শ্রদ্ধাঞ্জলি : সহযোদ্ধা

২০১৯ এর তৃতীয় দিনে ৭৯ বছর বয়সে চলে গেলেন দিব্যেন্দু পালিত। বাংলা হারাল এক প্রথিতযশা সাহিত্যিককে। ১৯৩৯ সালের ৫ মার্চ তাঁর জন্ম অধুনা বিহারের ভাগলপুরে। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে ভাগলপুর একটি পুণ্যতীর্থ। বাংলা সাহিত্যের অনেক অবিস্মরণীয় ব্যাক্তির বিচরণভূমি ছিল ভাগলপুর। ভাগলপুরের মাটিতে-প্রতিবে মনের কৃষিকাজের যে উর্বর ভূমি ছিল, সেই উত্তরাধিকারেরই স্বাভাবিক সন্তান ছিলেন দিব্যেন্দু পালিত। ১৯৫৫তে তাঁর প্রথম লেখা গল্প ‘ছন্দপতন’ আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রে ছাপা হয়। খুব অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার ফলে তাঁকে সংসারের দায় বহন করতে হয়েছে। জীবনের সেই সংঘর্ষ সময়ের অভিজ্ঞতা তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে এক নতুন মাত্রায় সজীবতা আনতে পেরেছে। দিব্যেন্দুর সাহিত্য ভাবনায় ‘সৌখিন মজদুরি’ একেবারেই অনুপস্থিত। সহজ সরল গদ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন একটা সময়ের জীবনের চলচ্ছবি। তাঁর লিখিত উপন্যাসগুলি হল সহযোদ্ধা, ঘরবাড়ি, আড়াল, সোনালী জীবন, ঢেউ, স্বপ্নের ভিতর, অন্তর্ধান, অবৈধ, সিনেমায় যেমন হয়, গৃহবন্দী, অনুসরণ, সবুজ গন্ধ, বৃষ্টির পরে, বিনিদ্র এবং একা ইত্যাদি। এছাড়া যাদবপুর তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র দিব্যেন্দুর সৃজনে আছে অনেক কবিতা ও ছোটগল্প। তাঁর প্রয়াণের পরে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাহিত্যিক হর্ষ দত্তর এক শ্রদ্ধাবনত প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেল- তিনি দিব্যেন্দু পালিতের ‘সহযোদ্ধা’ উপন্যাসের উল্লেখ করেছেন। সত্যিই ‘সহযোদ্ধা’ উল্লেখ করার মতই এক উপন্যাস। বিশেষ করে বাংলার প্রতিষ্ঠিত ও বানিজ্যিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই উপাস্থাপনভঙ্গীর তুলনা বিরল। দিব্যেন্দু পালিত ‘সহযোদ্ধা’ উপন্যাস উৎসর্গ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের আরেক প্রথিতযশা লেখক সমরেশ বসুকে। বাংলা সাহিত্যের চলনপথে ৭০ দশক ও নকশালবাড়ি আন্দোলন বারবার এসেছে। মরমী সাহিত্যিকদের কেউই এই দশককে এড়িয়ে যেতে পারেননি। প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন- “৭০ দশক মূলত বেঁচে থাকবে নকশাল আন্দোলন থেকে দূরে থাকা, নকশাল বাড়ি আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত না থাকা লেখকদের অজস্র সৃষ্টির মাঝে”। বাংলার প্রতিষ্ঠিত শিল্পচর্চার অঙ্গন, স্বাভাবিককারণেই ৭০ দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলন সম্বন্ধে সোচ্চারে না হলেও অন্তস্থভাবে ভীষনভাবেই ছিল সমালোচনামুখর। স্বাভাবিকভাবেই, ৭০ এর আত্মত্যাগ সম্বন্ধে সাহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সৃজনে পরেছে তার ছাপ। এপ্রসঙ্গে আমরা ঐ সময়কে নিয়ে সৃষ্ঠ সাহিত্যের দুটি প্রতিনিধিস্থানীয় সৃজনের উল্লেখ করতেই পারি, এক, ‘শ্যাওলা’ দুই,‘মহাকালের রথের ঘোড়া’। এই দুই সৃষ্টিতেই আমরা দেখতে পাই – এক ঝোড়ো সময়ের দিন পেরিয়ে দুই হেরে যাওয়া, একঘরে,নির্জন, একাকী মানুষের পরবর্তী দিনলিপি। এইখানেই দিব্যেন্দু পালিতের ‘সহযোদ্ধা’ এক অনন্য ব্যাতিক্রম। ‘সহযোদ্ধা’ উপন্যাসের মূল কাঠামো গড়ে উঠেছে-একদিন স্বধর্মেস্থিত মননশীল সাহিত্যিক আদিত্য অন্ধকার ময়দানে এক অচেনা- অজানা লোককে পুলিশের গুলিতে এনকাউন্টারে মরতে দেখেন। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে তিনি এই ঘটনা পুলি এবং সংবাদপত্রে রিপোর্ট করেন। পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন-যাকে মারা হল তিনি আর কেউ নন, তৎকালীন নকশাল পার্টির রাজ্যসম্পাদক, একসময়ের সাংবাদিক শৈবাল মজুমদার।পরবর্তীতে উপন্যাস এগিয়েছে এক টানটান উৎকণ্ঠা জিইয়ে রেখে। পাঠানুভূতিটা জানতে যাঁদের উপন্যাসটি পড়া নেই তাদের পড়তে হবে। আমাদের আলোচ্য বিষয় দিব্যেন্দু পালিত কি অসম্ভব শৈলীতে ৭০ এর নির্মম সত্যকে এক অদ্ভুত ৠাডিকাল ফ্যান্টাসিতে রূপান্তরিত করেছেন। এ তো আমরা সকলেই জানি- ৭০ এ অন্ধকার ময়দানে খুব ভোর বেলায় সিপিআই(এম,এল) রাজ্য সম্পাদক সরোজ দত্তকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। সেই হত্যার সময় সেখানে মর্নিংওয়াকে গিয়েছিলেন তৎকালীন এক বিশিষ্ঠ অভিনেতা। তাঁকে পুলিশ মুখ বন্ধ রাখতে ভয় দেখিয়ে কলকাতা ছাড়া কড়ায়। আজও এত বছর পরেও পুলিশ স্বীকার করেনি সরোজ দত্তকে হত্যা করা হয়েছে। এই সত্যকে আধার করে দিব্যেন্দু পালিতের নায়ক আদিত্য কিন্তু স্থুল, আমাদের জানা সত্যটির অন্য দিকটিকেই বেছে নেয়। সে একজন মানবতাবাদী হিসাবেই সমস্ত ঘটনাটি পাবলিক করেন।যদিও ভয়ংকর তবুও এক একরোখা প্রতিবাদে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকেই বেছে নেন। এখানেই সমসময়ের অন্য সমস্ত প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের প্রেক্ষিতে দিব্যেন্দু পালিতের অনন্যতা।

আমরা যারা এই একবিংশ শতাব্দীতেও ৭০ এর উত্তরাধিকার বহন করি - তারা এ কথা জোড় দিয়ে বলতে পারি যতদিন আমরা বিপ্লবী সরোজ দত্ত হত্যার বিচার চাইব ততদিন আমাদের মনের মণিকোঠায় বেঁচে থাকবে ‘সহযোদ্ধা’ এবং দিব্যেন্দু পালিত।

খণ্ড-26
সংখ্যা-2