প্রবীণ বিপ্লবী শ্রমিক নেতা, আমাদের সকলের প্রিয় কমরেড সুদর্শন বসু (অনল, নাড়ু) ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং কিছুদিন চিকিৎসা চলতে চলতে গত ৫ জুলাই রাণঘাটের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তাঁর আদি বাড়ি ছিল শেওড়াফুলিতে। বাবা সতীশচন্দ্র বসু ও মা সুবর্ণলতা বসুর পরিবারে তাঁরা চার ভাই, দুই বোন; এখন একমাত্র বড় ভাই ছাড়া তাদের আর কেউ জীবিত নেই।
কমরেড সুদর্শন বসু ১৯৬৬ সালে দুর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্টে ক্রেন অপারেটার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। কারখানার শ্রমিক আন্দোলনে সক্রিয় অগ্রণী ভূমিকা নিতেন। ‘৬০-এর দশকে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল হয় ওঠে। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শ্রমিক সাথী আশীষ ও জব্বার। তারপর শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম আরও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন দুর্গাপুর রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা নকশালবাড়ি আন্দোলনে উদ্বুব্ধ হয়ে শ্রমিক আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। কমরেড বিনোদ মিশ্র, ওমস্বরূপ, ধূর্জটিপ্রসাদ বক্সীর মতো ছাত্র কমরেডরা শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্ম হতে থাকেন। এই প্রক্রিয়ায় কমরেড সুদর্শন এগিয়ে আসেন অগ্রণী ভূমিকায়।
আমাদের পার্টির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় দুর্গাপুরে ১৯৭৪ সালের ২৮ জুলাই শ্রমিক কোয়ার্টারে কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত হয়। তখন দুর্গাপুরের বেশ কয়েকজন অগ্রণী শ্রমিক কমরেড পেশাদার কর্মী হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন। এই কমরেডরা তাদের চাকরির অর্থ পার্টির কাছে তুলে দিতেন। পার্টি তাদের পরিবারের মাসিক খরচ দিয়ে বাকী অর্থ পার্টির কাজে খরচ করত। সে এক বিরল মতাদর্শগত পরিচয়ের প্রকাশ ছিল। তখন গ্রামাঞ্চলে কাজে যুক্ত থাকা সংগঠক ও কর্মীদের শিল্পাঞ্চলের কর্মীরা জামা-কাপড়-অর্থযোগান দিতেন। এইসমস্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কমরেড সুদর্শনরা ছিলেন দৃষ্টান্ত।
পার্টি কেন্দ্র পুনর্গঠনের পর কমরেড সুদর্শন বাঁকুড়া জেলায় কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। তখন কমরেড চারু মজুমদারের রচনাবলী প্রকাশের কাজ হাতে নেওয়া হয়। সেই কাজ দেখাশোনা করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। পুলিশ প্রচন্ড অত্যাচার করে। পরে জেলে পাঠিয়ে দেয়। জরুরী অবস্থার অবসান, ১৯৭৭-এর নির্বাচন এবং রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি পাওয়ার পর্বে কমরেড সুদর্শন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। আর তিনি দুর্গাপুরে ফিরে যাননি। তারপর কমরেড অনল নদীয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া, কলকাতা, মালদা জেলায় কাজ করেছেন। কৃষকদের মধ্যে কাজ করেছেন, আবার শ্রমিকদের মধ্যেও নতুন করে কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। একসময়ে এআইসিসিটিইউ-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি দীর্ঘদিন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য ছিলেন এবং রাজ্য অফিসের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁকে যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন। কমরেড অনল বরাবর হাসিখুশী, খোলামেলা, বিনয়ী ছিলেন। তাঁর যেমন নমনীয়তা, ঔদার্যছিল, তেমনি দৃঢ়তাও ছিল। পার্টির পরিবারগুলোর সঙ্গে তাঁর খুব মধুর সম্পর্কছিল। এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারতেন। খুবই খেলা পাগল ছিলেন।
কমরেড সুদর্শ ন বসু স্মরণে একের পাতার পর কমরেড সুূদর্শন এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন আমরা ভাবতে পারিনি। রোগের কথা শুনে সকলের মন খারাপ হয়ে যায়। কমরেড অনলের চলে যাওয়া বড়ই বেদনাদায়ক। সমগ্র পার্টি গভীর শোকের অংশীদার, প্রয়াত কমরেডের পরিবারের সদস্যদের শোকের সহমর্মী। এরকম সহজ সরল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, পার্টির আদর্শ, নীতি ও সংগঠনের প্রতি আস্থায় অবিচল একজন কমরেড পার্টির কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। কমরেড অনলের স্বপ্নকে পার্টি এগিয়ে নিয়ে যাবে। কমরেড সুদর্শন বসু লাল সেলাম।