জীবন-জীবিকা ও সামাজিক সুরক্ষার তীব্র সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে মাসখানেক আগেই যারা মোদী-২ সরকারকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনলো সেই সাধারণ জনতার আশা-আকাঙ্খাকে পদদলিত করে পেশ হল বাজেট ২০১৯। নির্মলা সীতারমন লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকেও কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন। তাঁর এই প্রথম বাজেট শ্রমিক ও কৃষকের বহু কষ্টে অর্জিত আইনি ও সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে আক্রমণ করেছে।
দেশের অর্থনীতির প্রকৃত বৃদ্ধিক্ষমতাকে খর্ব করা হল অর্থনীতিকে আরও উন্মুক্ত করে সিঙ্গল ব্রান্ড পণ্যের খুচরো বাজারে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের রাস্তা সহজ করে দেওয়ার ঘোষণার মাধ্যমে। বিমান চলাচল, গণমাধ্যম ও অ্যানিমেশন সেক্টরকেও খুলে দেওয়া হয়েছে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের জন্য। কৃষি ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্র দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থাতেও ঠিকমতো বীমা সুরক্ষার আওতাভুক্ত হল না। এখন বীমাক্ষেত্রে আরও এফডিআই ও বেসরকারীকরণের মাধ্যমে পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে উঠবে। এই বাজেটে যেভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিতে বিদেশী অংশীদারির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হল তা জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী।
এয়ার ইন্ডিয়া সহ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ইউনিট বিলগ্নিকরণের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে সরকার। রেলওয়ে বিলগ্নিকরণের পরিমাণ ঘোষণা করা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং এই বাজেট সরকারী ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কোম্পানিগুলির বেসরকারীকরণ আরও ত্বরান্বিত করবে। ‘ওয়ান নেশন ওয়ান পাওয়ার গ্রিড’ ঘোষণা এবং জল ও গ্যাসের জন্য আলাদা আলাদা গ্রিড স্থাপন এই দুই জাতীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেট কোম্পানির হাতে তুলে দেবে।
একেই সাধারণ মানুষ জ্বালানির বর্ধিত মূল্যের চাপে নাভিশ্বাস ফেলছে। এখন আবগারি শুল্ক ও সেস উভয়েরই বৃদ্ধি তাঁদের ঘাড়ে আরও বোঝা চাপিয়ে দেবে। পণ্য পরিবহন চার্জ ও যাত্রীভাড়া বেড়ে গিয়ে সাধারণ জনতার জন্য সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটাবে।
শ্রম আইনে পরিবর্তনের কথা বলেছে বাজেট। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া ও সমষ্টিবদ্ধ দরকষাকষি করার অধিকার খর্ব করার লক্ষ্যে এই পরিবর্তন। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা প্রসঙ্গে বাজেটে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি বা এনআরইজি (১০০ দিনের কাজ) এর মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করা প্রসঙ্গেও নেই একটি শব্দ। এই বাজেট কর্মহীনতা ও বৈষ্যমকে আরও গভীর করে তুলবে। এই বাজেট শ্রমিক বিরোধী।
কৃষকের জন্য বাজেটে কিছু নেই। অথচ কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে আর খরা পরিস্থিতির চক্করে আর্তনাদ করছে। কৃষিক কর্পোরেটকরণ ও শস্যবীজের বাজারের ৮৫%-এর বেশি অংশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির কব্জা থাকার বাস্তবতায় মোদী সরকার ঘোষণা করেছে ‘০% খরচে কৃষিকাজ’! কৃষকদের সাথে এ এক নিদারুণ রসিকতা। উৎপাদনশীল কৃষকদের ১০,০০০টি গোষ্ঠী গঠন করার ঘোষণাও তাদের সাথে প্রতারণা। কৃষক সমাজের প্রত্যাশার প্রতি এবারের বাজেট এক জবরদস্ত ধাক্কা। কৃষকেরা আশা করেছিলেন যে ঋণমুক্তির লক্ষ্যে এবং স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশগুলি লাগু করতে সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেবে। ১৫৯২টি উন্নয়ন অঞ্চলে ‘জল শক্তি অভিযান’ ঘোষণা এবং ‘জল জীবন’ প্রকল্পে ২০২২ সালের মধ্যে প্রত্যেকটি ঘরে পানীয় জল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি এই সরকারের আরেক মিথ্যাচার।
সমস্ত কোম্পানিগুলির মধ্যে বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানিগুলির সংখ্যা মাত্র ১ শতাংশ। তাদের ওপর ট্যাক্স চাপানো দরকার। কিন্তু তা সরকারের কর্পোরেট-তোষণ অভিমুখের বিপরীত।
একদিকে সরকার দাবি করছে যে ব্যাঙ্কগুলির অনুৎপাদক সম্পদ (NPA) বড় মাত্রায় কমেছে এবং ব্যাঙ্কগুলি ঋণগ্রস্ততা কাটিয়ে উঠেছে। উপরন্তু এই বাজেটে ব্যাঙ্কের লেনদেন কর আরও বাড়ানো হয়েছে। তথাপি বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে ৭০,০০০ কোটি টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত উপরে উল্লিখিত সরকারী দাবির প্রকৃত বাস্তবতাকে দেখিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে ব্যাঙ্কগুলি থেকে কর্পোরেট কোম্পানিদের হাতিয়ে নেওয়া টাকা সরকার নীরবে পূরণ করে দিচ্ছে জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকা থেকে। আর এভাবেই আড়াল করা হচ্ছে কর্পোরেট ও ব্যাঙ্ক মিলে ‘অনুৎপাদক সম্পদ’ নতুন ঋণে বদলে দেওয়ার খেলাটিকে।
ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে পূর্বতন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণিয়ামের প্রকাশিত সত্যকে লুকিয়ে ফেলার ছক এই বাজেট। মোদী-১ জমানার অর্থনৈতিক সমীক্ষা বিদেশী বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনে সুস্পষ্ট পতনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পূর্বতন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা উদ্ঘাটন করেছিলেন যে মোদী সরকার দ্বারা প্রকাশিত জিডিপির বৃদ্ধির হিসেব বাস্তবের হিসেব থেকে ২.৫% বেশি দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ মোদী সরকারের দেখানো ৭% নয়, বাস্তবে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪.৫%। সুতরাং বর্তমান জিডিপি ২ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি ডলার হিসেবে উপস্থিত করা এবং পরবর্তী ৫ বছরে তা বাড়িয়ে ৫ লক্ষ কোটি ডলারে বৃদ্ধি করার সরকারী ভবিষ্যদ্বাণী দেশের জনগণকে বোকা বানানো ছাড়া আর কিছু নয়।
-- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি