদক ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক এবং ইনচার্জ সহ বেশ কয়েকজন কমরেড।
বিড়ি শ্রমিকদের প্রতি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বঞ্চনার বিরুদ্ধে, এবং সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি, পরিচয় পত্র, সামাজিক সুরক্ষার সমস্ত অধিকারের দাবিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
শুধু বিড়ি শ্রমিকেরাই নয়, কিভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত সমস্ত শ্রমিকরা, ক্ষেতে-খামারে কর্মরত কৃষকরা এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের শিকার হচ্ছেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সর্বোপরি ২৭ সেপ্টেম্বরের বনধের প্রচারে কিভাবে বিড়ি শ্রমিকেরা তাদের দাবিগুলিও তুলে ধরবেন তা নিয়েও বক্তব্য উঠে আসে। বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে বনধের লিফলেট ও এআইসিসিটিইউ'র পোস্টার ব্লকগুলিতে লাগানোর জন্য দেওয়া হয়।
সবশেষে, ২১ জনকে নিয়ে জেলা কার্যকরি কমিটি গঠিত হয়। এর মধ্য থেকে অফিস বেয়ারার্স গঠন ১০ জনকে নিয়ে। সভাপতি আবুল কাশেম, সহ সভাপতি গুলশন বেগম, সনেহা বেগম, টুলু বালা দাস; যুগ্ম সম্পাদক জিল্লাল রহমান ও দিপালী মন্ডল, সহ সম্পাদক লুৎফা বেগম, চায়না চক্রবর্ত্তী, আসরাফুল আলম সরকার; কোষাধ্যক্ষ মানাউল্লা। আগামী ডিসেম্বরে জেলা কমিটির বৈঠক করা ও সেই বৈঠকে সমস্ত সদস্য জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
মানবাধিকার কমিশনগুলোর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে আর সেগুলো গঠিত হওয়ার পিছনে মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে নিরস্ত করার ব্যাকুলতা কাজ করেছিল বলে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। বিভিন্ন রাজ্যের জনগণের বিদ্রোহ দমনে সেনা বাহিনী ও পুলিশদের বাড়াবাড়ি এমন মাত্রা নিয়েছিল, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এতটাই তীব্র হয়েছিল যে নানান মহল থেকেই তার প্রশমনের আর্জি গুরুত্ব সহকারে উঠে আসছিল। মনদীপ তিওয়ানা তাঁর “প্রয়োজন: ভারতে অধিকতর কার্যকরী মানবাধিকার কমিশনগুলি” নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “পাঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের বৃদ্ধি হচ্ছিল ১৯৮০’র দশক থেকে শুরু হয়ে ১৯৯০’র দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত এবং সরকার কঠোর হাতে এর মোকাবিলা করছিল। সংবাদমাধ্যম, নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো এবং সাধারণ জনগণ বিদ্রোহ মোকাবিলায় পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর পদক্ষেপ এবং সরকারের মধ্যে চলা শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন — জাতীয় নিরাপত্তার নামে বুনিয়াদি মানবাধিকারকে উপেক্ষা করা হচ্ছিল।…
এই পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয় মানবাধিকার রক্ষা আইন, ১৯৯৩ যা দিল্লীতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং চোদ্দটা রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠাকে সম্ভব করে তোলে।…” এরথেকে অতএব প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়াটাই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষে বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি এর বিপরীতটাই ঘটতে দেখা গেল — জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিশানা বানালো সরকারের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক আন্দোলনকে। কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি কৃষক স্বার্থ বিরোধী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের আন্দোলন চলছে দশ মাসেরও বেশি সময় ধরে। সরকার কৃষকদের দাবিকে, তাদের সঙ্গে আলোচনা জারি রাখাকে গুরুত্বদানের বিষয় বলে মনে করেনি। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে অব্যাহত রাখতে বেশ কয়েকশ কৃষক প্রাণও দিয়েছেন। মানবাধিকার কমিশনের কাছে এসব বিচার্য হয়নি, সে বরং ব্যস্ত হয়ে পড়ল শিল্প ও পরিবহণের ওপর এই আন্দোলনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে, আন্দোলনের ফলে নিত্যযাত্রী, রোগী বয়স্ক মানুষদের কি অসুবিধা হচ্ছে তার বিচারে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দিল্লীতে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানায়, “শিল্প সংস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়া নিয়ে অভিযোগ এসেছে, ৯,০০০’র বেশি অতি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় কোম্পানি গুরুতর রূপে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই অভিযোগও এসেছে যে, পরিবহণের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যারফলে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হওয়ায় নিত্যযাত্রী, রোগী, প্রতিবন্ধী মানুষ ও বয়স্ক নাগরিকরা অসুবিধায় পড়ছেন।” এই সমস্ত অসুবিধায় মানুষ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে কমিশন যেহেতু মনে করছে, কমিশন তাই কেন্দ্র এবং দিল্লী, রাজস্থান, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে নোটিস পাঠিয়েছে রিপোর্ট দেওয়ার জন্যে — এই সমস্ত অসুবিধা দূর করতে কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা জানিয়ে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ এবং স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রককেও নোটিস পাঠিয়েছে বিক্ষোভস্থলে কৃষকরা কোভিড বিধি মানছে কি না তা নিয়ে রিপোর্ট পাঠাতে। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিল্লী স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্ককেও কমিশন অনুরোধ করেছে, তারা যেন সমীক্ষা চালিয়ে জীবন, জীবিকা এবং বয়স্ক ও দুর্বল মানুষদের ওপর কৃষক আন্দোলনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে রিপোর্ট পাঠায়। কৃষক আন্দোলনের ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে এত ধরনের রিপোর্ট মানবাধিকার কমিশন চেয়েছে যাতে মনে হয় যে, সমালোনামূলক রিপোর্টের ভারে কৃষক আন্দোলনকে কলঙ্কিত করাই তার অভিপ্রায়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কি সত্যিকারের মানবাধিকারের ইস্যু খুঁজে পাচ্ছেনা বলেই তাদের কৃষক আন্দোলনে মাথা গলাতে হল, কৃষক আন্দোলনের ফলে সাধারণ মানুষের কত ক্ষতি হচ্ছে তার বিচারে নামতে হল? ভারতে আজ মানবাধিকার যাতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হচ্ছে তা হল সরকারের পক্ষে সরকার বিরোধিতাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বলে গণ্য করা। সমাজ আন্দোলনের কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, এমনকি সাংবাদিকরাও সরকারের সমালোচনা করলে তাদের জেলে পোরা হচ্ছে, তারা এমনকি দৈহিক আক্রমণেরও শিকার হচ্ছেন। পুলিশি নৃশংসতার নিদর্শনও কম দেখা যায়না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই এবছরেরই আগস্ট মাসে লোকসভায় জানিয়েছেন — গত তিন বছরে ভারতে পুলিশি হেফাজতে মারা গেছে ৩৪৮ জন, আর বিচারবিভাগীয় হেফাজতে মারা গেছে ৫,২২১ জন। হেফাজতে পুলিশি পৈশাচিকতার এবং জেলের কয়েদিরা কি অবস্থায় থাকে তার বিবেচনা কি মানবাধিকারের আওতায় পড়ে না? সংখ্যালঘু, দলিত এবং সমাজের প্রান্তিক অংশের মানুষরা আজ রাষ্ট্র এবং আধিপত্যকারী সম্প্রদায়গুলোর কাছ থেকে ক্রমেই বেশি বেশি আক্রমণের মুখে পড়ছে। মবলিঞ্চিং বা গণপিটুনি সংখ্যালঘু এবং দলিতদের কাছে নিপীড়নের এক বিশেষ পরিঘটনা রূপে হাজির হয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সামনে আজ বিপুল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিরোধী মতের প্রতি মর্যাদাদানে সরকারের অসম্মতি। কাশ্মীরের জনগণের মানবাধিকার আজ কোন অবস্থায়? গত ১৭ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কেউ প্রশ্ন কোরো না’ নিবন্ধে তাপস সিংহ উল্লেখ করেছেন, “নাগরিক সমাজের ওপর যে কোনো অত্যাচার, বাড়াবাড়ি, নিরাপত্তার নামে তুলে নিয়ে গিয়ে হেফাজতে রেখে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, হাজার হাজার যুবক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক, সমাজকর্মীকে জেলে পুরে দেওয়া, যে কোনো বিরুদ্ধ স্বর স্তব্ধ করে দেওয়া, মিডিয়ার কণ্ঠ রোধ করা — এসবই কাশ্মীরে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা।” হস্তক্ষেপের জন্য এই পরিস্থিতি কি মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবশ্যকীয় নয়?
মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান অরুণ মিশ্র সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন এবং মোদী সরকারের পক্ষে ও আদানির মতো পুঁজিপতিদের অনুকূলে রায় দেওয়ার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিচারপতি লোয়ার রহস্যজনক মৃত্যুতে তদন্তের অনুমতি দেওয়ার আবেদন ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে সংবেদনশীল মামলা, কেননা, সেই মামলায় জড়িয়ে ছিল অমিত শাহর নাম। সেই মামলা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র অরুণ মিশ্রর বেঞ্চে ফেলায় ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি চার বিচারপতি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। যে প্রশ্নটা আজ সচেতন নাগরিকদের মনে নাড়া দিচ্ছে তা হল — জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও কি সিবিআই, ইডি, আয়কর দপ্তরের মত এমন একটা সংস্থায় পরিণত হচ্ছে যেটাকে নরেন্দ্র মোদীরা নিজেদের স্বার্থে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে তাকে লেলিয়ে দিতে পারবেন?
কৃষক আন্দোলন দশ মাস ধরে অব্যাহত থাকায় কিছু মানুষের কিছু অসুবিধা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা কৃষকদের আন্দোলনের পথে এনেছে তার তাৎপর্যও সুবিপুল। জমি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার, কর্পোরেটদের ক্রীতদাসে পরিণত হওয়ার মহাসংকটের মুখে কৃষকদের অস্তিত্ব। মানবাধিকার কমিশন যাদের কাছে নোটিস পাঠিয়েছে, তাদের রিপোর্ট পেয়ে হয়ত কৃষকদের কিছু বদনাম করা যাবে, তাদের আন্দোলনে মানুষের কত কষ্ট হচ্ছে তা নিয়ে কিছু বলার সুযোগ নরেন্দ্র মোদীদের হাতে পৌঁছবে। তাতে কি কৃষক আন্দোলনের সমর্থন ভিত্তিতে ফাটল ধরানো যাবে? এটা হলফ করে বলাই যায় যে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পদক্ষেপে কৃষক আন্দোলন একটুও দমে যাবে না। অনেক চেষ্টা করেও নরেন্দ্র মোদী সরকার কৃষক আন্দোলনকে পিছু হঠাতে পারেনি। যত দিন গেছে কৃষকরা কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনকে আরো তীব্র করে তুলতে উৎসাহিত হয়েছেন — বিজেপিকে জোরালো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন। কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন তাদের কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। হরিয়ানায় কৃষকদের বিরুদ্ধে এক বছরে ১৪০টা এফআইআর করে ভারতীয় দণ্ডবিধির অধীনে গুরুতর অভিযোগ এনে এবং তাদের রক্ত ঝড়ানোর পরও হরিয়ানার বিজেপি সরকারকে কৃষকদের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে। কৃষক আন্দোলন যে কৃষকদের অস্তিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত সে কথা বিজেপি নেতারাও স্বীকার না করে পারছেন না। নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন এমন এক বিজেপি নেতা চৌধরী বীরেন্দর সিং কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন — “আন্দোলন যে প্রাণবন্ত রয়েছে তার পিছনে কারণ এই নয় যে কোনো বড় নেতা বা রাজনৈতিক দল এটাকে পরিচালিত করছে। মূল কারণ হল এই আশঙ্কা যে, এই কৃষি আইনগুলো রূপায়িত হলে তারা ভূমিহীন হয়ে পড়বে। এটাই আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করে তুলছে এবং কোনো কথাই তাদের আশঙ্কাকে মুছে দিতে পারবে না।” জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কি কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে সে সম্পর্কে নিজের ধারণায় পরিবর্তন আনবেন?
- জয়দীপ মিত্র
* আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী কৃষকদের ও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে এবং কৃষিকাজকে যথাযথভাবে সুরক্ষিত করতে রাজ্য সরকার বাধ্য। জীবন যাপনের অধিকারকে বাস্তবায়িত করা ও জীবিকার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নীতি নির্ধারণ এবং উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও লাগু করে কৃষকদের দুর্দশা রোধ করাও রাজ্য সরকারের সাংবিধানিক কর্তব্য।
* জাতীয় কৃষি কমিশন লাভজনক মূল্যের যে নীতি সুপারিশ করেছে যাতে পরিষ্কার বলা আছে যে সব খরচ ধরে উৎপাদন ব্যয়ের সাথে কমপক্ষে তার ৫০ শতাংশ যোগ করে ফসলের ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করতে হবে।
* কৃষিক্ষেত্রের দুরবস্থা দূর করতে ও সাংবিধানিক কর্তব্য পালন তথা জাতীয় কৃষি কমিশনের সুপারিশকে বাস্তবায়িত করতে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত কৃষককের অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে।
* কৃষক, অর্থাৎ যারা নিজ মালিকানার জমিতে বা অন্যের জমিতে অর্থনৈতিক কারণে এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষি কার্যকলাপে নিযুক্ত এবং ফসল উৎপাদন বা অন্যান্য প্রাথমিক কৃষি উৎপাদন করেন এবং কৃষিকাজের যে কোন ধারায় কাজ করছে এমন ব্যাক্তি, চাষী, কৃষি শ্রমিক, ভাগচাষী, জমি লিজ নিয়ে চাষ করা ব্যাক্তি, হাঁস-মুরগি ও পশুপালনকারী, মৎস্যজীবী, মৌমাছি পালনকারী, পশু চারণকারী, কর্পোরেট নয় এমন বাগান জোতমালিক এবং বাগিচা শ্রমিক, বনজ উৎপাদন সংগ্রহকারী, মহিলা কৃষক, সম্মিলিতভাবে চাষ করছে এমন কৃষক গোষ্ঠী, উৎপাদনকারী সমবায়, স্বনির্ভর গোষ্ঠী ইত্যাদি।
* সমস্ত কৃষিজাত উৎপাদন অর্থাৎ সমস্ত রকম শস্য, সমস্ত জোয়ার জাতীয় পণ্য, সমস্ত রকম ডাল, তৈলবীজ, সমস্ত রকম ফাইবার ফসল, ফল ও সবজি, বাগানজাত ফসল, সমস্ত মসলা ফসল, কন্দ ফসল, ওষধি গাছ, সব ধরনের দুধ, ক্ষুদ্র বনজ উৎপাদন, ফুলের চাষ, ঘাস, পশুখাদ্য ঘাস ও গাছের উৎপাদন, নার্সারি উৎপাদন, সমস্ত বাগিচা উৎপাদন, সমস্ত গবাদি পশু এবং পশুজাত দ্রব্য যেমন মাংস, ডিম এবং পোলট্রি, গেঁড়ি-গুগলি ঝিনুক, সামুদ্রিক মাছ সহ সমস্ত মৎস্যজাত উৎপাদন, মিষ্টি জলের জলজ উৎপাদন, মধু, রেশম গুটিপোকা এবং অন্যান্য সমস্ত প্রাথমিক কৃষিজাত উৎপাদন ও তার সহজাত দ্রব্যগুলি।
সামগ্রিক উৎপাদন ব্যয় নির্ধারিত হবে নিম্নলিখিত দিকগুলিকে ধরে।
• মজুর ভাড়া — পশু ও কৃষি যন্ত্রপাতিসহ,
• পশু ও কৃষি যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ,
• কৃষি উপকরণের খরচ, যথা বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ইত্যাদি,
• জমির খাজনা ও কর বাবদ খরচ,
• জমির ভাড়া বাবদ খরচ,
• ঋণের সুদ বাবদ খরচ,
• শস্যবীমার প্রিমিয়াম বাবদ খরচ,
• শস্য প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের খরচ,
• পারিবারিক শ্রমের মজুরি সহ অন্যান্য দিকগুলি।
* সরকার গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে পর্যাপ্ত সংখ্যায় ফসল ক্রয়কেন্দ্র তৈরি করবে। তাৎক্ষণিক ভাবে এবং ফসল ক্রয় করার দিনই নগদে দাম পরিশোধ করতে হবে। ফসল কেনা সম্পর্কে এলাকায় আগাম পর্যাপ্ত মাত্রায় প্রচার করতে হবে।
* ফসলের অভাবী বিক্রি রোধ করতে কার্যকরি ব্যবস্থা রাখতে হবে। এজন্য ভর্তুকি দিয়ে স্বল্প খরচে ফসল সংরক্ষণ তথা হিমঘরের ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
* সরকারকে যথেষ্ট পরিমাণে তহবিল গঠন করতে হবে যাতে করে কৃষকদের ফসল কেনার গ্যারান্টি সুনিশ্চিত করা যায়।
* সরকারকে চাষের খরচ কমানোর জন্য ভর্তুকি দিয়ে সার, বীজ, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, ডিজেল গরিব চাষীদের সরবরাহ করতে হবে।
* সরকারকে ব্লক স্তরে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে যারা চাষীর ফসলের দাম কমে যাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে নজরদারী রাখবে। কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হলে যে পরিমাণে দাম কম পেয়েছে, চাষীকে তার দেড়গুণ দাম ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেবে। এটা অগ্রাহ্য করলে সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসার এক মাসের বেতনের সমপরিমান অর্থ জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবেন। অন্যথায় ৬ মাস পর্যন্ত কারাবাসের শাস্তি ভোগ করবেন।
* সরকারি সংস্থা বা ব্যবসায়ীদের কাছে ফসল বিক্রি করে তার দাম না পেলে চাষী ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য অর্থের ১৫ শতাংশ বেশি পাবে।
* প্রতিটি ব্লকে তিন সদস্যর অভিযোগ নিস্পত্তি কমিটি গঠিত হবে। যাতে থাকবেন ব্লক স্তরের কৃষি দপ্তর ও কৃষি বিপণন দপ্তরের একজন করে সরকারি আধিকারিক এবং কৃষকদের উপযুক্ত প্রতিনিধি। এই কমিটি অভিযোগ পাওয়ার একমাসের মধ্যে সেটা নিস্পত্তি করতে বাধ্য থাকবে। এজন্য ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করতে হবে।
এআইকেএসসিসি দাবি জানিয়েছে অবিলম্বে রাজ্যের সমস্ত কৃষকদের সমস্ত ধরনের ফসলের জন্য ঐ আইন বিধানসভায় পাশ করিয়ে দ্রুত রাজ্যে চালু করতে হবে। অন্যথায় রাজ্যে কৃষকরা জোরালো আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে।
করোনাভাইরাসের অভিঘাত এড়াতে গত বছর লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর দেশে নানা প্রান্তে দেখা গিয়েছিল একই ছবি। রাস্তায় হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। পুরুষদের পাশাপাশি সেই দলে রয়েছেন বিপুল সংখ্যক মহিলাও। কর্মক্ষেত্র ছেড়ে তাঁরা হেঁটে চলেছেন বাড়ির পথে।
সেই ছবি যে জাতীয় অর্থনীতিতে কী ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, তার আঁচ এবার পাওয়া গেল বেকারত্বের হিসেবে। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, লকডাউন ঘোষণার পরে এপ্রিল থেকে জুন মাসে মহিলাদের শ্রম-অংশীদারিত্ব ১৫.৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। যা ভারতের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। প্রতিবেশি বাংলাদেশে এই হার ৩০.৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় ৩৩.৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া অন্য একটি হিসেব অবশ্য বলছে, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে মহিলা শ্রমিকদের কাজ হারানোর ঘটনা ক্রমশ বেড়েছে। ২০০৫ সালে মনমোহন সিংহ সরকারের জমানায় মহিলা শ্রমিক ছিলেন ২৬ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির আগেই ২০১৯ সালে তা নেমে আসে ২০.৩ শতাংশে।
গত বছর আনলক পরিস্থিতিতেও মহিলা শ্রমিকদের হালের তেমন বদল হয়নি। কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য জানাচ্ছে, গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন বহু মহিলা শ্রমিক। ফলে মহিলা শ্রমিকদের অংশীদারিত্ব নেমে এসেছে ১৬.১ শতাংশে। ওই সময় কাজ হারিয়েছেন প্রায় ১৫.৮ শতাংশ মহিলা শ্রমিক। পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে কাজ হারানোর হার ছিল ১২.৬ শতাংশ।
- এই সময়, ৩ আগস্ট ২০২১
পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর প্রশ্নে শীর্ষস্থানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের রাজ্য গুজরাত।
জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড বুরোর ২০২০ সালের রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, গত এক বছরে দেশে পুলিশ হেফাজতে ৭৬ জন মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর তালিকায় রাজ্যগুলির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে গুজরাত। ওই রাজ্যে গত এক বছরে ১৫ জন ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে মারা গিয়েছে। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ (৮ জন)। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ২০২০ সালে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা হল ২। রিপোর্ট বলছে, গুজরাতে পুলিশ হেফাজতে যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। আরও ছ’জন মারা গিয়েছেন অসুস্থতার কারণে বা চিকিৎসা চলাকালীন। বাকি তিন জনের মধ্যে দু’জনের মৃত্যুর কারণ গ্রেফতারির আগে পাওয়া আঘাত ও এক জনের মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। যদিও অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বক্তব্য, যাঁদের মৃত্যু আত্মহত্যা বলে চালানো হচ্ছে তাঁদের অনেকের মৃত্যু সন্দেহজনক। যা গুজরাত পুলিশই নয়, দেশের সব রাজ্যের পুলিশের জন্য প্রযোজ্য। পশ্চিমবঙ্গে যে দু’জন মারা গিয়েছেন, তাঁদের এক জন পুলিশ হেফাজতে ও অন্যজন গ্রেফতারির পরে চিকিৎসা চলাকালীন মারা গিয়েছেন।
রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক বছরে পুলিশের গুলি, লাঠিচার্জে দেশে ৪৭ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। যা তার আগের বছরের চেয়ে ৩১ জন কম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি নাগরিকের মৃত্যু জম্মু-কাশ্মীরে (২৩ জন)। যাঁদের মধ্যে কুড়ি জন মারা গিয়েছেন পুলিশের গুলিতে। লাঠিচার্জে দেশে মারা গিয়েছেন ১৪ জন। অথচ গতবছর লাঠিচার্জে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
নিরাপদতম মেট্রো শহর হিসেবে কলকাতার মুকুটে নব্য-পালক গুঁজে দিলেও গোটা রাজ্যের নিরিখে ভ্রুকুটি টেনেই রাখছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)। কলকাতা নিরাপদ শহর। তবে ওই কেন্দ্রীয় সংস্থার দাবি, গত একবছরে রাজ্যে মেয়েদের উপর হিংসাত্মক ঘটনা বেড়েছে।
এনসিআরবি’র রিপোর্ট বলছে, গত একবছরে দেশজুড়ে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার প্রায় ৮.৩ শতাংশ কমে গেলেও দেশের পূর্বাঞ্চলীয় দুই রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশায় গত একবছরে তা বেড়ে গিয়েছে বেশ কিছুটা। এনসিআরবি’র রিপোর্ট বলছে, ২০১৯ সালে এরাজ্যে মহিলাদের উপরে হিংসাত্মক ঘটনার পুলিশে লিপিবদ্ধ সংখ্যা ছিল ২৮,৬৫৯ যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬,৪৩৯। ওড়িশায় ২০১৯ এবং ২০২০ মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের পরিসংখ্যান যথাক্রমে ২৩,১৮৩ এবং ২৫,৪৮৯। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে — দেশে ২০১৯ সালে মহিলাদের উপরে আক্রমণের সংখ্যা যেখানে ছিল ৪,০৫,৩২৬, গতবছর অর্থাৎ ২০২০ সালে তা নেমে এসেছে ৩,৭১,৫০৩এ। এনসিআরবি’র রিপোর্ট ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ বলছে — প্রতি একলক্ষে শহর কলকাতায় অপরাধের হার ১২৯.৫। যার শীর্ষে যথারীতি রয়েছে দিল্লী। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রানাধীন পুলিশ পরিকাঠামোর ঘেরাটোপে থাকা দিল্লীতে ওই অপরাধের হার প্রতি একলক্ষে ১৬০৮.৬। আমদাবাদে ১৩০০.৫, লখনউ ৬৬৬.৬, চেন্নাই ১৯৩৭.১, হায়দরাবাদ ২৩৩.০, মুম্বই ৩১৮.৬, বেঙ্গালুরু ৪০১.৯।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশের স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে কোভিডের প্রথম পর্বে। ২০২১’র গোড়ায় কিছুদিনের জন্য উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে স্কুল চালু হলেও কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে মাস দুয়েক পরেই আবার তা বন্ধ করে দিতে হয়। দ্বিতীয় ঢেউ থিতিয়ে যাওয়ার পর কয়েকটি রাজ্যে স্কুল খুলেছে কিছুদিন হল, পশ্চিমবঙ্গে এখনো বন্ধই আছে। প্রাথমিক স্কুল অবশ্য প্রায় সর্বত্রই টানা সতেরো মাস বা ৫০০ দিন ধরে বন্ধ আছে। এরফলে স্কুল শিক্ষার যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে তা প্রায় সবাই জানেন। এই ক্ষতি কতটা গভীর ও ব্যাপক তা জানার জন্য দরকার ছিল একটি ব্যাপক সমীক্ষার। সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ জঁ দ্রেজ-এর নেতৃত্বে এইরকম একটি সমীক্ষা হয়েছে। তার রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে।
অগস্ট ২০২১এ এই সমীক্ষাটি চালানো হয় ভারতের ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জুড়ে। তারমধ্যে আছে আসাম, বিহার, চণ্ডীগড়, দিল্লী, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ।
রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ২৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই পর্বে নিয়মিত পড়াশুনো করেছে। ৩৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশুনো চলেছে অনিয়মিতভাবে। আর ৩৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পড়াশুনোর সম্পূর্ণ বাইরে থেকেছে।
সমীক্ষকরা দেখেছেন ৫০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কয়েকটি শব্দও একটানা পড়তে পারছে না। অভিভাবকরাও জানিয়েছেন যে তাদের সন্তানদের অনেকেই এই সময় পড়া ও লেখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে কবে আবার স্কুল খুলবে, তারা তাদের সন্তানদের আবার স্কুলে পাঠিয়ে পড়াশুনোর সুযোগ করে দিতে পারবেন। কারণ অনলাইন শিক্ষার সুযোগ তাদের সন্তানদের পক্ষে সেভাবে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে শহুরে এলাকায় ২৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের সুবিধে নিতে পেরেছে। গ্রামীণ এলাকায় পেরেছে মাত্র ৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। স্মার্টফোন না থাকাটা এর একটা কারণ কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। যে সমস্ত পরিবারের স্মার্টফোন আছে, শহুরে এলাকায় সেই সব ঘরের ছাত্রছাত্রীদের ৩১ শতাংশ নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করেছে। গ্রামীণ এলাকায় করেছে স্মার্টফোন থাকা পরিবারের মাত্র ১৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। এর কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে স্মার্টফোন মূলত পরিবারের রোজগেরে সদস্য সঙ্গে নিয়ে কাজে চলে যান, ফলে অনলাইন ক্লাসের সময় ছাত্রছাত্রীরা তা ব্যবহার করে উঠতে পারেনা। সমীক্ষা রিপোর্ট জানিয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর নিজেদের স্মার্টফোন আছে। স্মার্টফোনের সমস্যা ছাড়াও অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও ইন্টারনেটের ডেটা প্যাক কেনার ক্ষমতার অভাব। শহুরে এলাকার মাত্র ২৩ শতাংশ অভিভাবক মনে করেছেন তাদের সন্তানরা ঠিকমত অনলাইন ক্লাস করতে পেরেছে। গ্রামীণ এলাকায় এটা মাত্র ৮ শতাংশ।
যারা অনলাইন ক্লাস নিয়মিত বা মাঝেমাঝে করতে পেরেছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রছাত্রী সমীক্ষকদের জানিয়েছে যে তারা অনলাইন ক্লাস ভালোভাবে অনুসরণ করে পড়া বুঝে নিতে সক্ষম হয়নি। আর যারা অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি, তাদের অধিকাংশও নিজেরা বইপত্র খুলে এই পর্বে তেমন পড়াশুনো করেনি। যে সমস্ত পরিবার আর্থিকভাবে খানিকটা সক্ষম এবং সন্তানদের জন্য উপযুক্ত গৃহশিক্ষক বা শিক্ষিকার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, সেই সমস্ত পরিবারের সন্তানরাই এই পর্বে খানিকটা নিয়মিত ও ভালোভাবে পড়াশুনো করতে পেরেছে বলে সমীক্ষকরা জেনেছেন। দূরদর্শন ও টিভি চ্যানেল ভিত্তিক শিক্ষার প্রকল্প যে সব জায়গায় নেওয়া হয়েছিল, দেখা গেছে সেগুলি মোটের ওপর ব্যর্থই হয়েছে। শহুরে এলাকায় ৮ শতাংশ ও গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ১ শতাংশ টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষাদান কর্মসূচিতে প্রবেশ করেছে।
সমীক্ষা রিপোর্ট জানিয়েছে যে শিক্ষক শিক্ষিকারা অনেক জায়গাতেই আন্তরিকভাবে কিছু করার চেষ্টা করেছেন। স্কুলের বাইরে ছোট ছোট ক্লাস নেওয়া বা আকর্ষণীয় হতে পারে এমনভাবে ভিডিও তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। কেউ কেউ ছাত্রছাত্রীদের নেটপ্যাক নিজেরা ভরে দিয়েছেন, কেউ কেউ দিয়েছেন স্মার্টফোনও। কিন্তু যে বিশাল শিক্ষাসঙ্কট এই সময়ে তৈরি হয়েছে এই ধরনের আন্তরিক প্রচেষ্টাও সেভাবে তার কোনও সমাধান করতে পারেনি।
আর্থিক সঙ্কটের কারণে এইসময় অনেক অভিভাবক অভিভাবিকাই তাদের সন্তানদের বেসরকারী স্কুল থেকে সরকারি স্কুলে সরিয়ে নিয়ে এসেছেন। সমীক্ষকরা যাদের মধ্যে এই সমীক্ষা চালিয়েছেন, তাদের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা প্রায় ২৬ শতাংশ পরিবারে ঘটেছে — যা এক উল্লেখযোগ্য বদল।
মিড-ডে-মিল এইসময় সরবরাহ করা হয়নি। তার বদলে যে খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে তা ছাত্রছাত্রী পিছু মাসের বরাদ্দের চেয়ে অনেকটাই কম থেকেছে অধিকাংশ জায়গায়। তবে সরকারি স্কুলে পড়ে এমন শিক্ষার্থীবৃন্দের অভিভাবকদের ৮০ শতাংশই জানিয়েছেন যে তারা এই পর্বে স্কুল থেকে কিছু পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী নিয়মিতভাবে পেয়েছেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ভাঁড়ার একেবারেই পূর্ণ হয়নি।
সমীক্ষা রিপোর্ট আমাদের জানাচ্ছে যে গ্রামীণ ভারতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ৪২ শতাংশ একটি শব্দও পড়তে পারেনি। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ভারতে ৭৭ শতাংশ আর শহর এলাকায় ৬৫ শতাংশ মাতৃভাষায় বড় বড় হরফে সহজ লেখার একটি অক্ষরও পড়তে সক্ষম হয়নি। তারা গতবছর লকডাউনের সময় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু সেভাবে কোনওদিন স্কুলেই যায়নি। এবার তারাই উঠে যাবে তৃতীয় শ্রেণিতে।
উচ্চ প্রাথমিক স্তরের ছবিটাও একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি ভালোভাবে রিডিং পড়তে সক্ষম নয়। শহর, গ্রাম সর্বত্রই পরিসংখ্যানটা একইরকম হতাশাজনক। লকডাউন শুরু হবার আগেও পরিস্থিতি খুব একটা সন্তোষজনক ছিলনা। লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। ছাত্রছাত্রীরা যেটুকু যা শিখেছিল, তাও অনেকটাই ভুলে গেছে। অভিভাবকেরা জানিয়েছেন যে ছাত্রছাত্রীদের লিখন ও পঠন দক্ষতা এই লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকার সময়ে মারাত্মকভাবে কমেছে।
শুধুমাত্র পঠন ও লিখনের দক্ষতাই যে এই পর্বে কমেছে তা নয়। সার্বিকভাবেই শিক্ষার্থীদের নানা মানসিক ও আচরণগত সমস্যা বেড়েছে। অভিভাবক অভিভাবিকাদের অনেকেই জানিয়েছেন যে এই সময় তাদের ছেলেমেয়েরা উচ্ছৃঙ্খল, অমনোযোগী, অলস, মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সব মিলিয়ে অভিভাবক অভিভাবিকারা স্কুল খোলার পক্ষে জোরালো মত দিয়েছেন। শহরাঞ্চলের অভিভাবকদের মধ্যে ৬ শতাংশ স্কুল খোলা নিয়ে সংশয়ী বা বিরোধী হলেও গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকদের ৯৭ শতাংশই স্কুল খোলার পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাচিত্র নিয়ে এই সময়ে শিক্ষা আলোচনা নিয়ে লার্নিং টুগেদার নামে একটি রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। সেই রিপোর্ট থেকেও দেখা যাচ্ছে জঁ দ্রেজদের সমীক্ষার মতোই এই রাজ্যের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলে অতিমারি পরিস্থিতিতে শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষা আলোচনা প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের পূর্বকথা’তে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেছেন যে এই দেড়বছরে অসংখ্য ছেলেমেয়ের লেখাপড়া যেভাবে ব্যাহত বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে, স্কুল খোলার পরেও সেই সমস্যা চলে যাবেনা; বরং স্কুল খোলার পরেই সঙ্কটের চেহারাটা কত ব্যাপ্ত ও গভীর, সেটা ভালোভাবে বোঝা যাবে। চলতি কাঠামো অনুসরণ করে চলে, কেবলমাত্র শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এই বিপুল সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব নয়। বিশেষ ধরনের সঙ্কটের মোকাবিলার জন্য দরকার বিশেষ পরিকল্পনা অনুসারে বিশেষ ধরনের কর্মসূচি আর তা রূপায়ণের বিশেষ ধরনের নানামাত্রিক উদ্যোগ। বিভিন্ন অঞ্চলে অতিমারির বিভিন্ন এবং পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই লড়াই চালাতে হবে। কাজটা করতে হবে একটা ‘মিশন মোড’এ — নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দায়িত্ব নিয়ে। এবং সেজন্য দরকারি হল ‘স্কুলের পাশাপাশি সমাজের অংশগ্রহণ’ (কমিউনিটি পার্টিসিপেশন অ্যালংসাইড ফর্মাল স্কুলিং)।
বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে স্কুল খুলতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে নভেম্বর মাসে পরিস্থিতি সাপেক্ষে স্কুল খোলা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। স্কুল খোলার এই পর্বে সঙ্কটের ব্যাপক ও গভীর ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ যে অপরিহার্য, তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। সরকার, শিক্ষক সমাজ বা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড়াও বৃহত্তর নাগরিক সমাজ, শিক্ষানুরাগী মহল, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাকে সঙ্কট মোকাবিলার কাজে যুক্ত করা দরকার। সর্বাগ্রে দরকার সংশ্লিষ্ট সব মহল থেকে মতামত গ্রহণ করে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কর্তব্যকর্ম ও পথচলার রূপরেখাকে এলাকাগত পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচার করে সুনির্দিষ্ট করা। পথ চলতে চলতে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক অভিভাবিকা, শিক্ষক সমাজ ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের থেকে নিয়মিত ফিডব্যাক গ্রহণ করা, নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে কিছু সময় অন্তর অন্তর পরিস্থিতির সমীক্ষা করানো দরকার ও প্রয়োজন পড়লে পথচলার রূপরেখাকে সেই অনুযায়ী কম বেশি অদল বদল করে নেওয়াও দরকার। সঙ্কট যথেষ্ট বড়। তাই তার মোকাবিলার জন্য ব্যাপক, গভীর, সৃজনশীল ও আন্তরিক নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া বিশেষভাবেই প্রয়োজন।
- সৌভিক ঘোষাল
এই বছরের জুলাই শেষ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রবল বর্ষণে কলকাতা এবং শহরতলীর বেহাল হয়ে যাওয়া, সাধারণ মানুষের হয়রানি, ডেঙ্গির উত্তোরত্তর বৃদ্ধি, জমা জলে তড়িতাহত হয়ে মানুষের মৃত্যু — এসব মন খারাপ করে দেওয়ার খবর।
এসব কিছু মাথায় রেখে গত ১২ সেপ্টেম্বর চড়িয়াল খাল, যা বজবজ থেকে শুরু করে, কলকাতার বেহালা, ঠাকুরপুকুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জলনিকাশী ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে, তার সংযোজিত অংশকে বুজিয়ে ফেলার বিরুদ্ধে বজবজ থেকে বেহালা অবধি এক সাইকেল যাত্রার আয়োজন করা হয় এবং ঠাকুরপুকুর ও বেহালা কুমোরপাড়ায় এক ছোট প্রচারসভা সংগঠিত হয়। লোক সমাগম খুব বেশি না হলেও বিষয়টি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে সংগঠিত এই উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে বৃষ্টিতে কলকাতার বিভিন্ন জায়গা সহ গ্রাম মফস্বলের বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়া অবস্থা জলনিকাশী ব্যবস্থার অবনতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
চড়িয়াল খালের মূল অংশটি বজবজের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রবহমান। টালী নালা অর্থাৎ আদিগঙ্গার কিছু দূরে সিরিটির কাছাকাছি কোন এক স্থান (বীরেন রায় রোড) থেকে শুরু হয়ে বড়িষা, সখেরবাজার, শীলপাড়া, ঠাকুরপুকুর, জোকা হয়ে মহাত্মাগান্ধী রোড, ডায়মন্ড হারবার রোড, বাকরাহাট রোড ও নুঙ্গী-বজবজ রোড পার হয়ে মেটাপুকুরে দু’ভাগ হয়ে পূজালী ও চড়িয়ালে গিয়ে মিশেছে হুগলী নদীর সঙ্গে। চড়িয়াল খালের সংযোজিত অংশ অর্থাৎ বেহালা, ঠাকুরপুকুর ইত্যাদি অংশে খালটি খুবই অপ্রশস্ত হলেও কলুয়া মৌজা থেকে যথেষ্ট চওড়া হয়ে এগিয়ে গিয়েছে। ৫৫ ফুট থেকে ১২০ ফুট পর্যন্ত চওড়া এই খাল। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে একদিকে পলি মাটি, কচুরিপানার দরুন খালের গভীরতা কমেছে, অন্যদিকে প্রান্তিক মানুষ জীবন জীবিকার তাগিদে খালের পাশে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকা শুরু করেছে। কিছু দোকানপাটও গড়ে উঠেছে। ফলে দু’দিক দিয়ে খাল বুজে আসছে। আর যথেচ্ছভাবে নোংরা ফেলার জন্য খালের জল মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে উঠেছে। কোথাও মানুষের মল-মূত্রও খালের জলে হচ্ছে। চড়িয়াল খালের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় মিশেছে ছোট, বড়ো বিভিন্ন খাল এবং বেশ কিছু অঞ্চলের খোলা এবং ভূগর্ভস্থ নর্দমা। অন্যান্য খালের মধ্যে কালীঘাট ফলতা রেলওয়ে খাল, ম্যানেজমেন্ট খাল, কেওড়াপুকুর খাল ইত্যাদি। কোন কারণে কোন এলাকায় স্থানীয় জলবহ খাল বন্ধ হয়ে গেলে সেখানকার প্রধান খাল ‘চড়িয়াল’ পর্যন্ত যেতেই পারেনা। নগরায়ণের স্বাভাবিক পরিণতির দরুন কিছু জায়গায় রাস্তা তৈরির দরুন খাল যেমন বুজেছে, তেমনি বেশ কিছু জায়গায় পরিবেশ দপ্তরকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জলা বুজিয়ে এক শ্রেণীর প্রোমোটার এবং স্বার্থান্বেষী মানুষের মদতে বাড়ি, ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে। জোকা, ডায়মন্ড পার্ক সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা সহ, কলকাতার আরো বেশ কিছু এলাকা সাম্প্রতিককালের বর্ষণে জলমগ্ন হয়ে পড়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে উপরোক্ত কারণগুলি উল্লেখযোগ্য। নগরায়ণ করতে গিয়ে বাকি সমস্ত বিষয় যদি উপেক্ষিত হয়, তাহলে তা অপরিকল্পিত উন্নয়নের মধ্যে পড়ে। বেঙ্গালুরু, মুম্বাই, গুরুগ্রাম ইত্যাদি শিল্পোন্নত শহরগুলিতে বৃষ্টিতে জলে ভেসে যাওয়া অপরিকল্পিত উন্নয়নের ছবি সামনে নিয়ে আসে, কলকাতাও কোনো ব্যতিক্রম নয়। এই সমস্যার সুরাহা হতে পারত, যদি খালগুলির নিয়মিত সংস্কার করা হত, খাল পাড়গুলি বাঁধিয়ে চার পাশে গাছপালা লাগিয়ে সৌন্দর্যায়ন করা হত, দূষণ প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা করা যেত, বেআইনিভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ আটকানো যেত, আর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করা যেত। বিভিন্ন পর্বে সরকার কিছু পরিকল্পনা করলেও তা হয় সেই অবস্থায় রয়ে গেছে বা সামান্য রূপায়িত হয়েছে। এটা তথ্য দিয়ে যাচাই করে নেওয়া যাক।
কেইআইপি (কলকাতা এনভায়রনমেণ্ট ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম) বস্তুত কলকাতা কর্পোরেশন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ উদ্যোগে রূপায়িত কর্মসূচি, যা পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০২ সালে শুরু হয়ে ২০০৭ সালে শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা বিলম্বিত হয়।
এই প্রকল্প রুপায়ণের প্রয়োজনীয় অর্থের বেশিরভাগের সূত্র ছিল এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক) প্রদত্ত ঋণ। প্রকল্পের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশের অবনতি রোধ করা, কলকাতা শহরতলীর জলনিকাশী ব্যবস্থার উন্নয়ন, খালগুলির সংস্কার, বস্তিগুলিতে নাগরিক পরিষেবার ব্যবস্থা করা এবং কঠিন বর্জ্য পদার্থ গুলির যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা। সবকটিই নাগরিক সমাজের ও পরিবেশের নিরিখে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রকল্পের পরিকল্পনা মতো ৫টি খালের পাশে বসবাসকারী প্রায় ৩,৬০০ মানুষের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। পুনর্বাসনের দাবি আদায় এবং খালপাড়ের ঝুপড়িবাসীদের বলপূর্বক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দরুন পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদের বিষয়টিকে কিছুটা হলেও রুখে দেওয়া গিয়েছিল। আসলে নগরায়ন, শহরের সৌন্দর্যায়নের আড়ালে প্রান্তিক মানুষদের কথা ভুলে যাওয়া হয়। ফলে পরিবেশ বাঁচানোর পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষের লড়াই গড়ে তোলাটা জরুরী। কলকাতা কর্পোরেশন এবং রাজ্য সেচ ও জলপথ বিভাগ, যারা এই প্রকল্পের রূপায়ক ছিল, তাদের উদ্যোগে এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তবে বেশ কিছু লোক এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েছিল। পাঁচটি খালকে সংস্কার করার কথা ভাবা হয়েছিল — চড়িয়াল খাল, মানিখালি খাল, বেগোর খাল, কেওড়াপুকুর খাল ও তার শাখাপ্রশাখা, টালিগঞ্জ পঞ্চান্নগ্রাম খাল ও তার শাখাপ্রশাখা।
কলকাতা এবং তার পার্শবর্তী এলাকার জলনিকাশী ব্যবস্থায় এই খালগুলি, পুকুরগুলির পাশাপাশি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। পুকুরে বৃষ্টির জল জমা হয় আর অতিরিক্ত জল খাল দিয়ে বয়ে নদীতে গিয়ে মেশে। এই খালগুলি খনন করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে এই খালগুলি ব্যবহার শুরু করেছিল। ১৯৭৮ সালে প্রবল বন্যার পর, ১৯৮০ সালে চড়িয়াল সহ অন্য খালগুলির সংস্কার সাধন করা হয়, কিন্তু তারপর দীর্ঘ সময় ধরে খালগুলির সংস্কার করা হয়নি।
যাই হোক, প্রকল্পের পরিকল্পনা মতো উচ্ছেদ হওয়া কিছু লোকের পুনর্বাসনের পর খাল সংস্কারের কাজ শুরু হয়। ঠিক কত শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছিল তা সবার জানা নেই, তবে কাজের ছিল শম্বুক গতি। উদাহরণ স্বরূপ পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনটি পাম্পিং স্টেশন বসানোর কাজ শুরু হয়। এই পাম্পিং স্টেশনগুলি পয়ঃনিষ্কাশন লাইন এবং নর্দমার জল পাম্প করে জল শোধনাগারের মধ্যে দিয়ে খালে মিশবে, যেখান থেকে জল চলে যাবে নদীতে। চড়িয়াল খালের ক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা শুরু হয়েছিল। বেহালা অঞ্চলের ১২২নং ওয়ার্ডে পুকুর খনন এবং সংস্কার করে জল শোধনাগার (এসটিপি) বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল। যতদূর জানা আছে নিষ্কাশন লাইন থেকে পাম্প করে জল শোধনাগারে নিয়ে যাওয়ার প্রকল্প অন্তত ১২২, ১১৫নং ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয়নি। বিলম্বের একটি কারণ উছেদ হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনে দেরী হওয়া, অন্য একটি কারণ হল যে এজেন্সিকে কাজের বরাত দেওয়া হয়েছিল তাদের অযোগ্যতা। ফলে সময় ও অর্থ দুয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগের শেষ থাকেনা। ২০১৯ সালের ১৮ অগাস্টের টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ভারী বর্ষণে ঠাকুরপুকুর, বেহালা, সখের বাজার, পূর্বপাড়া ইত্যাদি এলাকাগুলি ব্যাপকভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে এবং জল নামতে সময় লাগছে। বাসিন্দাদের মত অনুযায়ী সংলগ্ন চড়িয়াল খালের উপচে পড়া ছিল অন্যতম কারণ।
আইআইএম জোকার অধ্যাপক ডঃ তড়িৎ কুমার দত্ত’র একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা অনুসরণ করলে দেখা যায় “দি ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনল্যাণ্ড ফিশারিজ (অ্যামেণ্ডমেন্ট) এ্যাক্ট” ১৯৯৩ আইনের ১৭এ ধারায় (২) উপধারা অনুযায়ী সরকার বে-আইনিভাবে ভরাট হওয়া পুকুর ও জলাভূমির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেগুলিকে মালিকের সম্পূর্ণ খরচে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করতে পারে অথবা ২৫ বছরের জন্য এই ধরণের পুকুর বা জলাশয় অধিগ্রহণ করবে। এছাড়া, শাস্তিস্বরূপ দু’বছরের জেল ও দু’লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে আইন ভঙ্গকারীর। দু’একটি ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগ করা হলে পুকুর বা জলাভূমি বোজানোর হিড়িক থেমে যাবে।” জলনিকাশী ব্যবস্থা উত্তোরত্তর খারাপ হওয়ার এটি একটি কারণ যা জোকা, নিউটাউন সহ বিভিন্ন অঞ্চলের পরিকাঠামো দেখলেই বোঝা যায়। লেখাটিতে আরো বলা হয়েছে, “চড়িয়াল জলাভূমি ও স্থানীয় পুকুর, জলাশয়গুলিকে বাঁচানোর দাবিতে দীর্ঘদিন যাবৎ সরব জোকা পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সংস্থা (জোকা ওপেড)। এই সংস্থার পক্ষ থেকে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ, মহকুমাশাসক থেকে শুরু করে জেলাশাসক, মৎস্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত অসংখ্যবার দরবার করা হয়েছে। এমনকি, আলিপুর কোর্টে মামলা রুজু করা হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে কোন এক অজানা কারণে বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শেষমেশ মুখ্যমন্ত্রী এব্যাপারে নিজে হস্তক্ষেপ করেন। কিন্তু তা সত্বেও পুকুর বা জলাভূমি বোজানো বন্ধ হয়নি।” এই পরিস্থিতিতে নিয়ে আসা হল কেইআইপি দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল জলনিকাশী ব্যবস্থার উন্নয়ন, সেই অনুযায়ী চড়িয়াল খাল-সংযোজিত অংশ সহ বেশ কিছু পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ, জলনিকাশী লাইন সম্প্রসারণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য এবং এসব নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু যেটা সমস্যাজনক তা হল চড়িয়াল খালের সংযোজিত অংশকে বুজিয়ে রাস্তা বানিয়ে ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন বসিয়ে নিকাশী ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা। আজকাল ভূগর্ভস্থ ড্রেন অনেক জায়গায় করা হচ্ছে, এবং বৈজ্ঞানিক দিক থেকে তা ঠিকই আছে। কিন্তু খাল, জলাশয়, পুকুর ইত্যাদির ভূমিকা অপরিসীম। বর্ষার জল সংলগ্ন জলাশয়গুলিতে জমা হয় সরাসরি বা নর্দমা মারফত। আর চড়িয়াল খালের সংযোজিত অংশ যে পরিমাণ জল বহন করতে পারে তা ভূগর্ভস্থ ড্রেন পারবেনা।
এটা ঠিকই, নিয়মিত সংস্কার এবং দূষণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে খালটি দূষিত এবং সংযোজিত অংশের স্থানীয় বাসিন্দাদের তা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু এই যুক্তিতে তো সব খালই বুজিয়ে দেওয়ার কথা উঠতে পারে, আর গঙ্গানদীও তো দূষণের শিকার। আসলে খাল সংস্কার এবং দূষণ মুক্ত রাখার প্রকল্প একটা ধারাবাহিক কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত। এরজন্য একটি নির্দিষ্ট দপ্তর রেখে ২-৩ মাস অন্তর খালগুলির সংস্কার এবং দূষণ মুক্ত করার ব্যবস্থা করলে চাপ কমে। জৈবিক পদ্ধতিতে মাইক্রো-অরগ্যানিসমের মাধ্যমে দূষণ মুক্ত করা ও কলকাতা কর্পোরেশনের রাডারে জল শোধনাগার বানানোর জায়গা পাওয়া অতো সোজা নয়। তবে এই সব ইচ্ছেকে রূপ দেবার জন্য যা প্রয়োজন, তা হল একদম স্থানীয় তৃণমূল স্তর থেকে মানূষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার মধ্যে দিয়ে সমস্যার যথার্থ অনুধাবন এবং ধারাবাহিক কার্যক্রম গ্রহণ করা। নগরায়ণ, মেট্রো রেল মারফত পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি আমরা কোনটার বিরুদ্ধে নই, কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার।
এই সমস্ত বিষয় নিয়ে বেশ কিছূ পরিবেশবাদী সংগঠন ও ব্যক্তি সোচ্চার। গত ১২ সেপ্টেম্বর ‘নদী বাঁচাও, জীবন বাঁচাও’, ‘জলঙ্গী নদী সমাজ’, ‘মন্থন’ পত্রিকা, দক্ষিণ কলকাতা এপিডিআর সহ বেশ কিছু সংগঠনের উদ্যোগে সাইকেল মিছিল ও সভার আয়োজন করা হয়। লক্ষনীয় যে, বজবজে পুলিশ এই মিছিলে বাধা দেয় এবং তার আগের রাতে সংগঠকদের প্রতি হুমকিও দেওয়া হয়। সেদিন সর্বভারতীয় মেডিকাল প্রবেশিকা পরীক্ষা থাকলেও, সংগঠকদের প্রস্তাব ছিল, যে স্কুলে সিট পড়েছে, তারপর থেকে মিছিল শুরু হবে। কিন্তু পুলিশ তাতেও রাজী হয়নি। এই পুলিশী বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও আসল লক্ষ্য চড়িয়াল খাল ও সামগ্রিক জলনিকাশী ও পরিবেশগত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পত্রিকা মারফত জানা গেল যাদবপুর বিশবিদ্যালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নিকাশী ব্যবস্থা নিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। যদি তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে চড়িয়াল সম্পর্কিত বিষয়টি নিয়ে অবহিত করা যায় খুব ভালো হয়। আর প্রশাসনের কাছে দাবি একটু নমনীয় হওয়ার। যখন এটা যথার্থভাবে বলা হয় ‘পরিবেশ রক্ষা সবার দায়িত্ব’, তখন পরিবেশ সচেতন এবং বিশেষতঃ এই বিষয়ে গবেষণা করা মানুষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জায়গা খোলা রাখা উচিত।
কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গের জল নিকাশী ব্যবস্থা উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলন কিন্তু চালিয়ে যেতে হবে।
- সৌরবিজয় সরকার
২৭ সেপ্টেম্বর কোষ্ঠিয়া অঞ্চলের খেমুয়া গ্রামের সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সদস্য ভাষ্কর বাউরী প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। তিনি জটিল ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে তার চিকিৎসা চলছিল। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার আগেই চলে গেলেন। আগে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক করতেন। তার স্ত্রী একবার পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছিলেন। পরে ২০০৮-০৯ সালে সিপিআই(এমএল)’এর সাথে যুক্ত হন। তিনি খুবই গরিব ছিলেন। সব সময় সব কর্মসূচিতে হাসিমুখে অংশ নিতেন, বিশেষ করে বনের জমির আন্দোলনে একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন। তিনি পাঁচ মেয়ে এবং স্ত্রীকে রেখে গেছেন। বাঁকুড়া জেলা পার্টি সংগঠন তাঁর সমগ্র পরিবার সহ খেমুয়া শাখার সকল সদস্যদের সমবেদনা জানিয়েছে।
কমরেড ভাস্কর বাউরি লাল সেলাম।
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কলকাতা টিভি'র লাইসেন্স নবীকরণ না করে উল্টে 'চ্যানেল বন্ধ কেন করা হবে না' শো কজ নোটিশ করেছে। মিডিয়ার গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর এই ফতোয়ার আমরা তীব্র ধিক্কার জানাই এবং অবিলম্বে চ্যানেলের নবীকরণ সহ অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে ২৯ সেপ্টেম্বর নবান্ন অভিযানে যেতে গিয়ে পুলিশী সন্ত্রাসের জেরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা গ্রেপ্তার হন। মোট ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আইসা দাবি তুলেছে ধৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি চাই!
== সমাপ্ত ==