স্মরণে, শ্রদ্ধা নিবেদনে, স্মৃতিচারণা আর রাজনৈতিক বিশ্লেষণে কমরেড সুদর্শন বসুর স্মরণসভা হয়ে উঠলো এক শপথ গ্রহণ সভা। গত ১৫ আগস্ট ’১৯ স্বাধীনতা দিবসে কৃষ্ণনগর পৌরসভা ভবনের দ্বিজেন্দ্র মঞ্চে আয়োজিত এই স্মরণসভাকে এভাবেই তুলে ধরলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন সেই সমস্ত শহীদদের আজ যখন আমরা স্মরণ করছি তখন সুদর্শন বসু তথা অনলদার সংগ্রামী জীবন তার সাথে একদম মিলেমিশে গেছে। অসমাপ্ত স্বাধীনতার স্বপ্নকে পূরণ করার জন্যই সৃস্টি হয়েছিল নকশালবাড়ি। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এসেছিল নকশালবাড়ি; এর থেকে আলাদা কিছু নয়। সে সময়ে একটা প্রজন্ম বুঝেছিল, স্বাধীনতা যেটুকু আমরা পেয়েছি সেটা গরিব খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি, সামন্ততন্ত্র-জমিদারতন্ত্র যায়নি। আজও যেমন আমরা দেখছি ব্রিটিশের তৈরি রাওলাট আইন ১০০ বছর পরে আবারও ফিরে এলো ইউএপিএ-র নামে। সেই ‘৭০ দশকে রাস্ট্রকে ভাঙ্গার জন্য,বিপ্লব করার জন্য, স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র — এই কথাগুলি সাধারণ মানুষের জীবনে অর্থবহ করে তোলার জন্যই নকশালবাড়ি আন্দোলন। এ জন্যই সেটা এতবড় একটা আবেগ তৈরি করতে পেরেছিল। লড়াই শুরু হল আদিবাসী-চা বাগান শ্রমিক-দলিত-ভূমিহীন কৃষকের আত্মঘোষণার মধ্য দিয়ে,সেই স্ফূলিঙ্গ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, এর সাথে যুক্ত হল ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবীরা, সৃষ্টি হল নকশালবাড়ি অভ্যূত্থান। সেখান থেকেই উঠে আসা কমরেড অনলদা। তাঁর যে বিপ্লবী আবেগ, আদর্শ যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, প্রতিটি বাঁকে, মোড়ে, প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি বহন করে নিয়ে নিয়ে গেছেন। সেটাকে কোনো বোঝা হিসাবে না নিয়ে, হাসতে হাসতে, খুবই স্বাভাবিক ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছেন, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।
স্মরণসভার শুরুতে প্রয়াত কমরেড সুদর্শন বসুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন পার্টির রাজ্য ও জেলা নেতৃবৃন্দ, তাঁর পরিবারের সদস্যরা, বাম দলগুলির মধ্যে আরএসপির নদীয়া জেলা সম্পাদক শঙ্কর সরকার ও এসইউসিআই(সি) দলের নদীয়া জেলা সম্পাদক প্রবীর দে। সভা সঞ্চালনা করেন পার্টির নদীয়া জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত। এক মিনিট নীরবতা পালনের পর শোকবার্তা পাঠ করা হয়। শহীদের স্মরণে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার।
স্মরণসভায় রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ বলেন, কমরেডদের ভালোবাসতে পারা, মানুষকে ভালোবাসা এটা একটা বিরল গুণ যা অনলদা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। তাঁকে কোনোদিন উত্তেজিত হতে দেখা যায়নি, কারও সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় বা বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়তে তাঁকে কেউ কোনো দিন দেখেনি। দৃঢ়তা, উন্নত চেতনা, নিজেকে উজার করে দেওয়া কাকে বলে তিনি শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। যে কোনো পরিস্থতিতে হাসিমুখে কাজ করে যাওয়া — অনলদা ছিলেন তার প্রতিমূর্তি। যে কোনো কাজকে “দেখছি দেখবো” বলে বিলম্বিত করার পরিবর্তে, তাৎক্ষণিকভাবে যতটুকু করা যায়, বা পরিকল্পনা করা সম্ভব কাজে নেমে পড়তেন। দেশব্রতী সম্পাদক ও রাজ্য কমিটি সদস্য অনিমেষ চক্রবর্তী বলেন, আজীবন কমিউনিস্ট ও জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা এই দুটি বৈশিষ্টকে সুদর্শন বসু তাঁর নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে — ‘৬০-এর দশক থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। অনেক সময় অনেক কিছুই না ও থাকতে পারে, কোনো বিভ্রান্তি গ্রাস করতে পারে, রণকৌশল নাও থাকতে পারে, আশ্রয়-থাকা খাবারের সংস্থান, এসব কিছু নাও থাকতে পারে, যদি আদর্শকে বুকের মধ্যে জাগিয়ে রাখা যায় তবে সে মানুষ আজীবন কমিউনিস্ট থাকতে পারে। অনলদা এই চরিত্রটা আমাদের সামনে ফুটিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের যে গুণ ছিল তা হল,কমরেডদের সান্নিধ্য দিতে পারা, বেশি বেশি শোনা, যৌথ কাজের ধারা তৈরি করা।
পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল বলেন, পার্টি পুনর্গঠনের পর্যায়ে,শুদ্ধিকরণের সময় কমরেড সুদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর দৃঢ়চেতা মানসিকতা ছিল পার্টির সম্পদ। একে পাথেয় করে আজকের দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ভালো কমিউনিস্ট — ভালো মানুষ হওয়া সুদর্শন নিজের জীবন দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি কমরেড সুদর্শন বসুর পরিবারকে পার্টির সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকার আবেদন জানান।
রাজ্য কমিটি সদস্য বাবলু ব্যানার্জী বাঁকুড়া জেলায় পার্টির মধ্যে তীব্র আদর্শগত বিরোধ পরিচালনা করে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং পার্টিকে বিস্তার ঘটানোর কাজে সুদর্শন বসু যে ভাবে দৃঢ় আদর্শগত অবস্থান ও নমনীয় কৌশল গ্রহণ করেছিলেন তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
বর্তমান পরিস্থিতি ও কমরেড সুদর্শন বসুর সমগ্র জীবন প্রসঙ্গে কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার আরও বলেন,অত্যন্ত কঠিন কাজ কিভাবে সহজ করে, হাসিমুখে করা যায়,জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশিয়ে ফেলা যায়,সেই উদাহরণ ছিলেন অনলদা। ছাত্র-যুব অবস্থান থেকে নয়, দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের চাকুরি জীবনের নিশ্চিত ছক ভেঙ্গে সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার পথে এগিয়ে এসেছিলেন অনলদা। তুলনামূলক এই কঠিন কাজটি তিনি অনায়াসে করেছিলেন একটা দৃঢ় কমিউনিস্ট চেতনার উপর দাঁড়িয়ে। সারা জীবন এই দৃঢ় অবস্থানের উপর ভিত্তি করেই তিনি নমনীয়তার সাথে সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বিভিন্ন জেলার বৈশিষ্ট ও পার্টির প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করেছেন। শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের সময় নতুন ভাবনা চিন্তা নিয়ে পার্টিকে এক গণচরিত্র দেওয়ার চ্যালেঞ্জ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, শ্রমিক আন্দোলনে বিপ্লবী মতাদর্শ নিয়ে যাওয়ার কাজ করতেন। এই সমস্ত গুণাবলী থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। অনলদা যে সময় নকশালবাড়ির ডাকে সাড়া দিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেছিলেন,জীবনের লক্ষ্য ও গতিপথ ঠিক করেছিলেন, আজও সেই একই ধারাতে আমাদের রুখে দাঁড়ানো দরকার। দেশটাকে উল্টোদিকে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে সেই একই রকম দৃঢ়তা থাকা দরকার। আজ শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের মধ্য থেকে অনলদার মতো কমরেডরা উঠে আসতে পারে কিনা বিচার বিবেচনা করা দরকার। আজও নকশালবাড়ির মতো দৃঢ় শপথ নেওয়া যায় কিনা ভাবা দরকার। এভাবেই আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
এ ছাড়াও স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন রাজ্য নেতা কল্যাণ গোস্বামী, বাসুদেব বসু, জয়তু দেশমুখ, নদীয়া জেলা কমিটি ও রাজ্য কমিটি সদস্য কাজল দত্তগুপ্ত, রাজ্য কমিটি সদস্য ও গণশিল্পী নীতীশ রায়, রাজ্য শ্রমিক নেতা তরুণ সরকার, নদীয়া জেলা কমিটি সদস্য ও শ্রমিক নেতা অমল তরফদার প্রমুখ। পরিশেষে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে স্মরণসভা শেষ হয়।