২৯ নভেম্বর মহানগরী দিল্লীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল গ্রাম গঞ্জের কৃষকেরা। ৩০ নভেম্বর রাজধানীর রাজপথের দখল নিল দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজার হাজার কৃষক। একদিকে বিজেপি যখন ‘অযোধ্যা চলো’ ডাক দিয়ে সারা দেশে হিংসা আর ঘৃণার আগুন ছড়িয়ে দিতে চাইছে,তখন নিজেদের অধিকার ও সন্মানের প্রশ্ন তুলে ধরে সারা দেশের কৃষকেরা এক অভূতপূর্ব সংগ্রামী একতা গড়ে তুললেন, “দিল্লী চলো” রণধ্বনিকে সামনে রেখে সংগঠিত হল কিষাণ মুক্তি যাত্রা। মূক-বধির সরকারের কানে দেশবাসীর দাবী পৌঁছে দিতে ভগৎ সিং উচ্চকন্ঠের কথা বলেছিলেন। সেই ঐতিহ্য স্মরণ করে জনসমূদ্র গর্জে উঠল, “কিষাণ বিরোধী মোদী সরকার হঠাও”। শ্লোগান উঠলো “না মোদী-যোগী-জয় শ্রীরাম, দেশে রাজ করবে মজদুর কিষাণ” আত্মহত্যার নিয়তিকে অস্বীকার করে ঘুরে দাঁড়ালেন কৃষকেরা। এই কিষাণ মুক্তিযাত্রার প্রধান দাবি ছিল, অবিলম্বে কৃষক প্রশ্নে পার্লামেন্টের এক বিশেষ অধিবেশন করতে হবে,যেখানে কৃষি সংকট থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিশেষ চর্চা হবে। বিগত এক বছর আগে দিল্লীতে আয়োজিত” কিষাণ পার্লামেন্ট” থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বিল অনুমোদিত হয়ে পার্লামেন্টে পাঠানো হয়েছিল। একটি হল মহাজনী ঋণ সহ সমস্ত ঋণফাঁদ থেকে মুক্তি, অপরটি হল স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে নিয়ে ফসল উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম (জমি ও উপকরণের ভাড়া বাবদ ব্যয় সহ) প্রকৃত সহায়ক মূল্য দিতে হবে। এই দুটি প্রশ্নে “সড়ক থেকে সংসদ পর্যন্ত” আলোড়ন সংগঠিত করা হয়ে উঠলো কিষাণ মুক্তি যাত্রার কেন্দ্রীয় বিষয়।
২৯ নভেম্বর দিল্লীর পাঁচটি জায়গা থেকে মিছিল শুরু হয়ে রামলীলা ময়দানে পৌঁছায়। আনন্দ বিহার স্টেশন থেকে দীর্ঘ ১৭ কিলোমিটার পথ হাঁটেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল,প্রভাত কুমার, এআইকেএম জাতীয় সম্পাদক রাজারাম সিং, এ আই সি সি টি ইউ সম্পাদক রাজীব ডিমরি, আয়ারলার সভাপতি শ্রীরাম চৌধূরী, কিষাণ মহাসভার সহ সভাপতি শিবসাগর শর্মা, উত্তরাখন্ডের কিষাণ নেতা আনন্দ সিং নেগি, বিহার রাজ্য সভাপতি বিশ্বেশ্বর যাদব প্রমূখ। মঞ্জনুটোলা থেকে অপর এক পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেন কিষাণ মহাসভার সহ সভাপতি প্রেম সিং, সম্পাদক ঈশ্বরী প্রসাদ কুশওয়াহা,জতীয় পরিষদ সদস্য গুরুনাম সিং প্রমূখ। তৃতীয় জাঠা অখিল ভারতীয় কিষাণ সভার জাতীয় সভাপতি অশোক ধাওয়ালে, সহ সম্পাদক বিজু কৃষ্ণান সহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে সরাইকালেখাঁ থেকে শুরু হয়। চতুর্থ জাঠা বীজওয়াসান থেকে শুরু হয়, নেতৃত্বে ছিলেন স্বরাজ অভিযানের নেতা যোগেন্দ্র যাদব। পঞ্চম জাঠা কিষাণগঞ্জ থেকে শুরু হয়, নেতৃত্বে ছিলেন পাঞ্জাব কিষাণ ইউনিয়নের নেতা দর্শন পাল প্রমূখ। এআইকেএমের পক্ষ থেকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাখন্ড, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর কৃষকরা অংশ নেন। পার্লামেন্ট অভিযান কর্মসূচীতে অংশ নেন পশ্চিমবাংলার এআইকেএম সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, আয়ারলার সভাপতি সজল পাল।
দিল্লীর আইসা এবং এআইসিসিটিইউ সংগঠনের ছাত্র, যুব, শ্রমিক সংগঠক ও কর্মীরা পদযাত্রায় অংশ নেন এবং রামলীলা ময়দানে সারা রাত অবস্থানরত কৃষকদের বিস্কুট-ফল-পানীয় জল সরবরাহ করেন। দিল্লীর বেশ কয়েকটি গুরুদ্বোয়ারা কৃষকদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়। এছাড়া দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-অধ্যাপকেরা, আইনজীবীরা, বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিত্বরা, নানাবিধ সমাজসেবী সংগঠন দীর্ঘ পদযাত্রায় অংশ নেন, রামলীলা ময়দানে গিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করেন। রাতে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক কর্মসূচী, অংশগ্রহণ করে জনসংস্কৃতি মঞ্চের শিল্পীরা। ইউনাইটেড রেসিডেন্ট এ্যান্ড ডক্টরস্ এ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া সংগঠন এবং এইমস্-এর বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এগিয়ে আসেন, কৃষকদের স্বাগত জানান, রামলীলা ময়দানে দিবারাত্র মেডিকেল ক্যাম্প চালু রাখেন। বিশিষ্ঠ চিকিৎসক অঙ্কুর ওম কিষাণ যাত্রাকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি প্রচার করেন। ৩০ নভেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ রামলীলা ময়দান থেকে জনস্রোত রাজধানীর রাজপথের দখল নিতে নিতে এগিয়ে চলে সংসদ অভিমূখে। মিছিল ছিল লাল পতাকায় সুসজ্জিত। ২০৭টি সংগঠনের সমন্বয়ী মঞ্চের শরিকদের হলুদ, সবুজ, সাদা রং বেরং এর পতাকা ফেস্টুনে শোভিত মহামিছিল তুলে ধরেছিল লড়াকু এক মহামিলনের বার্তা। মিছিল সোচ্চার হয়ে উঠেছিল মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে কৃষক হত্যার প্রতিবাদে, যেখানে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী গুলিকান্ডের জবাব দিতে গিয়ে বলছিলেন “যোগব্যায়াম করুন”, বিজেপি নেতা বেঙ্কাইয়া নাইডু যিনি বর্তমানে উপরাস্ট্রপতি সে সময় বিবৃতি দিয়েছিলেন, কৃষকদের ঋণমুক্তির দাবি নাকি ‘ফ্যাশন’ হয়ে উঠেছে। সংকটগ্রস্ত কৃষকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের এ জাতীয় ঠাট্টা মস্করার বিরুদ্ধে কৃষকরা তীব্র ক্ষোভ জানায়। বিজেপি সরকারের কর্পোরেটমুখী নীতি, যার দ্বারা পূঁজিপতিদের ৩ লক্ষ কোটি টাকা লুঠ করতে প্রত্যক্ষ সহায়তা করা হয়েছে,অথচ রাস্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার বাজেট বরাদ্দ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি থেকে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে। কৃষি উপকরণ তথা সার-ডিজেলের দাম বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিএপি সারের দাম বস্তা পিছু ২৮০ টাকা, পটাসের দাম ৩৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে, ডিজেলের দাম লিটারে ৫৭ টাকা থেকে ৭৫ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে কৃষক ফসলের অভাবী বিক্রী করে যে দামে, ২০/৩০ কিলোমিটার দুরবর্তী বাজারে সেটা ৪ গুণ দাম হয়ে যায়। অথচ মোদী বলছেন কৃষকের আয় নাকি দ্বিগুণ হয়ে যাবে! এই ধোঁকাবাজীর বিরুদ্ধে মিছিলের গর্জন দুর্জয় শপথ নিয়েছে “কর্পোরেট দালাল মোদীকে ফিরে আসতে দিচ্ছি না, দেব না’’।
মুক্তি যাত্রায় সামিল হয়েছিলেন ধর্ম-জাতপাত-বর্ণগত পরিচয়ের বেড়া ভেঙ্গে শ্রেণীগত পরিচয় ভিত্তিক কৃষক সমাজ। এটা মোদী সরকারের বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে ছুড়ে দিয়েছে মোক্ষম চ্যালেঞ্জ। মিছিল শেষে যন্তর-মন্তরে আয়োজিত সমাবেশে যে শ্লোগানটা বারংবার উঠে এসেছে তা হলোক-- “কিষাণ একতা জিন্দাবাদ” রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে মিছিলকে স্বাগত জানায় ব্যাংক-বীমা-বিএসএনএল কর্মচারীরা। সমাবেশের শুরুতে বক্তব্য রাখেন “অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি’’র নেতৃবৃন্দ। সভা সঞ্চালনা করেন রাস্ট্রীয় কিষাণ মজদুর সংগঠন (উত্তরপ্রদেশের পিলিভিট অঞ্চলের শিখচাষীদের সংগঠন) নেতা বি এম সিং। বক্তব্য রাখেন স্বরাজ অভিযানের নেতা (পূর্বতন আপ নেতা) যোগেন্দ্র যাদব, কিষাণ সংঘর্ষ সমিতি (মধ্যপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন বিধায়ক) নেতা ডাঃ সুনীলম, স্বাভিমানী শ্বেতকারী সংগঠনের (মহারাস্ট্রের শ্বেতকারী সংগঠনের এম পি) নেতা রাজু শেঠ্ঠী, তেলেঙ্গানা এলাকার অল ইন্ডিয়া কিষাণ মজদুর সংগঠনের নেতা কে চন্দ্রশেখর, কিষাণ মহা পঞ্চায়েতের নেতা রামপাল জাঠ। সিপিএমের কৃষক সংগঠন, অখিল ভারতীয় কিষাণ সভার নেতা হান্নান মোল্লা, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের অখিল ভারতীয় কিষাণ মহাসভার সম্পাদক রাজারাম সিং সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও ভাষণ দেন। ঋণমুক্তি ও ন্যায্য দামের দাবিকে দলীয় নির্বাচনী ইস্তাহারে রাখবেন কিনা-এ বিষয়ে তাঁদের সন্মতি জানতে চাওয়া হয়। দেখা গেল বিজেপি এনডিএ জোটের বাইরে থাকা প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই কৃষকের দাবীর সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে আপ মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল; ফারুক আবদুল্লা, শারদ পাওয়ার, এবং তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদী, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই নেতা ডি রাজা প্রমূখ। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। সংবাদ মাধ্যম বিরোধী ঐক্য তথা ক্ষমতার সমীকরণে মহাজোটের ছবি তুলে ধরেছে। কিন্ত অন্নদাতা কৃষক সমাজের অধিকারের দাবি তথাকথিত ‘মূলধারা’র রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এটা কিষাণ মুক্তি যাত্রার অন্যতম সাফল্য।মোদী সরকারের ধোঁকাবাজীর বিরুদ্ধে দিল্লীতে ঐতিহাসিক কিষাণ মুক্তি মার্চ
২৯ নভেম্বর মহানগরী দিল্লীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল গ্রাম গঞ্জের কৃষকেরা। ৩০ নভেম্বর রাজধানীর রাজপথের দখল নিল দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজার হাজার কৃষক। একদিকে বিজেপি যখন ‘অযোধ্যা চলো’ ডাক দিয়ে সারা দেশে হিংসা আর ঘৃণার আগুন ছড়িয়ে দিতে চাইছে,তখন নিজেদের অধিকার ও সন্মানের প্রশ্ন তুলে ধরে সারা দেশের কৃষকেরা এক অভূতপূর্ব সংগ্রামী একতা গড়ে তুললেন, “দিল্লী চলো” রণধ্বনিকে সামনে রেখে সংগঠিত হল কিষাণ মুক্তি যাত্রা। মূক-বধির সরকারের কানে দেশবাসীর দাবী পৌঁছে দিতে ভগৎ সিং উচ্চকন্ঠের কথা বলেছিলেন। সেই ঐতিহ্য স্মরণ করে জনসমূদ্র গর্জে উঠল, “কিষাণ বিরোধী মোদী সরকার হঠাও”। শ্লোগান উঠলো “না মোদী-যোগী-জয় শ্রীরাম, দেশে রাজ করবে মজদুর কিষাণ” আত্মহত্যার নিয়তিকে অস্বীকার করে ঘুরে দাঁড়ালেন কৃষকেরা। এই কিষাণ মুক্তিযাত্রার প্রধান দাবি ছিল, অবিলম্বে কৃষক প্রশ্নে পার্লামেন্টের এক বিশেষ অধিবেশন করতে হবে,যেখানে কৃষি সংকট থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিশেষ চর্চা হবে। বিগত এক বছর আগে দিল্লীতে আয়োজিত” কিষাণ পার্লামেন্ট” থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বিল অনুমোদিত হয়ে পার্লামেন্টে পাঠানো হয়েছিল। একটি হল মহাজনী ঋণ সহ সমস্ত ঋণফাঁদ থেকে মুক্তি, অপরটি হল স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে নিয়ে ফসল উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম (জমি ও উপকরণের ভাড়া বাবদ ব্যয় সহ) প্রকৃত সহায়ক মূল্য দিতে হবে। এই দুটি প্রশ্নে “সড়ক থেকে সংসদ পর্যন্ত” আলোড়ন সংগঠিত করা হয়ে উঠলো কিষাণ মুক্তি যাত্রার কেন্দ্রীয় বিষয়।
২৯ নভেম্বর দিল্লীর পাঁচটি জায়গা থেকে মিছিল শুরু হয়ে রামলীলা ময়দানে পৌঁছায়। আনন্দ বিহার স্টেশন থেকে দীর্ঘ ১৭ কিলোমিটার পথ হাঁটেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল,প্রভাত কুমার, এআইকেএম জাতীয় সম্পাদক রাজারাম সিং, এ আই সি সি টি ইউ সম্পাদক রাজীব ডিমরি, আয়ারলার সভাপতি শ্রীরাম চৌধূরী, কিষাণ মহাসভার সহ সভাপতি শিবসাগর শর্মা, উত্তরাখন্ডের কিষাণ নেতা আনন্দ সিং নেগি, বিহার রাজ্য সভাপতি বিশ্বেশ্বর যাদব প্রমূখ। মঞ্জনুটোলা থেকে অপর এক পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেন কিষাণ মহাসভার সহ সভাপতি প্রেম সিং, সম্পাদক ঈশ্বরী প্রসাদ কুশওয়াহা,জতীয় পরিষদ সদস্য গুরুনাম সিং প্রমূখ। তৃতীয় জাঠা অখিল ভারতীয় কিষাণ সভার জাতীয় সভাপতি অশোক ধাওয়ালে, সহ সম্পাদক বিজু কৃষ্ণান সহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে সরাইকালেখাঁ থেকে শুরু হয়। চতুর্থ জাঠা বীজওয়াসান থেকে শুরু হয়, নেতৃত্বে ছিলেন স্বরাজ অভিযানের নেতা যোগেন্দ্র যাদব। পঞ্চম জাঠা কিষাণগঞ্জ থেকে শুরু হয়, নেতৃত্বে ছিলেন পাঞ্জাব কিষাণ ইউনিয়নের নেতা দর্শন পাল প্রমূখ। এআইকেএমের পক্ষ থেকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাখন্ড, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর কৃষকরা অংশ নেন। পার্লামেন্ট অভিযান কর্মসূচীতে অংশ নেন পশ্চিমবাংলার এআইকেএম সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, আয়ারলার সভাপতি সজল পাল।
দিল্লীর আইসা এবং এআইসিসিটিইউ সংগঠনের ছাত্র, যুব, শ্রমিক সংগঠক ও কর্মীরা পদযাত্রায় অংশ নেন এবং রামলীলা ময়দানে সারা রাত অবস্থানরত কৃষকদের বিস্কুট-ফল-পানীয় জল সরবরাহ করেন। দিল্লীর বেশ কয়েকটি গুরুদ্বোয়ারা কৃষকদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়। এছাড়া দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-অধ্যাপকেরা, আইনজীবীরা, বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিত্বরা, নানাবিধ সমাজসেবী সংগঠন দীর্ঘ পদযাত্রায় অংশ নেন, রামলীলা ময়দানে গিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করেন। রাতে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক কর্মসূচী, অংশগ্রহণ করে জনসংস্কৃতি মঞ্চের শিল্পীরা। ইউনাইটেড রেসিডেন্ট এ্যান্ড ডক্টরস্ এ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া সংগঠন এবং এইমস্-এর বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এগিয়ে আসেন, কৃষকদের স্বাগত জানান, রামলীলা ময়দানে দিবারাত্র মেডিকেল ক্যাম্প চালু রাখেন। বিশিষ্ঠ চিকিৎসক অঙ্কুর ওম কিষাণ যাত্রাকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি প্রচার করেন। ৩০ নভেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ রামলীলা ময়দান থেকে জনস্রোত রাজধানীর রাজপথের দখল নিতে নিতে এগিয়ে চলে সংসদ অভিমূখে। মিছিল ছিল লাল পতাকায় সুসজ্জিত। ২০৭টি সংগঠনের সমন্বয়ী মঞ্চের শরিকদের হলুদ, সবুজ, সাদা রং বেরং এর পতাকা ফেস্টুনে শোভিত মহামিছিল তুলে ধরেছিল লড়াকু এক মহামিলনের বার্তা। মিছিল সোচ্চার হয়ে উঠেছিল মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে কৃষক হত্যার প্রতিবাদে, যেখানে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী গুলিকান্ডের জবাব দিতে গিয়ে বলছিলেন “যোগব্যায়াম করুন”, বিজেপি নেতা বেঙ্কাইয়া নাইডু যিনি বর্তমানে উপরাস্ট্রপতি সে সময় বিবৃতি দিয়েছিলেন, কৃষকদের ঋণমুক্তির দাবি নাকি ‘ফ্যাশন’ হয়ে উঠেছে। সংকটগ্রস্ত কৃষকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের এ জাতীয় ঠাট্টা মস্করার বিরুদ্ধে কৃষকরা তীব্র ক্ষোভ জানায়। বিজেপি সরকারের কর্পোরেটমুখী নীতি, যার দ্বারা পূঁজিপতিদের ৩ লক্ষ কোটি টাকা লুঠ করতে প্রত্যক্ষ সহায়তা করা হয়েছে,অথচ রাস্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার বাজেট বরাদ্দ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি থেকে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে। কৃষি উপকরণ তথা সার-ডিজেলের দাম বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিএপি সারের দাম বস্তা পিছু ২৮০ টাকা, পটাসের দাম ৩৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে, ডিজেলের দাম লিটারে ৫৭ টাকা থেকে ৭৫ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে কৃষক ফসলের অভাবী বিক্রী করে যে দামে, ২০/৩০ কিলোমিটার দুরবর্তী বাজারে সেটা ৪ গুণ দাম হয়ে যায়। অথচ মোদী বলছেন কৃষকের আয় নাকি দ্বিগুণ হয়ে যাবে! এই ধোঁকাবাজীর বিরুদ্ধে মিছিলের গর্জন দুর্জয় শপথ নিয়েছে “কর্পোরেট দালাল মোদীকে ফিরে আসতে দিচ্ছি না, দেব না’’।
মুক্তি যাত্রায় সামিল হয়েছিলেন ধর্ম-জাতপাত-বর্ণগত পরিচয়ের বেড়া ভেঙ্গে শ্রেণীগত পরিচয় ভিত্তিক কৃষক সমাজ। এটা মোদী সরকারের বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে ছুড়ে দিয়েছে মোক্ষম চ্যালেঞ্জ। মিছিল শেষে যন্তর-মন্তরে আয়োজিত সমাবেশে যে শ্লোগানটা বারংবার উঠে এসেছে তা হলোক-- “কিষাণ একতা জিন্দাবাদ” রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে মিছিলকে স্বাগত জানায় ব্যাংক-বীমা-বিএসএনএল কর্মচারীরা। সমাবেশের শুরুতে বক্তব্য রাখেন “অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি’’র নেতৃবৃন্দ। সভা সঞ্চালনা করেন রাস্ট্রীয় কিষাণ মজদুর সংগঠন (উত্তরপ্রদেশের পিলিভিট অঞ্চলের শিখচাষীদের সংগঠন) নেতা বি এম সিং। বক্তব্য রাখেন স্বরাজ অভিযানের নেতা (পূর্বতন আপ নেতা) যোগেন্দ্র যাদব, কিষাণ সংঘর্ষ সমিতি (মধ্যপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন বিধায়ক) নেতা ডাঃ সুনীলম, স্বাভিমানী শ্বেতকারী সংগঠনের (মহারাস্ট্রের শ্বেতকারী সংগঠনের এম পি) নেতা রাজু শেঠ্ঠী, তেলেঙ্গানা এলাকার অল ইন্ডিয়া কিষাণ মজদুর সংগঠনের নেতা কে চন্দ্রশেখর, কিষাণ মহা পঞ্চায়েতের নেতা রামপাল জাঠ। সিপিএমের কৃষক সংগঠন, অখিল ভারতীয় কিষাণ সভার নেতা হান্নান মোল্লা, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের অখিল ভারতীয় কিষাণ মহাসভার সম্পাদক রাজারাম সিং সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও ভাষণ দেন। ঋণমুক্তি ও ন্যায্য দামের দাবিকে দলীয় নির্বাচনী ইস্তাহারে রাখবেন কিনা-এ বিষয়ে তাঁদের সন্মতি জানতে চাওয়া হয়। দেখা গেল বিজেপি এনডিএ জোটের বাইরে থাকা প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই কৃষকের দাবীর সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে আপ মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল; ফারুক আবদুল্লা, শারদ পাওয়ার, এবং তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদী, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই নেতা ডি রাজা প্রমূখ। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। সংবাদ মাধ্যম বিরোধী ঐক্য তথা ক্ষমতার সমীকরণে মহাজোটের ছবি তুলে ধরেছে। কিন্ত অন্নদাতা কৃষক সমাজের অধিকারের দাবি তথাকথিত ‘মূলধারা’র রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এটা কিষাণ মুক্তি যাত্রার অন্যতম সাফল্য।