কমিউনিট বিপ্লবী নেতা সন্তোষ রাণার জীবনাবসান হয় গত ২৯ জুন দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতলে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। কয়েক বছর যাবত থাবা বসিয়েছিল কর্কট রোগ। চিকিৎসা চলেছে সাধ্যমত। কিন্তু শেষরক্ষা করা গেল না। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী দেবী চট্টোপাধ্যায় সহ তাঁর অগণিত সংগ্রামী সাথী, বন্ধু ও গুণমুগ্ধদের। তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের, প্রগতিশীল সাহিত্য সংস্কৃতি আন্দোলন ও পত্রপত্রিকা জগতের বহু প্রতিনিধি তাঁকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানাতে সমাবেশিত হন চিকিৎসালয়ে, বাড়িতে এবং কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর দেহদানের সময়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষে তাঁর বাড়িতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন পার্টির কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী ও ঢাকুরিয়া-যাদবপুর লোকাল কমিটি সম্পাদক বাবুন চ্যাটার্জী। অন্তিম যাত্রায় অংশগ্রহণ করেন পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক পার্থঘোষ সহ কার্তিক পাল, নবেন্দু দাশগুপ্ত, দিবাকর ভট্টাচার্য, নির্মল ঘোষ, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, নিত্যানন্দ ঘোষ প্রমুখ আরও অনেকে। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল বৃহত্তর মহলে নেমে আসে স্বজন হারানো শোকের ছায়া।
সন্তোষ রাণার জন্ম পূর্বতন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল গোপীবল্লভপুরে। শহর কলকাতায় তিনি এসেছিলেন ষাটের দশকের প্রথম পর্বে। বিদ্যালয় শিক্ষা শেষে মহাবিদ্যালয়বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন। তবে তার চেয়েও বড় কথা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাশেষের সন্ধিক্ষণে নকশালবাড়ির বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ, বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ, আত্মঘোষণা, সেইসময়কার যুব-ছাত্রসমাজের সংবেদনশীল অংশের মধ্যে শিক্ষা ও মানস চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। আর সেটা হল, দেশের মানুষের দুঃসহ দূর্দিন মোচনের লক্ষ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল বদলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সময়টা তখন উত্তাল, দাবি জানাতে থাকে কৃষক সংগ্রামের দাবানল সৃষ্টি করতে হবে। এই সময়ে কালজয়ী আহ্বান দেন কমরেড চারু মজুমদার। ছাত্র-যুবরা সব “গ্রামে চলো”! কৃষকশ্রেণীকে জাগিয়ে তুলতে, তাদের সহজাত চিন্তায় চেতনার আলো দিতে, সংগ্রাম ও সংগঠনে সংগঠিত করতে ছাত্র-যুবদের নিজস্ব আত্মনোতির মোহ স্বার্থ ত্যাগ করে গ্রামে চলো! ঐ ঐতিহাসিক আহ্বানে উজ্জীবিত হয়ে দলে দলে ছাত্র-যুবরা গ্রামে যেতে শুরু করেন। সেই লংমার্চে কমরেড সন্তোষ রাণা রেখেছিলেন এক অনন্য ভূমিকা। ইতিমধ্যে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টী কেন্দ্র সিপিআই(এমএল) গড়ে ওঠায় সৃষ্টি হয় এক যুগান্তকারী উদ্দীপনা। সেই যুগসন্ধিক্ষণে কমরেড রাণা ফিরে গিয়েছিলেন যে সুদূরের গ্রাম থেকে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন সেখানেই। হাত লাগান তাঁর অণু-জন্মভূমিকে বিপ্লবী কর্মভূমিতে রূপান্তর করার কাজে। তাতে সৃষ্টি হতে থাকে বিপ্লবী কৃষক জাগরণের স্ফুলিঙ্গ – গোপীবল্লভপুর, ডেবরা, নয়াগ্রাম, বহরাগোড়া, ...।
পার্টির তদানীন্তন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির নেতৃত্বে কৃষক সংগ্রাম শাসকশ্রেণীর ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তারপর আন্দোলনে নেমে আসে ধাক্কা, আর গ্রেপ্তার হয়ে যান কমরেড সন্তোষ রাণা। বেশ কয়েক বছর কারাজীবন ভোগের পর দেশে স্বৈরশাসনের অবসান ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিঘোষণার পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনিও বেরিয়ে আসেন। তবে অত্যাশ্চর্যের মতোই একজন নির্বাচিত বিধায়ক হিসাবেও। তিনি কারাবাস অবস্থায় গোপীবল্লভপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জিতে যান। আন্দোলনে ধাক্কার মূল্যায়ন ও পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করাকে কেন্দ্র করে সিপিআই(এমএল) বিভক্তি এড়াতে পারেনি, কয়েকটি আলাদা কেন্দ্রে পরিচালিত হতে থাকে। সন্তোষ রাণা পরবর্তী অনুশীলনী প্রয়াস প্রথমে সংযত হয় পিসিসি(এমএল) কেন্দ্রে, তারপর নানা মতভেদে পিসিসি ভেঙে গেলে বিভিন্ন সমমনস্ক কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনি অনুশীলন চালিয়ে গেছেন। তাঁর রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ও সাংগঠনিক জীবনধারা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে, সক্রিয় কমিউনিস্ট অনুশীলন থেকে তিনি কখনোই বিরত হননি, যেমনভাবে পেরেছেন চালিয়ে গেছেন।
সবিশেষ উল্লেখ্য যে, তিনি ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচীতে শ্রেণীসংগ্রামের পাশাপাশি বিভিন্ন নিপীড়িত সামাজিক বর্গের (নিম্নবর্ণ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আদিবাসী সম্প্রদায়) জীবন্ত সমন্বয়ের তত্ত্বগত ধারণা ও অনুশীলনের নতুন নতুন রূপে পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারেও সময়ে সময়ে কিছু সাফল্য-ব্যর্থতা কী থেকেছে তার মূল্যায়নের ভার ভাবীকালের কাছে থাক। তিনি যে কিছু কর্মসূচীগত ও রাজনৈতিক কৌশলগত অনুশীলনে কিছু পরিবর্তন আনতে প্রয়াসী হয়েছিলেন সেই মননশীলতাকে বিনম্রতার সাথে স্বীকার করতেই হবে। তাঁর কাছে মানুষের আন্দোলনের প্রশ্নে ইস্যুটাই ছিল মূল যাচাই করে দেখার, থাকাথাকির প্রশ্নে অন্য কোনও সংকীর্ণতা ছিল না। তাই জীবনের শেষের দিনগুলোতে রোগে অশক্ত হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক বন্দীত্বের নির্যাতনের শিকার হওয়া নাগরিকদের পেনশনের দাবিতে আন্দোলনেও নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তাঁর লেখা “রাজনীতির এক জীবন” পেয়েছে “আনন্দ পুরস্কার”, এটাও একটা স্বীকৃতি, সমকালীন সংগ্রামের জীবনের। কমরেড সন্তোষ রাণা সবসময় আজকের ভারতে ফ্যাসিবাদের বিপদকে সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক হিসেবে মনে করতেন এবং তার মোকাবিলার জন্য বৃহত্তর ঐক্যের ধারণা পোষণ করতেন। ঐ ফ্যাসিবাদী শক্তি বিগত পাঁচ বছর কেন্দ্রে ক্ষমতায় থেকে অসংখ্য অপরাধ করেও বিস্ময়কর অপ্রত্যাশিতভাবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে। ঘোর অন্ধকারের রাজত্ব সর্বব্যাপী হওয়া এই সময়ে কমরেড সন্তোষ রাণার প্রয়াণ তাঁর অনুপস্থিতিকে আরও বেশি অনুভব করাবে। তবে তাঁর অবিস্মরণীয় আজীবন অবদান থেকে পাওয়া শিক্ষা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সবসময় স্মরণীয় প্রেরণার পাথেয় হয়ে থাকবে। কমরেড সন্তোষ রাণা লাল সেলাম।