গণপিটুনিতে হত্যার তদন্তে সিপিআইএমএল) প্রতিনিধি দল

লোকসভা নির্বাচনের পরে সারা দেশ জুড়ে বিজেপি আরএসএস পরিচালিত সংগঠন কখনো সংখ্যালঘু মুসলিম, কখনো দলিত শ্রেণীর মানুষদের গণধোলাই দিয়ে হত্যা করে চলেছে। নির্বাচনের আগে মালদা জেলার নিবাসী আফরাজুলকে রাজস্থানে হত্যা করা হলো, আর নির্বাচনের পরে তারই জেলায় মুসলিম হিসাবে পিটিয়ে হত্যা করা হল সানাউলকে। জয় শ্রী রাম-কে রাজনৈতিক শ্লোগান বানিয়ে সংখ্যালঘু মানুষের উপরে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে, অমর্যাদা করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে। দেশের আইন-কানুন, সংবিধান কে পুরোপুরি নস্যাৎ করে এই ধরনের কর্মকাণ্ড বাংলায় শুরু হয়েছে তখন বাংলার মানুষকে সংগঠিতভাবে এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা কর্তব্য হিসাবে সামনে চলে আসে।

সেই পরিপ্রেক্ষিতে সত্য উদঘাটনের জন্য, ৮ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে পাঁচজনের একটি প্রতিনিধি দল মালদা জেলার বৈষ্ণবনগরে চকসেহেরদি গ্রামের, গদ্দিটোলায় মৃত সানাউল শেখ এর বাড়ি যায়। বাড়িতে সানাউল এর ১৯ বছরের স্ত্রী ও মা সহ প্রতিবেশিরা হাজির হন। কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা। তিনি বলেন একদল ছেলে মোটরসাইকেলে এসে সানাউলকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হয়। এমত অবস্থায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে বেদরাবাদ গ্রামীণ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তারবাবু সানাউলকে ছেড়ে দেন, পুলিশ তাকে নিয়ে যায়। তারপর পুনরায় অনেক আঘাতের চিহ্ন নিয়ে হাসপাতালে পুলিশ নিয়ে গেলে ডাক্তার মালদা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরিত করেন। শারীরিক অবস্থা সংকটজনক খবর পেয়ে তার মা দেখা করতে গেলে পুলিশ তাদের দায়িত্ব এড়াতে সানাউলের মায়ের সাদা কাগজে টিপ ছাপ নেয় এবং অ্যাম্বুলেন্স খরচা দিয়ে তার মাকে হাসপাতালে পাঠায়। তারপর সেখান থেকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরিত করার পরেই মারা যায়।

এই ঘটনায় বিজেপির উগ্র হিন্দু সংগঠনের মারপিট করা দলের ভূমিকা আছে বলে পাড়ার সবাই জানান। ইতিমধ্যে হত্যাকারীদের অন্যতম বাপ্পা ঘোষ সহ আরো তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে শুনে পরিবারের লোকেরা খুশি হলেও, ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থার কথা বলেন। তারা আরো বলেন, ভোটের পরে এরকম পরিস্থিতি হবে তারা বুঝতে পারেনি। চারিদিকে যখন এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে তখন বিজেপি দলের পক্ষ থেকে হিন্দু-মুসলিম বিবাদ তৈরি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফন্দি ফিকির করছে। এই ঘটনার পরে আরো তিনটি ঘটনার কথা তারা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে একটি বৈষ্ণবনগর উচ্চ বিদ্যালইয়ে  একজন ছাত্র আর একজন ছাত্রকে জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করলে সে তাকে মারে। ঘটনা মারাত্মক আকার নিতে পারে বলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেশ কয়েকদিনের স্কুল ছুটি দিয়ে দেন। উত্তেজনা আর হয়নি।

আরেকটি ঘটনায়, একজন বিবাহিত মহিলা সকালে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে গেলে রাস্তায় মুসলিম যুবকরা তাকে হেনস্থা করে বলে অভিযোগ করলে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এলাকার মানুষ সত্য উদঘাটনের জন্য মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে ওই স্থানে সকলে হাজির হয়, সেখানে একজন সেলুনের মালিক উজ্জল প্রামানিক এই ধরনের কোনো ঘটনা এখানে ঘটেনি বলে সরাসরি সকলকে জানিয়ে দেন। তার পরেও ওই মহিলার দেওরকে ডাকা হয় যিনি মহিলাকে মোটর সাইকেলে করে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেন, এই রাস্তা দিয়ে তাকে মোটর সাইকেলে করে নিয়ে যাওয়া হয়নি,  অন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ঘটনাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এলাকায় উত্তেজনা থেমে যায়। আরো একটি ঘটনা, কালিনগর বাজারে একটি দোকান পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় মুসলিমদের দোষ দেওয়া হয়, ফলে উত্তেজনা বেড়ে যায়, পুলিশ ব্যাপক মানুষের উপস্থিতিতে তদন্ত করে। অবশেষে জানা যায়, অভিযোগ মিথ্যা, সে নিজের ঘরেই নিজে আগুন দিয়েছে। উত্তেজনা থেমে যায়।

এতক্ষণ সানাউল-এর হত্যার জন্য তার বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশি দুঃখ প্রকাশ করছিলেন, কিন্তু তার পরেও এই ধরনের পরিকল্পিতভাবে মুসলিম জনগণের উপরে দোষ চাপিয়ে আরো অঘটন ঘটানোর জন্য তাদের মনে ভয়ের, আতঙ্কের আভাস দেখতে পাওয়া গেল। তারা পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। কারণ তারা বলতে চেয়েছেন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের গণধোলাইয়ের পর পুলিশ বাকি কাজটা থানার মধ্যে করেছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তাহলে পুলিশের সাথে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এর কোনো গোপন আঁতাত আছে কিনা?

এই ঘটনা তদন্ত করে প্রতিনিধি দল ওই দিনই জেলা শাসক দপ্তরে সাক্ষাৎ করতে যান। অতিরিক্ত জেলাশাসক মহাশয় এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি সাক্ষাতের নিয়মকানুন মানা হয়নি বলে তিনি কথা বলতে চাননি। প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে তাকে ঘটনাটি শুনবার জন্য অনুরোধ করলে তিনি শোনেন কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। তারপর প্রতিনিধিদলটি জেলাশাসকের দপ্তরে ও পুলিশ সুপারের দপ্তরে স্মারকলিপি দিয়ে রিসিভ করে নেন

 প্রতিনিধি দল মনে করেন, মালদায় প্রশাসন আছে বলে মনে হচ্ছে না, কেমন যেন তাদের দায় ছাড়া, দায়িত্ব ছাড়া ভাব। প্রতিনিধিদলে ছিলেন, কৃষ্ণপদ প্রামানিক, ইব্রাহিম শেখ, নব কুমার বিশ্বাস, লুৎফুর রহমান, কয়েস শেখ।

মালদা মব লিঞ্চিং-এ নিহত সানাউল শেখের বাড়িতে সিপিআই(এমএল) প্রতিনিধি দল

মালদার বৈষ্ণব নগরে সানাউল শেখের বাড়িতে যান সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে ৫ জন কৃষ্ণ প্রামাণিক, ইব্রাহিম, লুৎফুর, নবকুমার, কয়েস। ছেলেটির মা তার স্ত্রী এবং প্রতিবেশিরা উপস্থিত ছিলেন। মূল আসামি বাপ্পা ঘোষ ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। তারা জানালেন এ ঘটনায় আরএসএস বিজেপির চক্রান্ত আছে, কারণ ওই ঘটনার পরে আরো তিনটি ঘটনা ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। একটা বৈষ্ণবনগরে হাই স্কুলে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেওয়ার জন্য একজন ছাত্র আর একজন ছাত্রকে চাপ সৃষ্টি করলে মারামারি হয়। ঘটনার পরে স্কুলের হেডমাস্টার ৫-৭ দিন স্কুল বন্ধ করে দেয় যাতে উত্তেজনাটা না ছড়ায়।

আরেকটি জায়গায় নিজের দোকানে আগুন লাগিয়ে মুসলিম মানুষকে দোষারোপ করে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। পুলিশ তদন্ত করলে বিষয়টি মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। আরেকটি ঘটনায় একজন বিবাহিত মহিলা তাকে মুসলিম ছেলেরা মিলিতভাবে হেনস্থা করেছে বলে জানায়, গ্রামে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তারপর সত্য ঘটনা বেরিয়ে আসে, একজন সেলুনের মালিক ওই ঘটনা মিথ্যা বলে জানায় এ সমস্ত বিষয় নিয়ে পার্টির পরিদর্শনকারী দল ডিএম দপ্তরে পার্টির পক্ষ থেকে লিখিত ভাবে জানাই, এডিএম আমাদের কথা শুনতে চাইছিলেন না পরে চাপ সৃষ্টি করার জন্য শুনলেও কিন্তু কোন কিছু করবেন বলে জানালেন না। ডেপুটেশনের কপি ডি এম দপ্তর থেকে এবং এসপি দপ্তর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয় সাংবাদিকদের ২/১ জনকে তথ্যটা দেওয়া হয়।

খণ্ড-26
সংখ্যা-20