আদিবাসীদের অধিকারের বিরুদ্ধে নতুন করে সর্বাত্মক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার

ফেব্রুয়ারি মাসের কুখ্যাত রায় দেশজুড়ে ধিক্কৃত হওয়ার পর তা সাময়িকভাবে স্থগিত অবস্থায় আছে। পরবর্তী শুনানি আছে আগামী ২৪ জুলাই ২০১৯। সেদিন কি আরো একবার লক্ষ লক্ষ আদিবাসীকে উচ্ছেদের রায় পুনর্ঘোষণা করবে সুপ্রিম কোর্ট? এই রায়টি আসে মূলত বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের যুক্তিতে। মামলাকারীদের বক্তব্য ‘অরণ্যের অধিকার স্বীকৃতি আইন, ২০০৬’ বনসংরক্ষণের বিরোধী এবং বনাঞ্চলে বসবাসকারীরা আসলে চোরা শিকারীদের সহযোগী, তাই বনাধিকার আইনটি বাতিল করতে হবে এবং বনের ভেতরে বসবাসকারী মানুষদের বন থেকে সরিয়ে দিতে হবে। ২০০৮ সাল থেকে এই মামলা চলে এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৯-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি রায় আসে যে বনের ভেতর বসবাসের জন্য রাজ্য সরকারগুলির কাছে করা আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরও যারা বনের ভেতরের গ্রামগুলিতে আছেন তাঁদের সকলকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে। কেন্দ্র সরকারের আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে সেই সংখ্যা প্রায় ২৩ লক্ষ।

“আমরা এই রায়কে বন-সংরক্ষণের পক্ষে বলে মনে করি না। বরং এই রায় ভারতে বন-সংরক্ষণের পক্ষে এক প্রকৃত বিপর্যয়” — ভারতের তিরিশ জন প্রখ্যাত সংরক্ষণবাদীর স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে একথা বলা হয় এবং দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞগণ এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন। ‘নেচার কনসার্ভেশন ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’-র পক্ষ থেকেও অনুরূপ বিবৃতি দিয়ে এই রায়কে আদিবাসী জনজীবন ও বন-সংরক্ষণ উভয়ের পক্ষেই বিপর্যয়কর বলে আখ্যা দেয়া হয়। আসলে আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বজন স্বীকৃত নীতি এটাই বলে যে অরণ্য সংরক্ষণের টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত মডেলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল স্থানীয় জনগোষ্ঠিগুলির অধিকার স্বীকার করা। এই নীতি এখন আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে মান্য হচ্ছে। পৃথিবীর যে যে দেশে স্থানীয় জনগোষ্ঠিগুলির এই অধিকার স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই সেই দেশে অরণ্য ধ্বংসের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে ও কার্বন ভাণ্ডার বেড়েছে। ভারতের আদালতে যখন এই পশ্চাদমুখী রায় আসছে তখন, গত ফেব্রুয়ারি মাসেই, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়োকো ভিদোদো তাঁদের দেশের বৃহৎ বনভূমি সংরক্ষণের দায়ভার ও অধিকার সরকারিভাবে তুলে দিলেন সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের হাতে। ভারতের ক্ষেত্রে ‘অরণ্যের অধিকার স্বীকৃতি আইন’ কেবলমাত্র জমি বা গৌণ বনজ সম্পদের ওপর আদিবাসী ও পরম্পরাগত বনবাসীদের অধিকারকে স্বীকার করার কথা তো বলেইছে, উপরন্তু বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের আইনী ক্ষমতাও তাঁদেরকে দিয়েছে (বা এক্ষেত্রেও বলা ভালো যে ‘স্বীকার করে নিয়েছে’, কারণ তারও দুই দশক আগে মহারাষ্ট্রের অরণ্যচারী গোন্দ আদিবাসীরা ঘোষণা করেছিল যে তাঁরাই এবং একমাত্র তাঁরাই অরণ্যের জীববৈচিত্র্য সহ সমস্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করেন ও করবেন)। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল সেই আইনকে খর্ব করার প্রচেষ্টা প্রথম থেকেই চলেছে। বৃহৎ পুঁজি ও ফরেস্ট অফিসারদের চক্র ২০০৮ সালে আলোচ্য মামলাটি করেছিল অরণ্যের অধিকার আইনকে বাতিল করার আবেদন জানিয়েই। বিজেপি সরকার শুনানিগুলিতে হাজির হয়নি। বনাধিকার আইনটি পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়ার আবেদন সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেয়, কিন্তু বনের জমিতে পাট্টার আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়া সকলকে অবিলম্বে বনভূমি থেকে বহিষ্কার করার আদেশটি দেয়। এই আদেশও কি কার্যত অরণ্যের অধিকার আইনকেই নাকচ করা নয়! “এই রায়ের মূল প্রতীতিটাই ভ্রান্ত কারণ এটা আদিবাসীদেরকে অরণ্যের বে-আইনী বাসিন্দা হিসেবে মনে করছে—অথচ আদিবাসীরাই তো ওই জমি ও অরণ্যের প্রকৃত মালিক”, বিবৃতি দিয়ে একথা জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের আদিবাসী অধিকার বিভাগের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া তাওলি-সোরপুৎস। তিনি আরও বলেন যে আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠিগুলিকে জবরদখলকারী হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু বাস্তবে ওই জমি তাঁদেরই এবং তাঁরাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওই ভূমি ওই অরণ্য রক্ষা ও পালন করে আসছেন।

tribal

 

কিন্তু সম্প্রতি জল আরও অনেকদূর গড়িয়েছে। আমরা জানি যে ব্যাপক বিরোধিতার ফলে কেন্দ্র সরকার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানোর পর উক্ত রায়টি স্থগিত আছে; পরবর্তী শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যগুলির কাছে হলফনামা চেয়েছে, রাজ্যগুলি কোন যুক্তিতে আদিবাসীদের এত এত আবেদন খারিজ করেছে তা জানতে চেয়েছে। এই বিষয়ের প্রস্তুতি নিতেই বুঝি কেন্দ্রীয় আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা গত ১৮ জুন দিল্লীতে রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছিলেন। এই বৈঠকের কোনও রিপোর্ট এখনও সামনে আসেনি। মন্ত্রকের তরফে কোনও বিবৃতি এখনও সরকারি প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর সাইটে আসেনি। কিন্তু একটি বিষয় চর্চায় চলে এসেছে যে ‘ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট’ সংশোধন করা হচ্ছে যা ব্রিটিশ জমানার আইনের থেকেও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। সংশোধনের খসড়াটি ইতিমধ্যেই লিক হয়েছে। সামান্য কিছু লেখালিখিও হয়েছে তা নিয়ে। নতুন আইনে ফরেস্ট অফিসিয়ালদের হাতে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে :

  • অরণ্য ও ব্যাঘ্র প্রকল্পের এলাকাগুলির ব্যাপক সামরিকীকরণ হবে, হাজার হাজার অরণ্য প্রহরিদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত করা হবে;
  • অরণ্য ‘রক্ষা’ করতে মানুষের ওপর গুলি চালানোর ক্ষমতা থাকবে তাদের, এবিষয়ে জবাবদিহিও করতে হবেনা কাউকে;
  • গুলি চালানো, তল্লাসি, সম্পত্তি ক্রোক করা ও গ্রেপ্তার করার অধিকার দেওয়া হচ্ছে বনদপ্তরের কর্মীদের;
  • এজন্য অরণ্যের ভেতর থানা-হাজতও তৈরি হবে;
  • অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে নির্দোষ;
  • সংরক্ষণের প্রয়োজনে অরণ্যের অধিকার আইনকেও লঙ্ঘন করার ক্ষমতা থাকবে রাজ্য সরকারগুলির।

২০১৫ সালের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে অরণ্যের অধিকার আইন (২০০৬) অনুযায়ী ১,৭০,০০০ (এক লক্ষ সত্তর হাজার) গ্রামের — যা দেশের সর্বমোট গ্রামের এক চতুর্থাংশ — নিজেদের ‘রাজস্ব-গ্রাম’ সীমানার মধ্যে সমষ্টিগত অরণ্য অধিকার পাওয়ার কথা। দেশের ৪ কোটি হেক্টর বনভূমির ওপর ১৫ কোটি বনবাসী বা অরণ্য নির্ভর মানুষের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই অর্থে এই আইন দেশের সবচেয়ে বড়ো ভূমি সংস্কার কর্মসূচীর ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কী করে তা হবে! দেশের রাজনীতি ভিন্নপথে চলছে। বিপুল অরণ্যভূমির বনসম্পদ ও মাটির নীচের খনিজ সম্পদ লুট করতে মরিয়া বড়ো বড়ো পুঁজিপতি গোষ্ঠি। শাসক নেতারা এইসব গোষ্ঠির স্যাঙাতের ভূমিকায়। তাদের নির্দেশে বন সংরক্ষণের নামে আদিবাসীদের ‘শুট অ্যাট সাইট’ নীতি ঘোষিত হচ্ছে, আর অন্যদিকে আদানী গোষ্ঠিকে দিয়ে দেওয়া হল প্রায় দুলক্ষ হেক্টর গভীর অরণ্যের মালিকানা। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি দেশের আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বও ঐসব কর্পোরেট গোষ্ঠির হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সেক্রেটরিয়েটের ৬০% ডেপুটি ও ডিরেক্টর পদে আইএএস অফিসারের বদলে কর্পোরেট গোষ্ঠিগুলির কর্মচারীদের বসানোর নির্দেশ জারি করেছে। বন ও খনি লুট করছে যে পুঁজিপতি গোষ্ঠি তার কোনও দুঁদে কর্তাই হয়ত অরণ্য ও পরিবেশ দপ্তরের ডিরেক্টর পদে বসবে। সব মিলিয়ে দেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধে এক নতুন মাত্রার যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ-পর্ব পেরিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ভারতে গণতন্ত্র যেটুকু এগিয়েছিল তা বিজেপি জমানায় এসে প্রবল গতিতে পেছন দিকে চলতে শুরু করেছে।

ব্রিটিশ রাজত্বেও কি এই মাত্রার সংকটে পড়েছিল আদিবাসীরা? এরকম দীর্ঘায়িত অত্যচারের শিকার হয়েছিল? সিদো ও কানো, ফুলো ও ঝানো হুলবিদ্রোহ করে বহু সাথিদের সাথে শহীদ হয়েছিল। সেই লড়াই সাঁওতাল পরগণা টেনান্সি অ্যাক্ট হিসেবে আদিবাসীদের অধিকার ছিনিয়ে এনেছিল। ধরতি আবা বিরসার উলগুলান ছোটোনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট লাগু করিয়েছিল। তখন দেশ পরাধীন ছিল। এখন তো স্বাধীন। অথচ আরও এক হুল, আরও এক উলগুলান কেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে?

খণ্ড-26
সংখ্যা-19