চিত্র ১ : স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও। চেন্নাই শহরে কোনো চলন্ত গাড়ি থেকে নেওয়া প্রায় ২ মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে সরকারি ট্যাংকারের প্রতিক্ষায় নানা রঙের জলের কলসির লাইন ছাড়িয়েছে কয়েক কিলোমিটার।
চিত্র ২ : একমাস আগে তামিলনাড়ুতে যে বেসরকারি জলের ট্যাংকারের (১২০০০ লিটার) দাম ছিল ১২০০- ১৬০০ টাকা, আজ তার দাম দাঁড়িয়েছে ৪০০০-৫০০০।
চিত্র ৩ : উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখন্ডে জলের তীব্র সংকটের সময়েও গ্রামের নলকূপ ব্যবহার করার কোনো অধিকার নেই দলিতদের, নলকূপ পাহারায় রয়েছে উচ্চবর্ণের লেঠেল বাহিনী। অভিযোগ উঠছে সরকারি জলের ট্যাংকার দলিত বসতিগুলিকে পাশ কাটিয়ে শুধু মাত্র উচ্চবর্ণের গ্রামে জল সরবরাহ করছে।
চিত্র ৪ : রাজস্থানে কয়েক লিটার জল পেতে মহিলা ও কিশোর/কিশোরীদের কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করে লাইন লাগিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে সারা রাত। উপরের সব কটি ঘটনাই ভারতবর্ষের জল সংকটের বর্তমান চেহারাকে প্রকট করে তুলছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বিগত প্রায় সব কটি পরিবেশ সম্মেলনের মূল দিশা নির্মিত হয়েছে দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, জল সংকট, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব বৈচিত্র্য ও বিকল্প শক্তির খোঁজের উপর ভিত্তি করে। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের ১৯১টি সদস্য দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল এর ৭ নম্বর গোল ছিল সুস্থায়ী পরিবেশ বা এনভায়রনমেনটাল সাসটেইনেবিলিটি।আবার ২০১৫ সালে গৃহীত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল এর ৬-এর দাগে রয়েছে ২০৩০-র মধ্যে পৃথিবীর সকল নাগরিকের জন্য পরিস্রুত জল ও নিকাশি ব্যবস্থার লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু এসব গালভরা প্রতিশ্রুতির মধ্যেই দেশের ৪৪% অংশ খরা কবলিত। রেকর্ড বলছে এবারের প্রাক-বর্ষা মরশুম ছিল বিগত ৬৫ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় শুষ্কতম। আবার দেশের কোথাও কোথাও স্বল্প বর্ষণেই বন্যা পরিস্থিতি।
সারা পৃথিবীর ১৭% জনসংখ্যার ভারতবর্ষে রয়েছে মোটামুটি বিশ্বের ২.৫% স্থলভাগ আর ৪% মিষ্টি জলের সম্ভার। ১২টি প্রধান ও ৪৬টি মাঝারি নদী ছাড়াও এখানে রয়েছে অসংখ্য পুকুর, খাল, বিল, জলাশয় ইত্যাদি যেখান থেকে বছরে গড়ে ৬৯০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার জল আমরা ব্যবহার করতে পারি। এর সাথেই আছে ভূগর্ভস্থ জলের বিপুল সম্ভার, বাৎসরিক ব্যহারযোগ্য যে জলের পরিমাণ আনুমানিক ৪৩৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। গড়ে বছরে ৪০০০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার বৃষ্টিপাত এই জলের ভাণ্ডারকে রিচার্জ বা পূরণ করার অন্যতম উৎস।
নীতি আয়োগ প্রকাশিত ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের ৬০ কোটি নাগরিক বর্তমানে মাঝারি থেকে তীব্র জলকষ্টের শিকার, এবং বছরে ২ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র নিরাপদ জলের অভাবে। সারা দেশে ৭৫% বাড়িতে শুদ্ধ পানীয় জলের কোনো উৎস নেই, ৮৪% গ্রামীণ বাড়িতে নলবাহিত জলের সংযোগ অনুপস্থিত। জলসম্পদ মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী ২০৩০ সালে জলের সার্বিক চাহিদা ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণের দ্বিগুণ হতে চলেছে যা কিনা জল সংকটকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবে।এই পরিপ্রেক্ষিতেই নীতি আয়োগ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের লভ্য জলসম্পদ ও তার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ৯টি ক্ষেত্র এবং ২৮টি সূচকের (ভৌম জল, সেচ ব্যবস্থা, কৃষি ব্যবস্থা, পানীয় জল ইত্যাদি) উপর ভিত্তি করে কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনডেক্স নামক একটি পরিগণনা প্রকাশ করে যেখানে গুজরাট সর্বোচ্চ (৭৬) ও মেঘালয় সর্বনিম্ন (২৬) স্কোর অর্জন করে। উল্লেখযোগ্য যে এই গণনায় পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল প্রদেশ, জম্মু কাশ্মীর, মনিপুর ও মিজোরাম এর তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে বেঙ্গালুরু, দিল্লী, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ সহ দেশের ২১টি শহরে ভূগর্ভস্থ জলের ভাঁড়ার শেষ হয়ে যাবে। আগামি ২০৩০-এর পরে ৪০% নাগরিক শুদ্ধ পানীয় জল পাবেন না। নাসার গ্র্যাভিটি রিকভারি অ্যান্ড ক্লাইমেট এক্সপেরিমেন্ট (GRACE) মিশনে বিশ্বের ৩৪টি অঞ্চলে ১৪ বছর ধরে চালানো পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে জলস্তর নেমে যাওয়ার সত্যতা। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল দেশের প্রায় ৭০% জলের ভাণ্ডার কোন না কোনোভাবে কলুষিত, যার ফলে জলের গুণমান সূচকের (WorldWater Quality Index) নিরিখে ১২২টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২০তম। ২১% অসুখ বিসুখের মূল কারণ জল বাহিত সমস্যা। আর যে জিডিপি বৃদ্ধির গল্প শুনিয়ে ভারতের আর্থিক উন্নয়নের ফানুস ওড়ানো হয়, এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০-এ সেই জিডিপি ৬% ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে।
২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বিদ্যুতের গতিতে কমছে ভারতের জলস্তর, প্রতি বছর গড়ে ১০-২৫ মিলিমিটার। ১৯৭০-এ খারিফ চাষের সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১০৫০ মিলিমিটার যা ২০১৬-তে ১০০০ মিলিমিটারের নীচে নেমে গেছে। একইভাবে রবি শস্যের ফলনের বৃষ্টিপাত ১৫০ থেকে কমে হয়েছে ১০০ মিলিমিটার। বর্ষা চলাকালীন বৃষ্টিপাতহীন দিনের পরিমাণ ও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারতবর্ষ বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করে, যার পরিমাণ বছরে প্রায় ২৬০ কিউবিক কিলোমিটার। ১৯৬০-৭০ দশকে যদিও চিত্রটা ছিল বেশ খানিকটা আলাদা, সবুজ বিপ্লবের পর যা পুরোপুরি বদলে গেলো। ফলন বৃদ্ধির নাম করে দেশজ বীজ ও চাষের প্রক্রিয়া কে আমরা হারিয়ে ফেললাম, আর তার জায়গা দখল করল এমন এক কৃষি ব্যবস্থা যা মূলত হাইব্রিড বীজ, প্রচুর কীটনাশক ও অফুরন্ত জলের সরবরাহ নির্ভর। নষ্ট হল দেশের ব্যাপক ফসল বৈচিত্র্য, জলের যোগান দিতে অবাধে হাত পড়ল ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডারে। বর্তমানে আমাদের দেশের ভূগর্ভস্থ জলের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় কৃষি কাজে; আর জল সংকটের নেপথ্যে বিভিন্ন কারণের মধ্যে মূলত ধরা হয় জল নিবিড় (water intensive) কৃষিব্যবস্থা, শিল্প, বিদ্যুৎপ্রকল্প, সেচ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান জলের চাহিদাকে। CWMI রিপোর্ট অনুযায়ী ২৪টির মধ্যে ১৭টি রাজ্য কার্যকরীভাবে কৃষিক্ষেত্রে জল ব্যবহারের প্রশ্নে ৫০%- এর নীচে নম্বর পেয়েছে। অথচ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে ক্ষুদ্র সেচ বা বিন্দুসেচ ব্যবস্থা চালু করতে পারলে ৩০-৬০% জল বাঁচানো সম্ভব ছিল।
২০১৬ সালে প্রকাশিত কোবরা পোস্ট এর একটি রিপোর্টে প্রকাশ্যে আসে যে জলসম্পদ মন্ত্রকের অধীন সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার অথোরিটি (CGWA) আগের তিন বছরে ১৪৪ টি বেসরকারি কোম্পানিকে নিঃশুল্ক ভাবে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে। এই তালিকায় বিভিন্ন Water packaging & soft drinks industry যেমন পেপসি কো, কোকো কোলা-র মত বহুজাতিক সংস্থার নাম অগ্রগণ্য। পেপসি কো বছরে ৬৪৮০০০ কিউবিক মিটার জল তুলে নেয়, বদলে ফেরত দেয় না কিছুই। অথচ প্রতি বছর ৮৩৭৭৮ কিউবিক মিটার জল মাটিতে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল তাদের। নরম পানীয়ের একটি ছোট বোতল তৈরি করতে ১.৫-১.৯ লিটার জল খরচ হয়ে যায়, আর যদি এর সাথে এই পানীয় উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত আখ চাষের পিছনে খরচ হওয়া বিপুল জলের হিসেব ধরা যায় তাহলে এই ওয়াটার ফুট প্রিন্ট (যে কোনো পণ্য বা পরিষেবার জন্য ব্যবহৃত মোট জলের পরিমাণ) গিয়ে দাঁড়াবে ৪০০ লিটারে। বোতলজাত পানীয় জলের ব্যবসায় বাৎসরিক বৃদ্ধির হার যেখানে ৪০-৫০% সেখানে অতটাই দ্রুত হারে নিঃশেষিত হচ্ছে মাটির নীচের বিশুদ্ধ জলের ভাণ্ডার। জল স্তর নেমে যাচ্ছে বিপদ মাত্রার নীচে, যেখানে জলে মিশে যাচ্ছে বিপজ্জনক ধাতু বা অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ সুনিতা নারায়ণের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (CSE) এর পরীক্ষায় কোকো কোলা ও পেপসির বিভিন্ন নমুনায় ৩-৫ রকম কীটনাশকের উপস্থিতি বিপজ্জনক মাত্রায় পাওয়া গেছে। ভূগর্ভস্থ জল পুনঃনবিকরণ (Ground water recharge), বর্জ্য জলের পুনর্ব্যবহার (recycling) সংক্রান্ত বিধি নিষেধ বা নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবাধে প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট দানবদের দৌলতে।
শহরের বসতিগুলি যেখানে জলের অভাবে ধুঁকছে, সেখানেই প্রতি তলে সুইমিং পুল সহ বিশালাকায় বহুতল মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত হারে জল নিষ্কাশন ও ক্রমান্বয়ে জলতল হ্রাসের কারণে সাবসিডেন্স বা ভূপৃষ্ঠের আভ্যন্তরীণ গঠনের ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, পালটে যাচ্ছে জলের স্বাভাবিক প্রবাহ। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে এর ফলে ঘটে যেতে পারে চরম বিপর্যয়।
ভারতবর্ষের জলের চাহিদা মেটানো, জল সংরক্ষণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে জলাভূমি, পুকুর, হ্রদ, খাল, বিল সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয়। অথচ অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বেআইনি ভাবে যথেচ্ছ জলাভূমি ভরাটের ফলে শহর থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে প্রকৃতির এই দান। কলকাতার বুকে ‘রামসার সাইট’ পূর্ব কলকাতা জলাভূমি দশকের পর দশক ধরে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে দূষিত জলকে পরিশোধিত করে শহরের কিডনি রূপে কাজ করে যাচ্ছে। অথচ আইনের ফাঁক দিয়ে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে তার পরিধি। উন্নয়নের নামে অবাধে চলছে বৃক্ষছেদ। এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে জলাশয়গুলির বর্তমান সঠিক সংখ্যা বা অবস্থা নিয়ে কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই, সরকারি মহল থেকে এ ব্যাপারে কোনো সদিচ্ছাও চোখে পড়ে না। প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত বিস্তৃত নদী অববাহিকা ও জলাভূমিগুলিই জল সংরক্ষণ ও গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ এর মূল চাবিকাঠি হতে পারতো। ভারতের চতুর্থ ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প শুমারি রিপোর্ট (Minor Irrigation Census) (২০০৬-২০০৭) অনুযায়ী দেশের জলাশয়ের সংখ্যা ২০০০-২০০১-এর তৃতীয় ক্ষুদ্র সেচ শুমারি থেকে ৩২৭৫৮ কমে হয়ে দাঁড়িয়েছে ৫২৩৮১৬। এর মধ্যে প্রায় ১৫% (৮০১২৮টি) আবার ব্যবহারযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ সালে পঞ্চম ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প শুমারির রিপোর্ট ২০১৭ তে প্রকাশ পেয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ২০০৬-২০০৭ থেকে ২০১৩-১৪—এই সাত বছরে গোটা দেশে ভূপৃষ্ঠস্থ জলপ্রবাহের (Surface water) ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের সংখ্যা ৬,০১০০০ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৫,৯২০০০-এ। অর্থাৎ ক্রমেই বেড়েছে ভূ গর্ভস্থ জলের উপর নির্ভরশীল সেচের হার। মজার ব্যাপার দেশ জুড়ে থাকা জলাশয়ের নির্দিষ্ট সংখ্যা বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বুনিয়াদি কোন তথ্য এই রিপোর্টে বলা হয়নি। (WRIS) ওয়াটার রিসোর্স ইনফরমেশন সিস্টেমের অধীনে স্যাটেলাইট ম্যাপিং-এর মাধ্যমে জলাশয় ও জলাভূমির তথ্য ভাণ্ডার তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সংসদীয় প্যানেল রিপোর্ট বলছে বাস্তব পরিকল্পনা ও কার্যকরী ব্যবস্থাপনার জন্য জলাশয়ের সঠিক সংখ্যা বা ব্যবহার সংক্রান্ত যে তথ্য প্রয়োজন তা এই ডাটা বেসে অমিল।
২০১৮ সালে জাতি সঙ্ঘের ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট জল সংকট মোকাবিলায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিরপাশাপাশি প্রাকৃতিক ও দেশীয় পদ্ধতির উপর জোর দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে রাজস্থানের আলওয়ার জেলার দৃষ্টান্ত। ভারতের ওয়াটারম্যান হিসেবে পরিচিত রাজেন্দ্র সিং-এর উদ্যোগে অসংখ্য ক্ষুদ্র জল সঞ্চয় কাঠামো নির্মাণ যেখানে একইসাথে ১০০০-এরও বেশি খরা আক্রান্ত গ্রামে জলের যোগান দিয়েছে, শুকিয়ে যাওয়া ৫টি নদীকে বাঁচিয়ে তুলেছে, কৃষি উৎপাদন বাড়িয়েছে কয়েক গুণ, ৩৩% সবুজায়ন বৃদ্ধি করেছে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হয়েছে।
ভূগর্ভের জলসম্ভার কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্থানিক জলের উৎস নয়, বরং তা সামগ্রিক ভাবে মাটির নীচে সঞ্চিত প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিপুল ভাণ্ডার যা মানব সভ্যতায় বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার প্রাকৃতিক উপায়েই সেই অ্যাকুইফার রিচার্জও হয়ে এসেছে। উন্নত আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে জলের ভূ-তাত্ত্বিক ম্যাপিং এর পাশাপাশি জলস্তর সংরক্ষণে তাই সমান ভাবে একান্ত জরুরী কমিউনিটি পার্টিসিপেশন যাকে বলা হয় পার্টিসিপেটরী গ্রাউণ্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট (PGWM)।
শেষ কয়েক দশকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে, কর্পোরেট স্বার্থে আদিবাসী, প্রান্তিক জনজাতিকে ক্রমান্বয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, বিঘ্নিত হয়েছে ভারসাম্য। যারা ছিল জল জঙ্গল জমির সবচেয়ে বড় রক্ষক আজ তারাই নিজভূমে পরবাসী। এই মুহূর্তে দেশের তীব্র জল সংকটকে কেন্দ্র করে বর্ণ ও জাতি ভিত্তিক ক্ষমতার কাঠামো পরিচালিত হচ্ছে, বলাই বাহুল্য যার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে নিম্ন বর্গের মানুষ ও মহিলারা। ব্যক্তিগত ও ব্যবহারিক জীবনে জলের অপচয় রোধ, গাছ লাগানো, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও তার ব্যবহার নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু শুধু সেটুকুই যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ ও রাষ্ট্রের সদিচ্ছা। মুনাফার কবল থেকে জলের মত মৌলিক অধিকারকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাকৃতিক সম্পদের জাতীয়করণের কথাও আমাদের ভাবতে হতে পারে
জল সংকটের তীব্রতার কথা মাথায় রেখে সঙ্গতভাবেই দেশের রাজ্যসভায় এই প্রসঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব উঠেছিল। ২৬ জুন সেই আলোচনায় রাজ্যসভা সাংসদদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। গত ৩১ মে মোদী সরকার জল সম্পদ, নদী উন্নয়ন ও গঙ্গা সংরক্ষণ মন্ত্রক এবং পানীয় জল ও স্বছ্বতা মন্ত্রককে যুক্ত করে তৈরি করে জল শক্তি মন্ত্রক। প্রসঙ্গত, এই দপ্তরের মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত কয়েকদিন আগেই বলেছিলেন ভারতের জল সংকট থাকলেও তা নিয়ে অত চিন্তা করারও কিছু নেই। গত ৫ই জুলাই এর বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারমন রাষ্ট্রীয় গ্রামীণ পানীয় জল যোজনার খাতে ৬৯% বরাদ্দ বাড়িয়ে ৯১৫০.৩৬ কোটি টাকা ধার্য করেছেন, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ ও অন্যান্য খরা প্রবণ অঞ্চলে জলাভূমি সংরক্ষণ, সংস্কার, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প ইত্যাদির জন্য ‘হর খেত কো পানি’ প্রকল্পের খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৩০০ কোটি। ২০২৪ এর মধ্যে দেশের প্রতি ঘরে পাইপ লাইন দিয়ে জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি (নল সে জল) পাওয়া গেলেও বোতলজাত পানীয় ব্যবসার দৌলতে দ্রুত বেগে ভারতের জল স্তর নেমে যাওয়ার মোকাবিলা করার প্রশ্নে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াতের কথায়। ঘরে ঘরে কোনো জল যাবে সে পরিকল্পনাও পরিষ্কার নয়। জলই যদি না থাকে তাহলে নল দিয়ে তাতে যাবেটা কি? পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের উপর নদী সংযুক্তিকরণ বা বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ এর মত প্রকল্পগুলির ভয়ঙ্কর নেতিবাচক দিকগুলি নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন দেশের পরিবেশবিদরা। জলাভূমি সংরক্ষণ, সেচ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, স্থানীয় ভূমি চরিত্র অনুযায়ী কৃষি কাজ, ভৌম জলের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কার্যকরী পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদকে কর্পোরেট আগ্রাসন থেকে বাঁচানোর কোনো সঠিক দিশা না থাকলে প্রতি ঘরে নলের মাধ্যমে জল পৌঁছে দেওয়ার দাবিও অচিরেই জুমলায় পরিণত হতে দেরি হবে না।