ষাটের দশক থেকে আধুনিক ভারতীয় নাটকের এক নতুন যুগ শুরু হয়। এই সময় থেকে তিন দিকপাল নাট্যকার পাশাপাশি লিখতে থাকেন তাঁদের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলি। বাংলায় বাদল সরকার, মারাঠিতে বিজয় তেন্ডুলকর এবং কন্নড়ে গিরিশ কারনাড। এই নাটকগুলির অভিনয় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায় এবং অনুবাদের মাধ্যমে ভাষার সীমানা পেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গিরিশ কারনাড তাঁর দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবনে অসংখ্য নাটক লিখেছেন, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন, অভিনয় করেছেন কন্নড় ও বলিউডি চলচ্চিত্রে। তবে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তির কথা বলতে গেলে বলতে হয় কয়েকটি অসামান্য নাটকের কথাই। এগুলির মধ্যে আছে তুঘলক, হয়বদন, নাগমণ্ডল, তালেদণ্ড ইত্যাদি।
প্রথম বিখ্যাত নাটক তুঘলক লেখার আগে গিরিশ কারনাড লিখে ফেলেছিলেন ‘মা নিষাদ’ নামে একটি একাঙ্ক এবং যযাতি নামে পূর্ণদৈর্ঘের এক নাটক। তবে আলোড়ন তৈরি করল ১৯৬৪ সালে লেখা তুঘলক নাটকটি। হিন্দিতে এর অনুবাদ করলেন বি ভি করন্থ, বাংলায় চিত্তরঞ্জন ঘোষ ও স্বপন মজুমদার। ইব্রাহিম আলকাজী, প্রসন্ন, অরবিন্দ গৌড়, দীনেশ ঠাকুরের মতো খ্যাতনামা নির্দেশকেরা আলাদা আলাদাভাবে এর মঞ্চ প্রয়োগ করলেন।
তুঘলক নাটকটির বাংলা মঞ্চ উপস্থাপনা বহু দিকপাল বাঙালি নাট্যব্যক্তিত্বকে এক মঞ্চে নিয়ে আসে ১৯৭২-এর এক ঝোড়ো সময়ে। কোলকাতার বুকে কয়েকটি নাট্যদল মিলিতভাবে শ্যামানন্দ জালানের নির্দেশনায় এই নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। এতে তুঘলকের ভূমিকায় অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র, সৎমার ভূমিকায় কেয়া চক্রবর্তী, ঘোষকের ভূমিকায় অরুণ মুখোপাধ্যায়, বরনীর ভূমিকায় রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শেখ ইমামুদ্দিন এর ভূমিকায় কুমার রায়, শহাবুদ্দিনের ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত প্রমুখ যুগন্ধর শিল্পীরা। মঞ্চ পরিকল্পনায় ছিলেন খালেদ চৌধুরী, আলো করেছিলেন তাপস সেন।
বাংলায় যখন তুঘলকের প্রথম অভিনয় হচ্ছে, সেই আলোড়ন তোলা উনিশশো বাহাত্তরেই গিরিশ লেখেন হয়বদন নামে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকটি। বাংলায় এর অনুবাদ করেন শঙ্খ ঘোষ, প্রযোজনা করেন নির্দেশক শ্যামল ঘোষ, তাঁর নক্ষত্র দলের পক্ষ থেকে। হয়বদন এর অনুবাদ ছাপা হয়েছিল শম্ভু মিত্রের বহুরূপী পত্রিকায়। ১৯৭৪ সালে তাঁর করা বাদল সরকারের এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকের অনুবাদ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করে।
১৯৮৮-তে রচিত হয় তাঁর আর একটি বিখ্যাত নাটক নাগমণ্ডল। এবং ১৯৯০ তে তালেদণ্ড। রক্তকল্যাণ নামে এর বাংলা অনুবাদ করেন শঙ্খ ঘোষ, তালেদণ্ড কথাটির আক্ষরিক অর্থ অবশ্য শিরচ্ছেদের শাস্তি। মণ্ডল কমিশন ও বাবরি মসজিদ নিয়ে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এই নাটকটি রচিত। গিরিশ কারনাড নিজেই এর ইংরাজী অনুবাদ করেন, দ্রুতই হয় রাম গোপাল বাজাজ এর হিন্দি অনুবাদ। ১৯৯২ সালের শুরুতেই ইব্রাহিম আলকাজির নির্দেশনায় দিল্লির এনএসডি রেপার্টরি এটি মঞ্চস্থ করে। গিরিশ কারনাড ছিলেন এক উজ্জ্বল ছাত্র। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোডস স্কলার। তাঁর নাটক খ্যাতি পেয়েছে গোটা দেশ এবং দেশের বাইরে। সিনেমার জন্য যেমন বেশ কয়েকবার জাতীয় পুরস্কার ও ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, তেমনি থিয়েটার সিনেমা সহ গোটা শিল্পজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, সাহিত্য একাডেমি, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রভৃতি।
গিরিশ কারনাড তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে শিল্পে এবং শিল্পের বাইরে সবসময়েই স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে এসেছেন। বিভেদ ও সংঘর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে গিরিশ কারনাডের নাটককে বুঝতে চেয়ে আমরা একটু বিশেষভাবে যদি তাঁর প্রথম দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের নাটকের দিকে তাকাই, তবে দেখি তার একটি ছিল হিন্দু পুরাণ কেন্দ্রিক যযাতিকে নিয়ে, অন্যটি মুসলিম সুলতান তুঘলককে অবলম্বন করে। আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে বহু উপাদানের সহজ স্বাভাবিক মেলবন্ধনের দিকটি নিয়ে গিরিশের ভাবনাটি এ থেকে বোঝা যায়।
গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডের পরে বা আর্বান নকশাল নাম দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের ধরপাকড়ের পর্বে অসুস্থ শরীরে অক্সিজেনের নল নাকে নিয়ে গিরিশ কারনাড প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। এক দায়বদ্ধ শিল্পীর ছবিটি আমাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।