দেশটা ভারতবর্ষ। মোদীর ‘নিউ ইন্ডিয়া’। বীভৎসতা, নারকীয়তা’ — এই শব্দগুলোকে বিগত পাঁচ বছরে আমরা অনেকটা পরিপাক করে নিয়েছি। এগুলো আজ ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে যাচ্ছে। ধর্মের কারণে, জাতের কারণে মানুষকে যখন তখন পিটিয়ে নৃশংস অত্যাচার করে মারা, হেনস্থা ও নিগ্রহ করা — এগুলো উচ্ছৃঙ্খল জনতার কাছে ‘বিনোদন’ হয়ে উঠছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় বা প্রচ্ছন্ন মদতে। এ হেন এক পরিস্থিতিতে সরকারের নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যের চূড়ান্ত অমানবিক আরেকটি ছবি ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করল গত প্রায় তিনটি সপ্তাহ ধরে। বিহারের মুজফ্ফরপুরের ঘটনা সবারই জানা।
এ নিয়ে কিছুটা শোরগোল উঠেছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে। তার অভিঘাতে প্রশাসনিক স্তরে একটু নড়েচড়ে বসা, একটু তৎপরতা দেখানো — আবার সব স্তিমিত হয়ে যাবে যথারীতি। কারণ মারা গেছে হতদরিদ্র মাল্লা, মুশাহার টোলার বাচ্চারা যাদের দিনের পর দিন না খেয়ে কাটে। যাদের পরিবার আর্থিক-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া, দলিত শ্রেণির।
১৯৯৫ সাল থেকে বছরের পর বছর বিহারে তীব্র গরমের সময় অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম (এইএস) স্থানীয় মানুষজন যাকে ‘চমকী জ্বর’ বলেন, তাতে আক্রান্ত হয়ে শিশুরা মারা যায়। শুধু মুজফ্ফরপুর নয়, আশপাশের আরও বহু অঞ্চল ঔরঙ্গাবাদ, সারান, পূর্বচম্পারণ, সীতামারী, বৈশালী, সমস্তিপুর থেকেও আক্রান্ত শিশুরা হাসপাতালে এসেছে।
গত ২০১৪-তে এইএস (এ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম)-এ মারা গিয়েছিল ৩৭২টি শিশু। এখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা: হর্ষবর্ধন তখনও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১০০ বেডের আইসিইউ সহ পরিকাঠামোগত অনেক উন্নতির ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কার্যত কিছুই হয়নি। ২০১৬-তেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার — প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে শিশুদের রক্তে গ্লুকোজ মাপার ব্যবস্থা রাখার, গ্লুকোজ ড্রিপ দেওয়ার, স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের অভিভাবকদের শিশু সুরক্ষার প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবে তা হয়নি।
বিহারের স্বাস্থ্য দপ্তরের বিবৃতি অনুযায়ী ১জুন থেকে ১৭জুনের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা এইএস আক্রান্ত ৩১২টি শিশুর মধ্যে ৮৫টি শিশু মারা যায়। এর মধ্যে ৩ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ছিল ৪৮জন। ৩ বছরের নিচে ছিল ২৯টি শিশু। ২৩ জুনের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এইএস আক্রান্ত মৃত শিশুর সংখ্যা ১৬৩-তে পৌঁছায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে এইএস-এর প্রাদুর্ভাবের কারণ তীব্র দাবদাহ, শিশুদের দীর্ঘদিন ধরে অপুষ্টিতে ভোগা, পরিস্রুত পানীয় জলের ভয়ংকর সংকট।
আর এই মৃত্যু মিছিলের কারণ অবশ্যই হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিকাঠামো না থাকা। উপযুক্ত সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী না থাকা। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র না থাকা। গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী না থাকা। সমস্ত ক্ষেত্রে অপ্রতুলতার কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার প্রশ্নে চূড়ান্ত অব্যবস্থাও দায়ী এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য। এমনটা জানিয়েছেন গোরক্ষপুরের সেই ডা: কাফীল যিনি মুজফ্ফরপুরে এসে ক্যাম্প করে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করছেন।
এই রোগে প্রচণ্ড তাপ ও আদ্রর্তার কারণে শিশুরা ডিহাইড্রেশন-এ আক্রান্ত হয়। রক্তে শর্করার পরিমাণ প্রচণ্ড কমে যায় যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়।
প্রাথমিক উপসর্গ মাথাব্যথা। প্রবল জ্বর খিঁচুনি — অনেক সময় কোমাও। মস্তিষ্কে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের স্ফীতি ঘটে। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে গ্লুকোজ দেওয়া গেলে অবস্থার অবনতিকে আটকানো যায়।
ঘটনাক্রমে এই চমকী জ্বরে সবচেয়ে প্রভাবিত পাঁচটি জেলাই লিচু উৎপাদক জেলা হিসেবে পরিচিত। আর রোগটির দাপটও দেখা যায় লিচুর মরশুমেই। স্বাভাবিক ভাবেই মৃত্যুর সঙ্গে ‘লিচু’র যোগকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনই নিশ্চিত যোগের কথাও বলা যায় না।
ফিরে আসি সেই কথায়। প্রতি বছর মারা যায় হদ্দ গরিব পরিবারের শিশুরা — যারা রাতে খালি পেটে ঘুমিয়ে পড়ে। ওরাই মারা যাচ্ছে, হয়তো আগামী বছরেও এমন মর্মন্তুদ ঘটনার সাক্ষী থাকতে হবে এই অভাগা দেশকে!
আর গরিব বলেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে মৃত্যুমিছিল চলার পর সময় পেলেন হাসপাতাল পরিদর্শনে যাওয়ার! গরিব বলেই রাজ্যের বিজেপি উপমুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নকে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে এড়িয়ে যান। গরিব বলেই রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী শিশুমৃত্যু নিয়ে জরুরী বৈঠকে ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচের স্কোর জানতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন! শুধু তাই নয়। এই বিজেপি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় ‘এমন তো বছর বছরই হচ্ছে। ও বর্ষা পড়লে এমনিই কমে যাবে।’ গরিব বলেই বৈশালীর হরিবংশ গ্রামের মানুষরা পানীয় জলের জন্য বিডিও-র কাছে পাগলের মতো ছুটে গেলে তিনি কর্ণপাত করেননি।
উপরন্তু পানীয় জলের অভাবে অসুস্থ গ্রামের দশটি (এ পর্যন্ত ১১টি) শিশু মারা গেলে তাদের পরিবার যখন অসহায় রাগে দুঃখে গ্রামের মধ্যেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন,পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে।
শিশু মৃত্যুর এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি শিশুমৃত্যু বন্ধে শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়ে একটি জনস্বার্থমামলা দায়ের করা হয়। গত ২৪ জুন সুপ্রিম কোর্ট শিশুমৃত্যুর ব্যাপারে ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ও বিহার সরকারকে হলফনামা সহ রোগ প্রতিরোধে তাদের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে।
বৈশালীর হরিবংশ গ্রামের তিন বছরের ছোট্ট বিরজু আজ আর নেই। ওর বাবা দিলীপ মাঝি একজন নির্মাণ শ্রমিক। দৈনিক ২০০টাকা আয়। মাসে দশ দিনও কাজ জোটে না। অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া ৫০০টাকা যোগাড় করতে পারেন নি। ঘরেই চোখের সামনে নেতিয়ে পড়ল চনমনে দুরন্ত ছেলেটা।
ঘরে ঘরেই গুমরে আছে এরকম অনেক বুকভাঙ্গা কাহিনি। না পারার, হেরে যাওয়ার কাহিনি। সত্যিই কি ওদের ‘হেরে যাওয়া’? কেন বাড়ির কাছাকাছি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই? আছে যদি তো ওষুধ, ডাক্তার, অ্যাম্বুল্যান্স, স্বাস্থ্য কর্মী কেন নেই? কেন সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড, আইসিইউ, ডাক্তার, নার্স, ওষুধ নেই?
কেন প্রত্যন্ত গ্রামে বিদ্যুৎ নেই? আছে যদি তো এমন বেহাল পরিষেবা কেন? গ্রামে শুদ্ধ পানীয় জল নেই কেন? কেন হাজার হাজার বিরজুরা দু’বেলা ভরপেট খেতে পায় না?
সবকা সাথ সবকা বিকাশ, সবকা বিশোয়াস — মোদী সরকারের এই শ্লোগান নির্মম প্রহসন! কেন এই প্রহসন?
এই প্রশ্নগুলোই ছুঁড়ে দিয়েছেন, প্রবল ক্ষোভ ও ঘৃণা উগরে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ নিষ্ঠুর অবিবেকী প্রশাসনের উদ্দেশে — মন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক আমলাদের উদ্দেশে। বিহারের বিরোধী রাজনৈতিক মহল, বিশেষ করে ভাকপা(মালে)-র সিপিআই(এমএল) লিবারেশন রাজ্য নেতৃত্ব প্রশাসনিক এই চরম গাফিলতির বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ জানিয়েছেন, রাস্তায় নেমেছেন। ভাকপা(মালে)-র রাজ্য সম্পাদক কুণাল ও বর্ষীয়ান নেতা রাজা রামের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধানকারী টীম গত ১৯ জুন মুজফ্ফরপুরে যায় ও চারদিন ধরে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখে। সেখানে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যদি গ্রাম ও পঞ্চায়েত স্তরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে এমার্জেন্সি পরিষেবা চালু থাকতো, যথেষ্ট ডাক্তার ও নার্স সহ, তারা যথাযথ ভূমিকা নিতে পারত এবং বহু মৃত্যু এড়ানো যেত। চিকিৎসকরা সরকারের কাছে বারে বারেই এই দাবি জানিয়েছেন কিন্তু তা উপেক্ষিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ হাসপাতালে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন দশটি এ ই এস-আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা পরিকাঠামো নিয়ে তাদের একশোটি শিশুকে চিকিৎসা করতে হয়েছে। ১৪টি থেকে পরে ৫০টি আই সি ইউ-এর ব্যবস্থা করলেও এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তা কিছুই নয়। তার ফল যা হওয়ার হয়েছে। তাই এই শিশুমৃত্যুর দায় নিতে হবে নীতিশ কুমারের সরকারকে। এই অনুসন্ধানে যেটা উঠে এসেছে — ১) শ্রীকৃষ্ণ হাসপাতালে আই সি ইউ সংখ্যা ২০০ করলে শিশুরা জরুরী চিকিৎসা পেত এবং বহু প্রাণ বেঁচে যেত। এর জন্য সরকারের খুব বেশি খরচ হত না। ২) প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও উপকেন্দ্রগুলিতে ডাক্তার, ওষুধ, অ্যাম্বুল্যান্স এই মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। ৩) পর্যাপ্ত পানীয় জল, গ্লুকোজ, ভরপেট খাবার অনেক মৃত্যু ঠেকাতে পারত।
বছর বছর কেন একই ঘটনা, কেন এই মৃত্যু পরম্পরা — তা নিয়ে গবেষণা এবং তার স্থায়ী প্রতিরোধে একটি কার্যকরী পরিকল্পনা নেওয়া ও কার্যকর করা দরকার ছিল। শিশু মৃত্যুর শুরুতেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা দরকার ছিল। এর জন্য সরকারের বিশাল আর্থিক চাপ পড়ত না। দরকার ছিলো শুধু একটু সংবেদনশীলতা!
ভাকপা(মালে) বিধায়ক মেহবুব আলমের নেতৃত্বে আরেকটি অনুসন্ধানকারী টিমও বিভিন্ন হাসপাতালে আক্রান্ত শিশু ও পরিজনদের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখেন।
বিহারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পাণ্ডেয়-কে বরখাস্ত করা সহ বিভিন্ন দাবিতে বিহার আইসা, আইপোয়া, আরওয়াইএ সহ (মালে)-কর্মীরা প্রবল প্রতিবাদে দুদিন ধরে রাজপথ উত্তাল করে তোলেন।
শুধু একটু সংবেদনশীলতা এই মৃত্যুমিছিল রুখতে পারত। যেমন পারত তীব্র তাপপ্রবাহে গয়া ও ঔরঙ্গাবাদ জেলায় ২০০টি গরিব মেহনতি মানুষের প্রাণ চলে যাওয়া রুখতে।