কমরেড চারু মজুমদারের জন্ম শতবর্ষ এবং সিপিআই(এমএল)-এর অর্ধ শতবর্ষ উপলক্ষে ১৩ জুলাই শিলিগুড়ির রামকিঙ্কর বেইজ সভাঘরে আজকের দেশব্রতী আয়োজিত ‘ফ্যাসিবাদের উত্থান ও বামপন্থার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই এই আলোচনাসভা নিয়ে শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ির পার্টি কর্মীদের মধ্যে প্রস্তুতি ছিল তুঙ্গে। শহরের প্রায় সবজায়গাতেই পোষ্টার, ব্যানার লাগানো হয়েছিল। পাশাপাশি চলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার। ফলত শহরের নাগরিকদের মধ্যে উৎসাহ ছিল বেশ। অলোচনা সভার দিন বৃষ্টি স্নাত সন্ধ্যাবেলাতেও তাই সভাঘর ভর্তি হতে সময় লাগেনি।
পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যছাড়াও বক্তাদের তালিকায় ছিলেন শিলিগুড়ি শহরের মানুষ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অজিত রায়, প্রাক্তন অধ্যাপক সঞ্জীবন দত্ত রায়, জলপাইগুড়ি শহরের মানুষ কবি গৌতম গুহ রায়। উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক পার্থঘোষ, পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল প্রমুখ।সভা পরিচালনা করেন দার্জিলিং জেলা সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অভিজিৎ মজুমদার। মীরা চতুর্বেদীর ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি গানের মধ্যে দিয়ে সভা শুরু হয়।
সভার শুরুতে তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে অভিজিৎ মজুমদার কমরেড চারু মজুমদারের রাজনৈতিক জীবন, তাঁর নিজের শহর শিলিগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে নকশালবাড়ির পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে তাঁর যে কাজ, সেই সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করে বলেন বর্তমান সময়ে দেশ জুড়ে যে অবস্থা চলছে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বামপন্থীদের এগিয়ে আসতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, উদীয়মান দক্ষীণপন্থার বিপদের বিরুদ্ধে। অধ্যাপক সঞ্জীবন দত্ত রায়, অজিত রায়, কবি গৌতম গুহ রায় প্রত্যেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে, প্রতিদিন যেভাবে বিভাজনের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি বাড়ছে। গণতন্ত্রকে কার্যত মেরে ফেলা হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। দেশের এক অংশের মানুষের বিরুদ্ধে আরেক অংশের মানুষকে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এবং এক অংশের গণমাধ্যম এইসব প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তা খুবই বিপদজনক। এর বিরুদ্ধেই লড়াই এবং সকল স্তরের বামপন্থী এবং গণতন্ত্র প্রিয় মানুষদের সংহতি ও ঐক্যের ভিত্তিতেই বর্তমান সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ফ্যাসিবাদ হল গণতন্ত্রের বিপরীত অবস্থা। একটি উগ্র জাতিয়তাবাদের অভিব্যক্তি হল ফ্যাসিবাদ। আধুনিক রাজনীতিতে গত এক-দেড়শো বছরের ইতিহাসে জার্মানি, ইতালি সহ আজকের ভারতবর্ষে যা আবার মাথা চারা দিয়ে উঠেছে বা বলা ভাল জাঁকিয়ে বসতে চাইছে। এই উগ্র জাতিয়তাবাদের বিভিন্ন স্তর আছে, তার প্রথম স্তর হল আদর্শ বা চিন্তাধারা। তারা ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক তারা সবসময় চায় দেশের একটা অংশের সাথে আরেকটি অংশকে লড়িয়ে দিতে, তারা মনে করেন একটি জাতির উন্নয়ন তাদের এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে অন্য একটি জাতি কতটা পদানত হল তার উপর। এক জাতি অন্য জাতিকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলেই এগিয়ে যেতে পারবে। তারা কখনই এক দেশের সাথে আরেক দেশের অর্থাৎ চীনের সাথে আমাদের দেশের যুদ্ধের কথা বলে না তারা দেশের মধ্যেই এক অংশের মানুষকে পাকিস্তানের দালাল, চীনের দালাল বলে চিহ্নিত করে। অন্য অংশের মানুষদের তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে অন্দোলন যে কোনোভাবেই হোক এরা বেশ কিছু মানুষকে ফ্যাসিবাদ বা উগ্র জাতিয়তাবাদের পক্ষে বেশ কিছু মানুষকে সমাবেশিত করে ফেলে। একটি গণভিত্তি তৈরি করে।
তৃতীয় হল ক্ষমতা জাতিয়তাবাদ বা ফ্যাসিবাদ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ফেলে তখন তা হয় আরোও ভয়ানক। তখন তা শুধু আদর্শ নয়, আন্দোলন নয়, তা হল পুরোপুরি রাষ্ট্র ক্ষমতা, তার সুযোগ সুবিধা ভোগ করা নিজেদের মতো করে যা ইচ্ছে করা, যে আদর্শকে কাজে লাগিয়ে তারা গণভত্তি তৈরি করেছিল সেই গণভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা কার্যত একটি অংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি কেড়ে নিতে শুরু করে যা একটি ফ্যাসিবাদী প্রজেক্ট বা পরিকল্পনা হিসেবে কাজ করে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষত জার্মানিতে যখন ফ্যাসিবাদ আসে সেসময় কিন্তু তারা মুখে সমাজতন্ত্রের কথাই বলেছিলেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথাই বলতেন কিন্তু কিভাবে গোটা জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ তার দাঁত নখ বসিয়েছিল, বিধস্ত করেছিল সভাতাকে তা সকলেরই জানা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের আবসান হয়েছিল। লাতিন আমেরিকা ভারত সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি উপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিল ফ্যাসিবাদের যুগের হয়ত শেষ হল বিশেষত ইউরোপে কিন্তু না বেশ কিছু বছর ধরেই একটি চরম দক্ষীণপন্থী উত্থান আবারো মাথা চারা দিচ্ছে। এইসব শাসকদের মধ্যে একটা ক্ষ্যাপামো লক্ষ্য করা যায় কিছু হঠকারিতাও দেখা যায়। তারা উদ্ভট কিছু কাজ কাজ করতে পাজা, উদ্ভট কিছু কাজ করতে পারে যার কোনও হিসেব বা ব্যাকরণ নেই। কিছু কিছু অংশের মানুষের কাছে এইসব নেতারা যথেষ্ট জনপ্রিয়। কিন্তু সাধারণভাবে এই ধরনের নেতা দেখতে আমরা অভস্ত্য নই। একথা বলাই যায় যে ভারতবর্ষেনরেন্দ্র মোদী এদেরই মতো একজন।
ভারতবর্ষেযে সঙ্কট চলছে, পুঁজিবাদের যে সঙ্কট চলছে সেই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদকে অবলম্বন করছে। এটা একটি দিক ঠিকই কিন্তু এটাই সব না। এই মোদী সরকারের পেছনে আছে আরএসএস-এর মতো শক্তি যা ফ্যাসিবাদী আদর্শেকেই লালিতপালিত করে। ১৯২৫-এর জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস এই আদর্শকে লালন পালন করে এসেছে বা ওই লক্ষ্যে কাজ করে গেছে। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসাতে তাদের সেই আশা বিকশিত হয়েছে, সফল হয়েছে। ভারতের ফ্যাসিবাদ বুঝতে গেলে এই বিষয়টাকে বুঝতে হবে। ১৯২৫-এর ভারতবর্ষের পুঁজির অবস্থা আর ২০১৯-এর পুঁজির অবস্থা এক না। সে সময় ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন উপনিবেশ, কিন্তু এখন তথাকথিত স্বাধীন। সে সময় আমরা জাতিয়তাবাদ বলতে বুঝতাম ইংরেজদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে হবে। ব্রিটিশ বিরোধী সরকার হল জাতিয়তাবাদের মুখ। কিন্তু আরএসএস কিন্তু জাতিয়তাবাদ বলতে মনে করে সেই যে হাজার বছরের বশ্যতা তুর্কী আমল মোঘল আমলে তার থেকে মুক্তি। তারা বলত ইংরেজ তো দুদিন এসেছে চলে যাবে কিন্তু একটি অখন্ড ভারতবর্ষ গড়ে তুলতে হবে। যারা অর্থাৎ এই তুর্কী মোঘলদের যে কোনও শর্তেই এদেরকে নির্মূল করতে হবে। মুসলিমদের বশ্যতায় এই দেশ থাকবে না। শুধু হিন্দুরাই এখানে রাজত্ব করবে। যে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল তা কতটা ভুল ছিল তা ১৯৭১-এ বাংলাদেশ গঠন হওয়ার সময় বোঝা যায়। ধর্ম এক, জাতি এক, কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি আলাদা। এই ইতিহাসকে মনে রাখতে হবে। আরএসএস তা ভুলিয়ে দিতে চাইছে। আর এস এস সুযোগ খুঁজছিল। যদিও এই সুযোগ আরা এর আগে ১৯৭৭-এ পেয়েছিল জনতা দল তখন ক্ষমতায় এসেছিল, অটল বিহারী বাজপেয়ী ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং আদবানী ছিলেন তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী যার ফলে বিভিন্ন কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আর এস এর লোককে তারা বসানোর সুযোগ পেয়ে যায়। এবং নিজেদের গোছাতে শুরু করে যার পরিপূর্ণ সুযোগ তারা পায় ২০১৪-তে যখন কিছু বিষয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যায় এবং বিজেপির পক্ষে যায়। একটি হচ্ছে দুর্নীতি, আরেকটি যাকে বিজেপি বলছে বংশবাদ বা পরিবারতন্ত্র। কংগ্রেস, মায়াবতী, লালু, মমতা ব্যানার্জি সবারই দলেই পরিবারতন্ত্রই প্রাধান্য পায়। সেই অর্থে বিজেপি নাকি ব্যাতিক্রম। এই কয়েকটা প্রশ্নে তারা জাঁকিয়ে বসল।
আমরা ভেবেছিলাম ২৯১৯-এ তারা ধাক্কা খাবে, যে ধাক্কা তারা মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, ছত্রিশগড়, রাজস্থানে পেয়েছে। কিন্তু তা হল না। হল না, তাহলে কি আন্দোলন ছিল না, ছিল ছাত্র-যুবদের আন্দোলন, কৃষক-বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন প্রতিবাদ সর্বত্র ছিল, কিন্তু তাহলে ধাক্কা খেল না কেন? কারণ তারা ঠিক নির্বাচনের আগে পুলওয়ামা বালাকোটের ঘটনার মাধ্যমে দেশের মানুষকে বোঝাতে চাইল তোমরা যে অভিযোগ করছো তা ঠিক কিন্তু আগে তো দেশ বাঁচুক দেশের মানুষ বাঁচুক তারপর সব শোনা যাবে। এই যে মোদীর হাতে সব কিছু মোদী সব পারবে এসব বলে ছাত্র অন্দোলন কৃষক আন্দোলন প্রতিবাদ প্রতিরোধে থেকে আসল সত্যি থেকে মানুষের চোখ সরিয়ে দেওয়াই ছিল এদের উদ্দেশ্য। মোদীকে ভোট দিন না হলে পেনশন, ঘর বানানোর টাকা, বিভিন্ন ভাতা যা পাচ্ছিলেন সব বন্ধ হয়ে যাবে এই যে ভয় মানুষকে দেখানো হয়েছে, মানুষকে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। যে অঘোষিত জরুরী অবস্থার কথা বলা হচ্ছিল বা হচ্ছে মনে রাখতে হবে তার মধ্যেই নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সমস্ত মেশিনারি বিজেপি তথা আরএসএস-এর হাতে। ফলত যা হওয়ার তাই হয়েছে। বিজেপি সর্ববৃহৎ দল হিসেবে ক্ষমতায় এসেছে। দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি কংগ্রেসের ভোট ১৮ থেকে ২০%-এ নেমে গেছে। ভারতবর্ষের আঞ্চলিক দলগুলির অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। উড়িষ্যা এবং বাংলাতে বিজেপি তার ভোট প্রাপ্তির হার বাড়িয়েছে বেশ খানিকটা। স্বাভাবিকভাবেই এই রাজ্য সহ সমগ্র দেশেই বামপন্থীরাও সঙ্কটের মুখে।
এমতো অবস্থায় যারা ভাবছেন এই রাজ্যে মমতা বা তৃণমূলই প্রধান শত্রু তাদেরকে একটাই কথা বলার হ্যাঁ মমতা হঠকারি কথা বলেন, ক্ষ্যাপামো করেন যা ইচ্ছে তাই সিদ্ধান্ত নেন, মোদী আর মমতার পার্থক্য আপাত দৃষ্টিতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হলেও মমতার সঙ্গে কিন্তু আরএসএস নেই একথা মনে রাখতে হবে। মমতার সঙ্গে বড়জোর সিন্ডিকেট আছে, মোদী যা করে দেশ জুড়ে করে, আর মমতা তা একটি রাজ্যে করে। তাহলে এমতো অবস্থায় কি করা উচিৎ বামপন্থীদের? মোদীর যে ইমেজ বিজেপি তৈরি করেছে মোদী থাকলে সব সম্ভব। মোদী সব পারে। এই যে ইমেজ, যে মোদী নোট বাতিল করেছে, দাঙ্গা লাগিয়েছে, জিএসটি করেছে মানুষ কিন্তু সেই মোদীকে ভোট দিচ্ছে না ভোট দিয়েছে বিজেপি আরএসএস-এর তৈরি মোদীর কাল্পনিক ইমেজকে। এবং এরা আস্তে আস্তে এই ফ্যাসিস্ট সরকারের থেকে ব্যবস্থাটাকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবে যেখানে এরাই হবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারি। সমস্ত সাংবিধানিক অধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। তাই এখনও অবধি যদি প্রাথমিক শত্রুকে চিনতে না পেরে থাকেন বামপন্থী বন্ধুরা তাহলে চিনে নিন ‘আগে রাম পরে বাম’ এই মোহগ্রস্ততা ছেড়ে বেরিয়ে আসুন, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এই ফ্যাসিবাদকে রুখে দিন। যেখানে সম্মিলিত প্রতিবাদ সম্ভব না সেখানে নিজেরাই বা সেই মুহূর্তে যাদেরকে পাবেন তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই প্রতিবাদ জারি রাখুন, প্রতিবাদের সাহস বজায় রাখুন। এই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট সরকারের সমস্ত ধরনের ধর্মীয় উন্মত্ততা বিভাজনের রাজনীতির অপচেষ্টাকে রুখে দিয়ে বিকল্প দিন আনতে পারে সংগ্রামী বামপন্থাই। আসুন সকলে মিলে সংহতির মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।