আমরা ৯ থেকে ১৩ আগস্ট ২০১৯, পাঁচ দিন ধরে কাশ্মীরের বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ভারত সরকার যেদিন সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিল করে, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে মুছে দেওয়ার ও দুটি ইউনিয়ন টেরিটরিতে ভেঙ্গে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের সফর শুরু হয়েছিল ঠিক তার চার দিন পরে, ৯ই আগস্ট ২০১৯-এ।
৯ আগস্ট শ্রীনগরে পৌঁছে আমরা দেখলাম কার্ফুর জন্য গোটা শহরটা চুপচাপ আর জনমানবহীন। কেবল ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীতে শহর গিজগিজ করছে। কার্ফু জারি ছিল পুরোপুরি, যেমনটা ৫ আগস্ট থেকেই চলছে। শ্রীনগরের রাস্তাঘাট জনশূন্য, সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা (দোকান, স্কুল, গ্রন্থাগার, পেট্রোল পাম্প, সরকারি অফিস, ব্যাংক) বন্ধ। কেবল কয়েকটা এটিএম, ওষুধের দোকান আর সমস্ত থানা খোলা ছিল। এখানে ওখানে বিক্ষিপ্ত দুচারজন লোক ছিল, তবে দল বেঁধে নয়।
আমরা ব্যাপকভাবে ঘুরেছি, শ্রীনগরের ভিতরে ও বাইরে, শ্রীনগরের কেন্দ্রের ছোট্ট যে জায়গাটা থেকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম কাজ করে, সেটা ছাড়িয়ে অনেক দূরে ঘুরেছি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের চেনা ওই জায়গাটুকুতে সময়ে সময়ে একটা প্রায়-স্বাভাবিক অবস্থা দেখা দেয় — আর তাই দেখেই ভারতীয় মিডিয়া দাবি করছে যে কাশ্মীরের জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। এর থেকে বড় সত্যের অপলাপ আর কিছু হতে পারে না।
আমরা পাঁচ দিন ধরে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়িয়েছি, শ্রীনগর শহরে আর কাশ্মীরের গ্রাম ও ছোট শহরগুলোতে শতাধিক সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেছি। মহিলা, স্কুল এবং কলেজের শিক্ষার্থী, দোকানদার, সাংবাদিক, ছোট ব্যবসায়ী, দিনমজুর, শ্রমিক, ইউপি, পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা অভিবাসী — আমরা সবার সঙ্গেই কথা বলেছি। কথা বলেছি কাশ্মীর উপত্যকার কাশ্মিরী পণ্ডিত, শিখদের পাশাপাশি কাশ্মীরি মুসলমানদের সঙ্গেও।
সব জায়গাতেই আমাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল, এমনকি যাঁরা আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিগ্ধ বা পরিস্থিতির জন্য খুব ক্ষুব্ধ, তাঁরাও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। মানুষজন যখন ভারত সরকারের বিরুদ্ধে তাদের বেদনা, ক্ষোভ ও বিশ্বাসঘাতকতার অনুভূতি জানাচ্ছিলেন, তখনও আমরা তাঁদের উষ্ণ আর দিলখোলা আতিথেয়তা থেকে বঞ্চিত হইনি। এটা আমাদের খুব গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।
একমাত্র বিজেপির কাশ্মীর বিষয়ক মুখপাত্র ছাড়া আমরা একজনও পাইনি, যিনি ভারত সরকারের ৩৭০ ধারা বাতিল করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন। উল্টোদিকে ৩৭০ ধারা (এবং ৩৫এ) বাতিল করা নিয়ে এবং যেভাবে এটা বাতিল করা হল তা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।
সব জায়গাতেই দেখেছি প্রধান আবেগ হল রাগ আর ভয়। এমনি ঘরোয়া কথাবার্তায় লোকেরা নির্দ্বিধায় তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল, কিন্তু কেউ ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি নয়। মুখ খুললেই সরকারের তরফের নিগ্রহের ঝুঁকি রয়েছে।
আমাদের পর্যবেক্ষণের সংক্ষিপ্তসার
ভাষান্তর : স্বাতী রায়
(পুনশ্চ: কাশ্মীর ফেরত উপরোক্ত প্রতিনিধিদল একটি ভিডিও তথ্যচিত্র তুলে আনেন। দিল্লীর সাংবাদিক সম্মেলনে সেটি তাদের দেখাতে দেওয়ার অনুমতি মেলেনি। প্রেস ক্লাব অধিকর্তারা জানিয়েছেন তাদের ওপর অলিখিত চাপ রয়েছে।)