কাশ্মীরে বাইরের কেউ এসে জমি কিনতে পারবে না। কাশ্মীরী পণ্ডিতদের দাবি ছিল এটা। তাঁদের দাবি মেনে মহারাজা হরি সিং ১৯৩৫ সালে আইন প্রণয়ন করেন যে কাশ্মীরের জমি বাইরের কেউ কিনতে পারবে না। কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতেই রাজ্যের বিশেষ অধিকারের কথা ছিল। ৩৭০ নং ধারায় তা নথিভুক্ত হয়। ভারতের সংবিধান প্রণেতা গণপরিষদই এই ধারাকে মান্যতা দেয়।
দেশভাগ পর্বে কাশ্মীরের পক্ষে পাকিস্তানে যুক্ত হওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ইতিহাসের নির্দিষ্ট সন্ধিক্ষণে তারা ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পেছনে কাজ করেছিল ভারত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রের প্রতি তাদের বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করেছিল ভারতের সংবিধান তাদের নিজস্ব কাশ্মীরী পরিচিতিকে পূর্ণ মর্যাদা দেবে। ৩৭০ ধারা বাতিল করার মধ্য দিয়ে এই আস্থা ও বিশ্বাস সম্পূর্ণভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
এমনকি অটল বিহারী বাজপেয়িও কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে ‘কাশ্মীরিয়াৎ’, ‘জামুরিয়াৎ’ এবং ‘ইনসানিয়াৎ’-এর কথা বলেছিলেন – যার অর্থ কাশ্মীরী পরিচিতি, গণতন্ত্র এবং মানবতার চৌহদ্দিতে কাশ্মীর বিষয়টিকে বিবেচনা করা। ৩৭০ ধারা বাতিল করে দেওয়া এসবের ওপরেই একটা বড় আঘাত। নোট বাতিলের প্রক্রিয়া যেরকম অর্থনৈতিক জুয়া খেলা ছিল, ৩৭০ ধারা বাতিলের ব্যাপারটাও সেরকমই রাজনৈতিক জুয়া খেলা। নোটবন্দি যেভাবে বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল ৩৭০ ধারা বাতিলের ফলেও সেরকম ঘটনা ঘটবে বলে আশংকা হয়।
নানা ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে ৩৭০ ধারা ছিল কাশ্মীরী জনগণের জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা, ঠিক যেরকম ভাবে সংরক্ষণ আমাদের দেশের পিছিয়ে পড়া এসসি, এসটি, ‘ওবিসি’দের জন্য একটা বিশেষ ব্যবস্থা। জাতীয় ঐক্যের নামে ৩৭০ ধারা বিলোপ করা অনেকটা সামাজিক ঐক্য ও সংহতির নামে সংরক্ষণ তুলে দেবার মতোই। কেবল জম্মু ও কাশ্মীর নয়, ভারতের আরও ১১টি রাজ্যে বাইরের কেউ এসে সম্পত্তি কিনতে পারে না। নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, আসামের কার্বি আংলং ইত্যাদি ছাড়াও ৩৭১ ধারা অনুসারে গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও উত্তরাখন্ডের বেশ কিছু এলাকায় ‘বহিরাগতরা’ জমি কিনতে পারে না (সংবিধানের ৩৭১-এর এ এইচ উপধারাগুলি)।
কাশ্মীরে ঘুরতে গেলে আলাদা পারমিট লাগে না, কিন্তু অরুণাচল গেলে লাগে, আন্দামান ও নিকোবরে লাগে। কেবল কাশ্মীরে নয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, অরুণাচল ও সিকিমে এবং ত্রিপুরার আদিবাসীদের কোনও ইনকাম ট্যাক্স নেই। ৩৭০ বাতিল করা এইসব বিশেষাধিকার কেড়ে নেওয়ার মতোই। সারা দেশে কোথাও আদিবাসীদের সম্পত্তি অ-আদিবাসীরা কিনতে পারে না। ছোটো নাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট ও সাঁওতাল পরগণা টেনান্সি অ্যাক্টের মাধ্যমে বিশেষ অধিকার দেওয়া আছে আদিবাসীদের। যেভাবে বিজেপি সরকার ৩৭০ ধারা বিলোপ করল তা আদিবাসীদের বিশেষাধিকারের পক্ষেও অত্যন্ত বিপজ্জনক ইঙ্গিত।
কাশ্মীরী জনগণের অধিকার ও আবেগের থেকে কাশ্মীরের ভূমিখণ্ডর দিকেই বিজেপি বেশি করে নজর দিয়েছে। এটা আদিবাসী বনবাসীদের প্রতি বিজেপির মনোভাবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। বিজেপির বনাঞ্চলের জমি দরকার, কিন্তু সেখানকার অধিবাসী আদিবাসী মানুষের অধিকারের দিকে তাদের কোনো নজর নেই। তারা অরণ্য আইনকে বদলে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে জঙ্গলের জমি অধিগ্রহণ করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চায়।
যে কোনও রাজ্যের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হলে সেই রাজ্যের বিধানসভার অনুমোদন প্রয়োজন। এ বিষয়ে সংবিধানের ৩ নং ধারায় নির্দেশ দেওয়া আছে। জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ৩৫(ক) ধারার মাধ্যমেও এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশ আছে। গত কয়েক বছরে আমরা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং অন্ধপ্রদেশের মতো রাজ্যের বিভাজন দেখেছি। সব ক্ষেত্রেই বিভাজনের জন্য বেশ কয়েক বছর এমনকি বেশ কয়েক দশকব্যাপী আন্দোলন এবং আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দ্বিখন্ডিত করা হল সম্পূর্ণ এক তরফাভাবে এবং সংবিধানকে উল্লঙ্ঘন করে। যদি ধরেও নেয়া যায় লাদাখ এই বিভাজনের ফলে খুশি হবে তাহলেও প্রশ্ন থাকে এই বিভাজনের আগে যথোপযুক্ত আলোচনা কেন চালানো হল না ? একজন ব্যক্তি রাজ্যপালের অভিমতকে কাশ্মীরের জনগণের মত হিসেবে মান্যতা দেওয়া অনেকটা ফ্রান্সের রাজার মতকে ফ্রান্সের জনগণের মত হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার মতোই।
এ কেবল কাশ্মীরের উপরে নেমে আসা একটা আঘাত নয়। এটা গোটা ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর একটা আঘাত। নাগরিকত্ব সম্পর্কিত ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে এই ৩৭০ ধারা বিলোপের হঠকারী ব্যাপারটি আগামী দিনের এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে।
এই সমস্ত কারণেই কাশ্মীরের বিষয়টি নিয়ে আমরা গভীর উদ্বিগ্ন এবং মনে করছি এই বিষয়ে আমাদের সবার প্রতিবাদে সামিল হওয়া প্রয়োজন।