৩০ জুলাই, ২০১৯ রাজ্যসভায় পাশ হল তাৎক্ষণিক তালাক বিরোধী বিল। পোশাকী নাম “মুসলমান মহিলা (বিবাহ সংক্রান্ত অধিকার সুরক্ষা) বিল”। এর আগে মোদি-১ আমলে সরকার যে বিলটি এনেছিল তা রাজ্যসভায় পাশ না হওয়ায় বাতিল হয়ে গেছিল। তখন সরকার একটি অর্ডিনান্যান্স আনে। মোদি-২ আমলের বর্তমান বিলটি সেই অর্ডিন্যান্সেরই প্রতিরূপ। আগেই এই বিল অনুমোদিত হয়েছে লোকসভায়। এবারে রাজ্যসভাতেও তা পাশ হল। কী আছে ওই বিলে? কোনও স্বামী তাৎক্ষণিক তিন তালাক দিলে তার বিরুদ্ধে জামীন অযোগ্য ধারায় ফৌজদারি মামলা হবে। এই অপরাধে তিন বছরের জেল হবে। মুসলমান পুরুষের জন্য এই ফৌজদারি আইন।
তাৎক্ষণিক তিন তালাক আসলে পুরুষের দ্বারা একতরফাভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ। একতরফা বিচ্ছেদ এ দেশে বিরল নয়। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী, এই দেশে স্বামী-পরিত্যক্তা (আইনগতভাবে নয়) মহিলার সংখ্যা হল ২৩ লক্ষ ৭০ হাজার। তাঁরা কিন্তু আইনিভাবে বিচ্ছিন্না নন। তাঁদের মধ্যে ১৯ লক্ষ হলেন হিন্দু এবং ২.৮ লক্ষ হলেন মুসলমান। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সব ধর্মের পুরুষরা এমন অন্যায় সুযোগ নিয়ে থাকেন। যদি একে ফৌজদারি অপরাধ বলা হয়, তবে কেন তা সব ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রেই বলা হবে না – এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কেউ বলতে পারেন, অন্য ধর্মে ‘তালাক তালাক তালাক’ বললেই তো বিচ্ছেদ হয় না, তাহলে তাদের কেন এই ফৌজদারি অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হবে! এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যেও আগস্ট ২০১৭ থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাক আর নেই, কারণ সুপ্রিম কোর্ট তাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। তাহলে কেন শুধু মুসলমান পুরুষের ক্ষেত্রে এই আইন? নানা ধর্মের বিপুল সংখ্যক নারী স্বামীর কাছে আইনিভাবে বিচ্ছিন্না না হয়েও পরিত্যক্তা, তাঁরা কেন সুবিচার পাবেন না, কেন ওই স্বামীরা অপরাধী বলে গণ্য হবেন না? বলতেই হয়, এই বিল একদেশদর্শী এবং সাম্যের বিরোধী।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের দু জন – প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর ও এস এ নাজির তাৎক্ষণিক তালাক প্রথা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে সরকারকে আইন প্রণয়নের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি (জাস্টিস জোসেফ, নরিম্যান ও ললিত) তাঁদের ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়ে বলেছিলেন, তাৎক্ষণিক তিন তালাক অসাংবিধানিক ও অ-ইসলামীয়। পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কথা তাঁরা বলেননি। স্পষ্টতই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায় (যেটি প্রকৃত রায় বলে গৃহীত) গ্রহণ না করে অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করে পার্লামেন্টের দুই কক্ষে তালাক বিল পাশ করালো। এমন তিন তালাক অবৈধ, অসাংবিধানিক, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় সত্ত্বেও নতুন করে সংসদে আইন প্রণয়নের অর্থ কী? ওই সময় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যেহেতু এই তালাককে বাতিল করা হয়েছে, তাই পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কোনও প্রয়োজন নেই। কোর্টের নির্দেশ না মানা হলে দেশের যে গার্হস্থ্য আইন রয়েছে সেই মোতাবেক দোষীর বিচার ও শাস্তি হবে।
তবে কেন এই বিল? একজন মুসলমান স্বামী তাঁর মুসলিম স্ত্রীকে ‘তালাক তালাক তালাক’ (তোমার সঙ্গে থাকছি না) বললেও বিচ্ছেদ হবে না। এত কাল যে হত, সেটাই চরম লজ্জার। আদালতের রায়ে সেই লজ্জা দেরিতে হলেও দূর হয়েছে। কিন্তু নতুন এই তালাক আইনের উদ্দেশ্যটা কী? বিলের খসড়ায় বলা হয়েছে, স্বামী যদি ‘বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ’ এই কথা স্ত্রীকে বলে, তাঁর তিন বছর পর্যন্ত জেল হবে। এমন ফৌজদারি অপরাধ হল অ-জামিনযোগ্য অপরাধ । কিন্তু এখানে অপরাধটি ঠিক কী সংঘটিত হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। তাৎক্ষণিক ঝগড়ার উত্তাপে বা অন্য কোনও পরিস্থিতিতে যদি কোনও স্ত্রী তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন যে গতরাতে উনি নিভৃতে তিন বার ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করেছেন, পুলিশ ওই পুরুষকে প্রমাণ ছাড়াই তুলে নিয়ে যেতে পারবে। তারপর জেলের ঘানি টেনে ওই পুরুষের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কের আদৌ কোনও উন্নতি হবে কি! ফুসকুড়ি (তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাকে ফুসকুড়ি বলা হচ্ছে না) ভাল করতে গিয়ে গোটা পা-কে কেটে বাদ দেওয়ার এই বিল মানবতা বিরোধী। যে কোনও শাস্তির পিছনে চরম অনিবার্যতা না থাকলে ওই শাস্তি হয়ে পড়ে অত্যাচার, প্রজাপীড়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বর্তমান সরকার ঠিক সেটাই করল। বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ও আইনজ্ঞ জেরেমি বেন্থাম বলেছিলেন, তিনটি ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন ব্যবহার করা যাবে না, যার অন্যতম হল – কুকর্মের চেয়ে শাস্তির ওজন যেখানে বেশি। তাছাড়া, এই বিল যে আইন আনতে চলেছে, শাস্তিতত্ত্ব অনুযায়ী তা মধ্যযুগীয়। রবিশঙ্কর প্রসাদ একদা বলেছিলেন, তাৎক্ষণিক তালাক হল পাপ। মুসলমান আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হওয়া অনিবার্য। মন্ত্রীমশাই জানেন না যে এই দেশের শাস্তিতত্ত্ব মধ্যযুগীয় প্রতিশোধাত্মক মতবাদে বিশ্বাসী নয়। ভারতে নিবৃত্তিমূলক শাস্তির প্রচলন আছে। শাসক দল ‘ন্যায়’-এর পথ অনুসরণ না করে ‘ক্ষমতা’-র অপব্যবহার করছে। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে তিন তালাককে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে, এই রায় যথেষ্ট। পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আসলে মুসলমান সমাজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন। ভিন্ন দেওয়ানি বিধি কেবল ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য নেই, তা আছে সব অ-মুসলমান মানুষেরও। এ দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি না থাকলেও অভিন্ন ফৌজদারি বিধি আছে বলে ধরা হয়। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিলে মুসলমান পুরুষকে যে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দেওয়া হল, তা ফৌজদারি বিধির অভিন্নতাকে বড়সড় ধাক্কা দেয়। যে কোনও এক তরফা বিচ্ছেদ কাম্য নয় এবং তার জন্য আইন দরকার। সেই আইন ফৌজদারি নয়, তা হওয়া উচিত দেওয়ানি বৈবাহিক অপরাধ।
একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক।
১৯৮৩ সালে শেখ শেহনাজ সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করেন। মুসলিম ব্যক্তিগত আইন মুসলমান নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, এই ছিল তাঁর অভিযোগ। তাঁর স্বামী মধ্যরাতে তাঁকে তিন বার তালাক উচ্চারণ করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। একটি কাজ যোগাড় করে শেহনাজ পেয়িং গেস্ট হিসেবে একটি বাড়িতে থাকতেন। শেহনাজের প্রাক্তন স্বামী একদিন তাঁকে হুমকি দিয়ে বলেন, “তোমার এই সব বেয়াদপি করা চলবে না (চাকরি ও পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকা হল বেয়াদপি!) কারণ তুমি আমার স্ত্রী। আমি বিবাহিত জীবনের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছি।’’ শেহনাজ পাঁচ জন কাজির দ্বারস্থ হলে তাঁরা নানা রকমের মত দেন। অগত্যা শেহনাজ সর্বোচ্চ আদালতের কাছে জানতে চান, তিনি কি বিবাহিতা না বিবাহ-বিচ্ছিন্না? শেহনাজের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ তাঁকে বলেন, “এই ভাবে কউমের কথা পাবলিক না করলেই কি চলত না?’’ তার পর চলে দীর্ঘ লড়াই, যার মীমাংসা আজও হয়নি। অনেক হুমকি, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শেহনাজ সেই লড়াই নানাভাবে চালিয়ে গিয়েছেন। এই দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য তিনি ১৯৯৩ সালে নীরজা ভানোট সাহসিকতা পুরস্কার পেয়েছেন।
ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন রকমের ব্যক্তিগত/দেওয়ানি বিধি আছে। সেই দেওয়ানি বিধির খেলাপ করা হলে বা অপপ্রয়োগ হলে আদালত চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এবং আদালতের রায়কে মেনে নেওয়াই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের নাগরিকের কর্তব্য।
কিন্তু শেহনাজদের লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে দুটি উগ্র দল যেভাবে বাজার গরম করে চলেছে, তা দেখে বেশ আশ্চর্য লাগছে। বেশ কিছু কাল আগে বিজেপি সাংসদরা মুসলমান-নারীর তালাক-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে যেভাবে পথে নেমেছেন, তা এক কথায় মেরুকরণ ও ভোটের রাজনীতির নির্লজ্জ উদাহরণ। তিন-তালাক প্রথা অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জুড়ে দিচ্ছেন সারা দেশ জুড়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার শ্লোগান। কেউ কি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কোনও ব্লু প্রিন্ট চোখে দেখেছেন? হিন্দুরা যে ‘দায়ভাগ’ নামক ব্যক্তিগত আইন মানেন তা কি বাংলা ও অসমের বাইরের ভারতে চালু করতে পারবেন যেখানে চলে ‘মিতাক্ষরা’-র চারটি মজহাবের (দ্রাবিড়, বারাণসী, মহারাষ্ট্র, মিথিলা) নানা রকম ব্যক্তিগত কানুন (এর পর আছে খ্রিস্টান, জরাথ্রুষ্টবাদী, আদিবাসীদের নানা পারিবারিক আইন)? আসলে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ নামক একটি জুজুলাঠি বিজেপি ও তার সমমনস্ক দলগুলি মুসলমানদের দিকে মাঝেমধ্যেই তুলে ধরে, যেন মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনই একমাত্র নারীবিরোধী! ভারতে যত ধর্ম আছে, সব ধর্মের ব্যক্তিগত আইনে আছে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বিধি ও নিষেধ। এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির জটিলতায় গিয়ে ‘তিন তালাক’ বন্ধ করার আন্দোলনকে অন্য মুখে ঘুরিয়ে দেওয়া হল। করা হল বৈষম্যের রাজনীতি আর মুসলমান পুরুষদের জন্য একতরফা ফৌজদারি আইন।
মুসলমানদের গোঁড়া অংশ বলছে, তিন-তালাক যুগ-যুগ ধরে চলে আসা একটি নিয়ম এবং তা তাঁদের ধর্মীয় অধিকার (পড়ুন, পুরুষের ধর্মীয় অধিকার)। বিজেপি ও সংঘের ভাড়া করা কয়েকজন মুসলমান ধান্দাজীবীর মায়াকান্নার পরের দিন কলকাতার পার্ক সার্কাসে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড-এর তিন দিন ধরে চলা রুদ্ধদ্বার বৈঠকের দ্বিতীয় দিনে সর্বসম্মতিক্রমে তিন-তালাকের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বছর তিনেক আগে। ঠিক হয়েছিল, সরকার যদি তিন-তালাক বন্ধ করতে চায়, সর্বশক্তি দিয়ে তা রোখা হবে। তিন তালাকের পক্ষের যুক্তি, এ হল যুগ-যুগ ধরে চলে আসা ‘নিয়ম’। শোনা গিয়েছিল, পার্সোনাল ল বোর্ডের তৎকালীন কর্তা সুলতান আহমেদরা ১০ কোটি মুসলমান নারীর স্বাক্ষর যোগাড় করে নারীবিরোধী তালাকের পক্ষে আন্দোলনে নামবেন। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড-এর সভাপতি মৌলানা রাবে হাসানি নদভি বলেছিলেন, সরকার তালাকের নামে মুসলমানদের অপমান করছে; মুসলমানরা ধর্মনিরেপেক্ষ গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক ভারতের নাগরিক, তাঁরা তা সহ্য করবেন না।
প্রশ্নটা এখানেই। তখনও করেছিলাম, আজও করছি। জনাব নদভি সাহেব! যুগ-যুগ ধরে চলে আসা সহমরণ-প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, অমানবিক বলেই। বাংলাদেশ সমেত ২২টি দেশ, পৃথিবীর সমস্ত শিয়া ও সুন্নিদের হান্বালি মজহাব তিন-তালাক ‘ব্যান’ করেছে, তা নারীবিরোধী ও ধর্মবিরোধী বলে। শেহনাজদের সমস্যা কাজি দিয়ে মিটবে না, মেটা উচিতও নয়। উচিত হলে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা কায়েম করতে হয়, যা মৌলানা নদভির “ধর্মনিরেপেক্ষ গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক ভারতের” পরিপন্থী, অন্যান্য সব বিষয়ের মতো ব্যক্তিগত আইনের জটিলতায় দেশের আদালত শেষ কথা বলুক। সে সব কথা বলা হয়েছিল। কানে তোলেননি।
জানেন কি, সংখ্যায় নগণ্য, শতকরা হিসাবে আসে না – এমন উদাহরণ? খবরের কাগজ তুলে ধরে। মুসলমান পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে এসএমএস, ক্যুরিয়ারে তালাক দিচ্ছেন। নেশার ঘোরে ‘তিন তালাক’ উচ্চারণ করে ঘোর বিপদে পড়েছিলেন একবার এক ভদ্রলোক। কিন্তু একজন মহিলা চাইলেই তাঁর স্বামীকে তালাক দিতে পারেন না। বিচ্ছেদের জন্য তাঁর স্বামীর সম্মতির প্রয়োজন।
এমন তালাক নিয়ে ভারতীয় মুসলিম সমাজে যে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হয়ে ওঠেনি। এর পেছনে নানাবিধ কারণ ছিল এবং এখনও আছে। ১৯৯৫ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড যে ‘নিকাহনামা’ প্রণয়ন করে সেখানেও এ নিয়ে স্পষ্টতা ছিল না। ২০০৮ সালে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম উইমেন’স পার্সোনাল ল বোর্ড’ (উইমেন’স শব্দটি খেয়াল করবেন) একটি ‘নিকাহনামা’ তৈরি করেছিল, যা অনেকাংশে শরিয়ত ও যুক্তিসম্মত ছিল। কিন্তু সেই নিকাহনামাকে শরিয়তবিরুদ্ধ বলে বাতিল করে দিয়েছিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড। কী ছিল উইমেন’স পার্সোনাল ল বোর্ডের নিকাহনামায়? সেখানে নারী ও পুরুষ উভয়ের তালাক দেওয়ার অধিকার আছে বলা হয়েছিল। এসএমএস, টেলিফোন, বা ভিডিয়ো কনফারেন্সে তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ বলা হয়েছিল। পুরুষের ‘হঠাৎ-তালাক’ দেওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল এই নতুন নিকাহনামা।
কিন্তু কয়েকজন মহিলা জোট বেঁধে এ রকম একটা আস্ত নিকাহনামা তৈরি করে ফেললে পুরুষতান্ত্রিকতায় একটু বেশি আঘাত লাগে, আর তাই অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড একে অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে বাতিল করে দেয়। চলতে থাকে পুরনো নিকাহনামার নিয়মকানুন।
১৯৮৬ সালে শাহ বানু মামলার পর নিকাহনামা – তালাক, খোরপোষ নিয়ে নানা তর্ক উঠে এসেছে, কিন্তু হঠাৎ-তালাক বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর পেছনে ধর্মীয় কারণ যতটা না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে রাজনৈতিক কারণ। এখন অমুসলিম মাত্রেরই ধারণা, ভারতীয় সুন্নি (শিয়ারা নন) মুসলমান ইচ্ছে করলেই স্ত্রীকে তিন বার তালাক উচ্চারণ করে শুনিয়ে দিলেই বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। শিয়ারা মনে করেন, তিন বার তালাক উচ্চারণ করে যে বিচ্ছেদ তা একেবারেই অবৈধ এবং শরিয়ত-বিরুদ্ধ। সুন্নিদের যে চারটি মজহব (স্কুল) আছে তাদের তিনটি – হানাফি, মালেকি ও শাফেয়ি এমন ‘তিন-তালাক’-এ বিশ্বাসী। কিন্তু চতুর্থ সুন্নি মজহাব – হানবালিরা মনে করেন, এমন তাৎক্ষণিক-তালাক দেওয়া পাপকাজ এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়। তুরস্ক, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি ২২টি দেশে এমন বিচ্ছেদ বেআইনি, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের পরিপন্থী। কিন্তু আজও ভারতে তা চলছে। পার্সোনাল ল বোর্ডের যে নিকাহনামা এখন এ দেশে চলে তাতে অবশ্য তিন-তালাককে উৎসাহ দেওয়া হয়নি, কিন্তু মেনে নেওয়া হয়েছে। বিচ্ছেদের পরে খোরপোষ নিয়েও সেখানে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে যা পুরুষের পক্ষে যায়, অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে এমন নারীবিরোধী তালাক-খোরপোষের আইন নেই। ভারতীয় মুসলমানের বিবাহ-বিচ্ছেদ আইনে পুরুষের স্বার্থবেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
মুসলিম ব্যক্তিগত আইন তৈরি হয়েছে কোরান ও হাদিসের ভিত্তিতে। কী আছে সেখানে? ‘সুরা তালাক’- এর ১ ও ২ নম্বর আয়াতে আছেঃ
“হে নবী, তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদের তালাক দিও ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করো। তাদের গৃহ থেকে বহিস্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে, সে নিজেরই অনিষ্ট করে। সে জানে না, হয়তো আল্লাহ এই তালাকের পর কোনো নতুন উপায় করে দেবেন।
অতঃপর তারা যখন তাদের ইদ্দতকালে পৌঁছয়, তখন তাদের যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্ত পন্থায় ছেড়ে দেবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন নির্ভরযোগ্য লোককে সাক্ষী রাখবে। ...’’ (৬৫:১-২)
কোরান অনুযায়ী, তালাক তিনটি পর্যায়ে হবে। কোরান ও হাদিসে এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। বৈধ বিষয়ের মধ্যে তালাক হল সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস, তালাক উচ্চারণ করলে আল্লাহের আসন কেঁপে ওঠে।
তালাকের এক-একটি পর্যায় অন্তত ১৫ দিনের হবে। সর্বোত্তম তালাক হল তালাক-এ-আহসান। সেখানে এক তালাক দিয়ে এক ‘তুহুর’ অর্থাৎ কমপক্ষে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে। ইদ্দত (অপেক্ষাকাল) পূর্ণ হলে আবার বাকি দুই তালাক। এইভাবে তিন-তুহুর পার হলে বিচ্ছেদ কার্যকরী হবে। পরে ইচ্ছে করলে স্ত্রী বা পুরুষ অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন কিংবা নিজেরা পুনর্বিবাহ করতে পারেন।
দ্বিতীয় তালাক হল তালাক-এ-হাসান বা উত্তম বিচ্ছেদ। এক্ষেত্রে প্রত্যেক তুহুরে এক বার বিচ্ছেদ হবে। এইভাবে তিন তুহুরে তিন তালাক দিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ হতে পারে। এমন বিচ্ছেদে স্ত্রী স্বামীর জন্য অবৈধ হয়ে যাবে। ওই স্ত্রী পূর্বতন স্বামীকে পুনর্বিবাহ করতে পারবে না। ওই মহিলাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। এই স্বামী যদি মারা যান বা স্ত্রীকে তালাক দেন, তবে ওই মহিলা প্রাক্তন স্বামীকে বিবাহ করতে পারেন।
তৃতীয় প্রকার বিচ্ছেদ হল বিদায়াত তালাক। এটিই তাৎক্ষণিক তিন তালাক। এক সঙ্গে তিন বার তালাক বলে বিচ্ছেদ ঘটানো। এক্ষেত্রে তালাকদাতা অবশ্যই পাপ করছে বলে ইসলামি আইন মনে করে। এই তালাকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের একটি অংশ। আদালতে এই ধরণের তালাক অকার্যকর (নাল অ্যান্ড ভয়েড) ঘোষণা হওয়ার মধ্যে দিয়ে মহিলাদের সেই লড়াই বিজয়ী হয়েছিল। তারপরও মুসলমান পুরুষদের জন্য এই ভিন্ন ফৌজদারী আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য মোটেই ‘মুসলমান মহিলাদের বৈবাহিক অধিকার সুরক্ষা প্রদান’ বা দেওয়ানি বিধিতে সমতার দিকে এগিয়ে যাওয়া নয়, বরং তা মুসলমান সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা পেনাল কোড তৈরির দিকে প্রথম ধাপ বলেই মনে হয়। বিশেষত আইন বহির্ভূতভাবে এই ধরনের বিচ্ছিন্নকরণের বিবিধ প্রক্রিয়া, এমনকি নাগরিকত্ব আইনে প্রস্তাবিত সংশোধনীতেও এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিস্ফুট। সব মিলিয়ে নতুন এই ‘তালাক আইন’ হিটলারের সময়কার ‘নুরেনবার্গল’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়।