৩৭০ ধারা বাতিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের আগেকার রাজ্য মর্যাদা ধ্বংস করার সাথে সাথে মোদী-শাহ সরকার মিশন কাশ্মীর নিয়ে তাদের নীল নকশার সুনির্দিষ্ট সংকেত দিয়েছে। ৩৭০ ধারা বাতিল দীর্ঘদিন ধরেই আরএসএস-এর অন্যতম এজেন্ডা হয়ে রয়েছে এবং বিজেপি দাবি করছে যে এই ধারা বাতিল হওয়ায় জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ খুশি হয়েছে। জনগণ যদি প্রকৃতই খুশি হয়ে থাকে তাহলে সরকার কারফিউ বলবৎ করল কেন, সমস্ত সংযোগ ছিন্ন এব়ং রাজ্যের সমস্ত বিরোধী নেতকে গৃহবন্দী করল কেন?
কাশ্মীরের বাইরের বিরোধী নেতাদের ঐ রাজ্যে যেতে দিচ্ছে না কেন? তাদের মিশন কাশ্মীর এজেণ্ডার জনপ্রিয়তা সম্পর্কেতারা যদি এত সুনিশ্চিত হয়েই থাকে তবে এই ইস্তাহার নিয়ে তারা রাজ্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল না কেন? মোদী সরকার এখন জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণকে দ্রুত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অমিত শাহ রাজ্যসভায় তাঁর ভাষণে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন, নরেন্দ্র মোদীও বলেন যে, কাশ্মীর চলচ্চিত্র শুটিং-এর আদর্শ জায়গা এবং সারা বিশ্বের পর্যটকদের স্বপ্নের গন্তব্যস্থল হয়ে উঠবে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আগে কি কাশ্মীর চলচ্চিত্র শুটিংয়ের জনপ্রিয় স্থল এবং পর্যটকদের গন্তব্য ছিল না? ৩৭০ ধারা কি কোনোভাবে তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল? এটা কি ঘটনা নয় যে, প্রধানত কাশ্মীরের ভূমি সংস্কারের ইতিহাসের কারণে কাশ্মীর সামাজিক/মানব উন্নয়নের অধিকাংশ সূচকের নিরিখে ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে? আর উন্নয়ন বলতে মোদী সরকার যদি বিনিয়োগকেই বোঝায় তবে জম্মু ও কাশ্মীরে বেশি-বেশি সরকারি বিনিয়োগ তারা করতে পারল না কেন তার উত্তর তাদের দিতে হবে। এবং বেসরকারি বিনিয়োগের কথা যদি ধরা হয়, সে সেক্ষেত্রে ৩৭০ ধারা নয়, সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক বা অনীহার বিষয় হয়ে থেকেছে সংঘাতদীর্ণ বিক্ষোভময় পরিস্থিতি। সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কর্পোরেট জগৎ থেকেও এ নিয়ে ক্রমেই আরও বেশি করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।
৩৭০ ধারার অন্তর্ভুক্তির ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলে দেখা যাচ্ছে, যে নির্দিষ্ট শর্তে ও পরিস্থিতিতে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভারতের অঙ্গীভূত হয় তার পরিণামেই যে ঐ ধারার অন্তর্ভুক্তি তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। এটাও সুবিদিত যে, এই ধারার অন্তর্ভুক্তির সময় কেউই এর বিরোধিতা করেনি — সংঘ-বিজেপির প্রচারবিদরা দুরভিসন্ধি নিয়ে বলে থাকেন যে, সর্দার প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এবং এমনকি ড: বি আর আম্বেদকরও ৩৭০ ধারার বিরুদ্ধে ছিলেন। যে ড: আম্বেদকর হিন্দুকোড বিল নিয়ে বিতর্ককে কেন্দ্র করে নেহরু মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং প্রতিবাদের সাক্ষর রেখে মৃত্যুর বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে বৌদ্ধ ধর্মগ্ৰহণ করেন, নিজের বিবেচনার বিরুদ্ধে এই ধারায় সম্মতি দিতে তাঁকে বাধ্য করাটা কোনো ভাবেই সম্ভব ছিল না। বিজেপি ৩৭০ ধারার জন্য নেহরুকে দায়ী করলেও বাস্তব জীবনে কিন্তু নেহরু এবং ইন্দিরার শাসনাধীনে ৩৭০ ধারার অধীনে প্রতিশ্রুত স্বায়ত্ততার ধারাবাহিক ক্ষয় ঘটানো হতে থাকে, এবং তা করা হয় জম্মু ও কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় নেতা শেখ আবদুল্লাকে ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত প্রায় দু-দশক ধরে কারান্তরীণ ও নির্বাসিত করে রাখার মধ্যে দিয়ে।
জম্মু ও কাশ্মীরের প্রতি কেন্দ্রের এই স্বৈরাচারী পদক্ষেপের সমালোচনা শুধু কমিউনিস্টরাই করেনি, জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং রাম মনোহর লোহিয়ার মত অনেক বিরোধী নেতাও তা করেছিলেন। কাশ্মীর সমস্যার মূলে ছিল গণতন্ত্রের লঙ্ঘন ও দমন এবং তার পরিণামে কাশ্মীরের সাধারণ জনগণের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতা বোধ। জয়প্রকাশ নারায়ণ ১৯৬৬ সালে তাঁর এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে বিষয়টাকে চিহ্নিত করেন: “আমরা গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিই, কিন্তু কাশ্মীরে বলপ্রয়োগের দ্বারা শাসন করি ... কাশ্মীর দুনিয়ার কাছে ভারতের ভাবমূর্তির এমন বিকৃতি সাধন করেছে যা আর কোনো কিছুই করেনি। সমস্যাটা যে রয়েছে তার কারণ এই নয় যে পাকিস্তান কাশ্মীর দখল করতে চায়, সমস্যার মূলে রয়েছে গভীর ও ব্যাপক বিস্তৃত অসন্তোষ” (ভারতবর্ষ, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ঘেরাও : জাতির ঐক্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ, এম জে আকবর, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ২৬৭)। এর পর যাঁরা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তাঁরা কাশ্মীর নিয়ে অনেক মনোরম কথা বলেছেন — যেমন, কাশ্মীরের স্বায়ত্ততা প্রসঙ্গে নরসিমা রাও বলেন যে এর কোনো সীমা পরিসীমা নেই, আর কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের কাঠামো হিসাবে অটল বিহারী বাজপেয়ীর তো সেই বিখ্যাত কাশ্মীরিয়ত, জামুরিয়ত ও ইনসানিয়াতের (কাশ্মীরের পরিচিতি, গণতন্ত্র ও মানবতা) মন্তব্য রয়েছে। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে কখনই বদলায়নি এবং বাজপেয়ী বাণীর রূপে যে তিনটি নীতির কথা তুলে ধরেছিলেন, মোদী ও শাহ সেগুলির বঞ্চনা ও দমনকে নতুন উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন।
বিজেপি জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদার বিলোপকে প্রকৃত ঐক্য ও সমরূপের বিজয় বলে উদযাপন করছে। কিন্তু ঘটনা হল, ভারতের অনেক রাজ্যই ৩৭১ ধারার বিভিন্ন অনুচ্ছেদ অনুসারে একই ধরনের সাংবিধানিক সুরক্ষা উপভোগ করে চলেছে। যখন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা এবং এমনকি রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তখন প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, মোদী সরকার নাগাল্যান্ডের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে তাদের সঙ্গে এমন একটা রফায় পৌঁছাতে চাইছে যা নাগাল্যান্ডকে অনেক বেশি স্বায়ত্ততা দেবে। এখন এটা আবার ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার বিলোপের প্রতি জম্মুর জনগণেরও তেমন সম্মতি নেই, সেখানে রাজ্য বিজেপি স্থানীয় জনগণের স্থায়ী বসবাসের জন্য বিশেষ অধিকারের দাবি জানাচ্ছে, প্রকৃত অর্থে যা হল ৩৫এ ধারাকে পুনর্বহাল করা। ষোল আনা জাতীয় সংহতি অর্জনের নামে মোদী সরকার কাশ্মীরীদের চরমতম বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতাকে খণ্ডন ও আড়াল করতে সরকারের হাজির করা প্রতিটি ছলনাময় যুক্তি এবং কাশ্মীরের কণ্ঠরোধ করতে তাদের নেওয়া প্রতিটি দমনমূলক পদক্ষেপ কাশ্মীরকে আরও দূরেই সরিয়ে দিচ্ছে। কাশ্মীরের জমির দখল নেওয়া এবং কাশ্মীরের নারীদের হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে নিয়ে আসার ফুর্তিবাজির সমস্ত কথাই সংঘ-বিজেপির প্রকৃত চরিত্রকে উন্মোচিত করে দিচ্ছে। মোদী সরকারের প্রতি সমর্থন জানাতে মুকেশ আম্বানির মতো সরকারের দোসর পুঁজিপতিরা জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের জন্য বিনিয়োগ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করছেন। এছাড়া, জম্মু ও কাশ্মীরকে যখন এক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করা হয়েছে, কাশ্মীরের ভিতর থেকেই তার পরিচিতিকে লঘু করে তোলার লক্ষ্যে জনসংখ্যাগত বিন্যাসকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা হবে। এবারের ১৫ আগস্ট বিজেপি যখন তার ‘কাশ্মীর বিজয়’ উদযাপন করবে, সারা ভারতের গণতন্ত্রীদের তখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য কাশ্মীরীদের লড়াইয়ের প্রতি সংহতি জানাতে হবে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৩ আগস্ট ২০১৯)