সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর বেশরম বলাৎকার

গত ১৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং তথ্যের অধিকার আইনের (আরটিআই) সংশোধনী বিল পেশ করেন, সেদিন লোকসভায় স্বাভাবিক কারণেই হৈ-চৈ ও হুলুস্থুল হয়, অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন দলের সাংসদ ও ব্যারিস্টার আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বিলটিকে সংবিধানের ওপর আক্রমণ বলে সমালোচনা করেন। বিতর্কের সময় কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর বিলটিকে ‘তথ্য আইন খতম করার বিল’ অ্যাখ্যা দেন। তিনদিন বাদে ২২৪ জন সাংসদ বিলটি পেশ হওয়ার পক্ষে এবং ৯ জন বিপক্ষে ভোট দেন। জানাই ছিল এটি হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর প্রথম পাঁচশালা মেয়াদেই সেদিকে যাবার চেষ্টা করেছিলেন, দেশের মানবাধিকার আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মীরা তো বটেই, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও একাধিক ভাষণে আরটিআই আইন ২০০৫ পদদলনের প্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। কারণ মোদি সরকার আরটিআই আইন অনুসারে তথ্য দিচ্ছে না, বারবার এ অভিযোগ উঠেছিল। মোদীজির প্রধান বশংবদ অমিত শাহ যেদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন, সেদিনই আন্দাজ করা গিয়েছিল যে আরটিআই খর্ব করার মতো সেই সব আইন আনা হবে বা আইনের রদবদল হবে, যার মর্মার্থ সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর বেশরম বলাৎকার।

এই সংশোধনীতে তথ্য কমিশনারকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার নিশ্চয়তা নিধন করা হল। আরটিআই ছিল একজন তথ্য কমিশনারকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ করা হবে তিনি ৬৫ বছর বয়স অবধি ঐ পদে আসীন থাকবেন। এবং আর কোনোদিন ওই চাকরিতে ফিরতে পারবেন না। কারণ বেশি দিন চাকরিতে থাকলে কমিশনার যেন দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়ে পড়েন,এই নিশ্চয়তার জন্য। এই তথ্যের অধিকার আইন রচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বেশ কিছু সমাজকর্মী, যাঁদের মধ্যে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ অন্যতম। সংশোধনীতে এসব নিয়ম উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে একেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে দেবে তথ্য কমিশনের চাকরির মেয়াদ, বেতন, চাকরির শর্ত ইত্যাদি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের (পড়ুন মোদি-অমিত শাহ-র) দয়ার উপর নির্ভর করবে কমিশনারের চাকরি, বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়া বা না পাওয়া। অর্থাৎ এখন থেকে আরটিআই আইনের রূপায়ণ হবে মোদী-শাহ (আরএসএস ডিক্টেটর মোহন ভাগবত) ইত্যাদির অঙ্গুলি হেলনে।

এ নয় যে এতদিন আরটিআই আইন খুব ভালোভাবে মেনে চলা হচ্ছিল। বছরের পর বছর কেটে গেলেও আবেদনপত্রের উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না, আইন মোতাবেক সেজন্য কারো শাস্তিও হচ্ছিল না। তথাচ গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াইয়ে এই আইনের অবদান অনস্বীকার্য। কেননা, এসব সত্বেও এই আইনের দরুণ অনেক দুর্নীতি-অপকর্ম-অবহেলার তথ্য সামনে এসেছে, গণতন্ত্র মদত পেয়েছে। এই আইন বলবৎ হওয়ার পর থেকে তথ্য চেয়ে জমা পড়েছে বহু আবেদনপত্র। এই আইন অনুসারে তথ্যের আবেদন করতে লাগে ১০ টাকা, স্বল্পমূল্যে তথ্য পাওয়া যায়, আবেদন করার ৩০ দিনের মধ্যে তথ্য জানাতে বা তথ্য কেন দিতে অপারগ তা জানাতে বাধ্য কমিশন। আবার তথ্য জানার আবেদন করায় খুন হয়েছেন প্রায় ৭০ জন, মারধোর-হুমকি-হেনস্থা তো ছিলই। অর্থাৎ প্রভাবশালীদের রোষের শিকার হচ্ছেন তথ্য অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা।

কী আছে বিলে? তথ্যের অধিকার আইন, ২০১৫ অনুসারে, একজনের বয়স হতে পারত সর্বাধিক ৬৫ বছর, চাকরির মেয়াদ ছিল সর্বোচ্চ পাঁচ বছর, ও বেতন ছিল সমপদের নির্বাচন কমিশনারের সমান। পাঁচ বছরের মেয়াদ ফুরোলে তথ্য কমিশনারকে চাকরি ছাড়তে হবে, এবং তিনি তথ্যের অধিকার আরও বহু।

ভোটাভুটির সময়ে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি দাবি করেন, ‘ডিভিশন’ হোক, অর্থাৎ কোন সাংসদ পক্ষে আর কে বিপক্ষে, সেটাও নথিভুক্ত করা হোক। লোকসভায় কোনও মোশন গৃহীত হবে কি না সেটা সাধারণত ধ্বনি ভোটে নির্ধারিত হয়, অর্থাৎ একবার যাঁরা মোশনের পক্ষে তাঁরা তারস্বরে ‘আয়’ অর্থাৎ হ্যাঁ বলেন, আর একবার যাঁরা বিপক্ষে তাঁরা একসাথে ‘নে’ অর্থাৎ না বলেন, যে চ্যাঁচানির জোর বেশি বলে লোকসভার স্পিকার মনে করেন সেই চ্যাঁচানির সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়। কতজন বা কোন সাংসদ কী সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন, তা আলাদা করে নথিভুক্ত হয় না। ধ্বনি ভোটের বিকল্প হচ্ছে ‘ডিভিশন’। কিন্ত কংগ্রেস ও তৃণমূল সাংসদরা ওয়াকআউট করেন।

এই আইন যখন ইউপিএ আমলে আনা হয়, তখন বিরোধী বিজেপি সদস্যরাও সমর্থন করেছিলেন। এখন যে তাঁদের ডিগবাজি যে অবাধ দুর্নীতি,স্বজনপোষণ ও প্রতিবাদীদের পীড়ন বাড়াবে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

গণতন্ত্র নিধনকারী এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠুক। ভারতে “আইনের বদল বা সাধারণভাবে প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার কোনই চেষ্টা থাকে না সরকার পক্ষের, এমনকী প্রথাগত স্কুলের শিক্ষাতেও প্রশাসন কীভাবে চলে, কোনও ভারতীয় নাগরিকের কী কী অধিকার তা শেখানো হয় না। রোজগার ও চিকিৎসার ন্যূনতম নিরাপত্তা জোটানোর কঠিন লড়াইতেই শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন বহু, বহু মানুষ। অধিকাংশ সরকারি নথিপত্র আঞ্চলিক সহজবোধ্য ভাষায় না থাকার ফলে অন্যের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় অনেককেই। প্রশাসনের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক অনেকটাই রাজা-প্রজার মতো, যেখানে প্রজাকে হীন হয়ে থাকতে হয়। এর মধ্যে, উপরোক্ত সীমাবদ্ধতাগুলি সত্ত্বেও প্রজার ক্ষমতায়নে একটু হলেও সাহায্য করেছে এই তথ্যের অধিকার আইন। এই আইনের প্রস্তাবিত বদলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছে তথ্যের অধিকারের লড়াইয়ের সাথে যুক্ত নানা মানুষের থেকে, এক প্রাক্তন মুখ্য তথ্য কমিশনার প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন একমাত্র জনতার চাপই তথ্যের অধিকার আইনকে মোদী সরকারের হাত থেকে বাঁচতে পারে। এটাই একমাত্র বিকল্প।

খণ্ড-26