খবরা-খবর
গণহত্যার দায়ে মুখ্যমন্ত্রী সোনোয়ালের পদত্যাগের দাবিতে কলকাতায় আসাম ভবনে বিক্ষোভ

আসামের তিনসুকিয়ার ধলা গণহত্যার দায় স্বীকার করে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালকে পদত্যাগ করতে হবে দাবিতে স্মারকপত্র নিয়ে ৫ নভেম্বর কলকাতার আসাম ভবনে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় সিপিঅাই(এমএল) রাজ্য কমিটির ডাকে। গণহত্যার খবর সামনে আসার পরপরই রাজ্যের কয়েকটি এলাকায় স্থানীয় স্তরে বিক্ষোভ সংগঠিত হয় এবং পোস্টার ছাপিয়ে প্রচার চালানো হয়। এইদিন কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সমস্ত রাজ্য কমিটির সদস্য ও পার্টি কর্মীরা বিক্ষোভে সামিল হন। রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষের নেতৃত্বে পাঁচজনের প্রতিনিধিদল আসাম সরকারের আধিকারিকের কাছে স্মারকপত্র প্রদান করেন ও সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। প্রতিনিধিদলে অন্যরা ছিলেন অতনু চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু, অমিত দাশগুপ্ত ও মলয় তেওয়ারি। আধিকারিক মহাশয় স্মারকপত্র গ্রহণ করেন ও দ্রুত তা আসাম রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানোর কথা বলেন। চাপের মুখে তিনি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে আসামের চিফ সেক্রেটরির সাথে ফোনে অনুমতি নিয়ে একটি প্রেস বিবৃতি জারি করেন যেখানে ধলা গণহত্যাকে ধিক্কার ও অপরাধিদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা করা হয়। বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সর্বানন্দ সনোয়ালের কুশপুতুল পোড়ানো হয়। বিভিন্ন বক্তারা আসামে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি তথা আসাম সরকারের কূটিল ভূমিকাকে উন্মোচিত করে বক্তব্য রাখেন।

আসামে এনআরসি-তে ৪০ লক্ষ মানুষ বাদ পড়ার ফলে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কার জন্ম হয়েছিল। বাদ পড়াদের অধিকাংশই বাঙালি। এনআরসির পদ্ধতি ও প্রয়োগ উভয়ের মধ্যেই যে অভিসন্ধিমূলক পক্ষপাতিত্ব ছিল তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলত অন্যায়ভাবে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে আসামের অসমীয়া ও বাঙালিদের, হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ তৎপরতা ও আন্দোলন দ্রুতই প্রসার লাভ করছিল। অসমীয়া মুসলমানদের একটি সংগঠন আদালতে লড়াই করে পাঁচটি নথি পুনর্বহাল রাখার জয় ছিনিয়ে আনে। এই ঐক্য ভাঙতেই আরএসএস-বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের পরিকল্পনা বহুমুখী, গভীর ও নৃশংস। বিজেপির জাতীয় সভাপতি তালিকাচ্যুতদের ঘুসপেটিয়া ও উইপোকা সম্বোধন করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার হুঙ্কার দেন; বিজেপির উগ্র অসমিয়া উইং তীব্র প্রচার করতে থাকে যে বাদ পড়ার তালিকা আরো বড় করতে হবে এবং এনআরসি নিয়ে প্রশ্ন তুললে ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে; নাগরিকত্ব প্রমাণের ১৪টি গ্রাহ্য নথির মধ্যে পাঁচটি নথিকে বাতিল করার জন্য আদালতে হলফনামা দেয় এনআরসি কর্তৃপক্ষ (যে মামলায় শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় হয়)। আর সর্বোপরি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়নের দাবী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরএসএস-বিজেপির বাঙালি উইং। বিজেপির প্রস্তাবিত এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে তাঁদের একটি বিশেষ পদক্ষেপ। এই বিল ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, পার্সি ও জৈন, এই পাঁচ ধরনের মানুষকে আশ্রয় ও তারপর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলেছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে নির্দিষ্টভাবে মুসলমান সম্প্রদায়কে বাদ রাখা হয়েছে। একটি সম্প্রদায়কেই দেশের শত্রু হিসেবে গণ্য করতে চাইছে এই প্রস্তাবিত আইন। আসলে দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের নাগরিকত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে চাইছে এই প্রস্তাবিত আইন। নাগরিকত্বের এই আইনটি পাস হওয়ার পর যদি নাগরিক তালিকা তৈরি করতে চায় কোনও রাজ্য তাহলে অতি সহজেই মুসলমান সম্প্রদায়ের কোটি কোটি গরিব শ্রমজীবি অংশকে কাগজপত্র না থাকার বাহানায় বাংলাদেশী বা পাকিস্তানী বানিয়ে দেওয়া যাবে। একথা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা আক্রান্ত শরণার্থীদের আশ্রয় দানের মহৎ উদ্দেশ্যে নাগরিকত্ব আইন বানাতে চাইলে এই মূহুর্তে সবার আগে তো রোহিঙ্গ্যা মুসলমানদের নাম আসার কথা। মায়ানমারে উগ্র বৌদ্ধ আধিপত্যবাদকে হাতিয়ার করে কর্পোরেট লুটের স্বার্থে মায়ানমার সেনা কর্তৃক আরাকান থেকে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বিতাড়নের খবর তো দুনিয়াশুদ্ধ মানুষ জানেন। ফলত একথা বোঝা খুব কঠিন নয় যে নাগরিক বিলের উদ্দেশ্য হিন্দু-মুসলমান বিভাজন। আসামের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তা অসমীয়া বনাম বাঙালি বিভাজনেরও হাতিয়ার। একদিকে ৪০ লক্ষ তালিকাচ্যুত মানুষের মধ্যে একটা বড় অংশ হিন্দু বাঙালি হওয়ায় এরকম পরিবারগুলির বিপন্নতাকে কাজে লাগিয়ে নাগরিক  বিলের পক্ষে হিন্দু বাঙালীকে একত্রিত করা হচ্ছে; এই কাজের সামনের সারিতে থাকা বিজেপি এমএলএ শিলাদিত্য দেব ইতিমধ্যেই কুখ্যাত হয়ে উঠেছেন মুসলমান বাঙালিদের বিরুদ্ধে তথা সমস্ত “মিঞা”-দের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচার চালিয়ে, এই কাজ তাকে অসমীয়া হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ রাখে। অন্যদিকে, এই নাগরিক বিল পাশ হলে, আসামে বিপুল পরিমান বাঙালির অনুপ্রবেশ ঘটে অসমীয়া মানুষেরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে—এই উদ্বেগকে ভিত্তি করে তীব্র বাঙালি বিদ্বেষী প্রচার চলে। এইরকম পরিস্থিতিতে গত ৩১ অক্টোবর ধলায় সংগঠিত হয় সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় হাড় হিম করা হত্যাকাণ্ডটি।

প্রথমে বিচ্ছিন্নতাকামী আলফার দিকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা হলেও যত দিন গেছে ততই এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দলের প্রত্যক্ষ গভীর ভূমিকার দিকেই আঙুল উঠেছে। সেনার পোশাক পরা, সেনার ব্যবহৃত ভারী আগ্নেয়াস্ত্র হাতে একদল জওয়ান পুরুষ ব্যস্ত সন্ধ্যার চা-দোকান থেকে ছয়জন মানুষকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পুলিশ থানার কয়েকশ ফুটের মধ্যেই সারি দিয়ে বসিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল—এরকম ঘটনা রাষ্ট্রের অগোচরে ঘটা অস্বাভাবিক। বস্তুত রাষ্ট্রের যে কাঠামো উপরিস্তরে দৃশ্যমান তারও তলে থাকে রাষ্ট্রের আরো অনেক কিছু। যাকে কূটনীতির পরিভাষায় বলা হয় “ডিপ স্টেট” বা “গভীর রাষ্ট্র”। বর্তমান ভারতে এই গভীর রাষ্ট্রে আরএসএস-এর গভীরতর সংযোগ মালেগাঁও থেকে হেমন্ত কারকারে পর্যন্ত বিভিন্ন সন্ত্রাসী পরিঘটনায় সামনে এসেছে। ধলা গণহত্যার পর আসামে সাধারন মানুষের মাঝ থেকে উঠে আসা ব্যাপক ধিক্কার আরো বেশি করে এই ডিপ স্টেটের ভূমিকার দিকেই ইঙ্গিত করে। জনবিন্যাস সম্পর্কে অসমীয়াদের মধ্যে যতই উদ্বেগ থাকুক না কেন আশির দশকের মতো জিঘাংসাপূর্ণ আক্রমণ ও হত্যা কোনও রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে বলে কেউই যে মনে করেন না তা ধর্ম ও ভাষা নিরপেক্ষভাবে সকল অসমীয়াই স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কার্যত নেতাদের বহু প্রত্যক্ষ উস্কানি বা নির্দেশ সত্ত্বেও মানুষ সে পথ বেছে নেয়নি। ফলত ধলা গণহত্যা যে আলফার মত জঙ্গী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সংগঠিত করবে তার সম্ভাবনাও খুব কম ছিল। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের গভীর নেপথ্য ভূমিকার কথা সমস্ত বিশ্লেষকদের মতামতেই উঠে আসছে।

বিক্ষোভ সভায় জয়তু দেশমুখ, কার্তিক পাল, নিলাশীষ বসু, আকাশ দেশমুখ, অনিমেষ চক্রবর্তী, সহ সমস্ত কমরেডরা দেশজুড়েই যে বিজেপির এই দেশদ্রোহী বিভাজনকামী রাজনীতি চলছে সে বিষয়ে সচেতন করেন। সারা দেশে চলমান গভীর আর্থিক সংকটকে নোটবন্দী, ব্যাঙ্ক লুট, রাফাল লুটের মতো কর্যকলাপের মধ্যে দিয়ে আরো গভীরতর করছে বিজেপির সরকার। আর ধর্মীয়, সবর্ণবাদী, পুরুষতান্ত্রিক, ভাষিক, আঞ্চলিক ইত্যাদি একমাত্রিক আবেগে মানুষের পরিচিতিকে সংকীর্ণ করে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়ার জন্য একের পর এক নীতি প্রণয়ন করছে। বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠির দেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বা বহুত্ববাদকে ঐক্যের মাধ্যম না করে কল্পিত এক একমাত্রিক হিন্দু সংস্কৃতির স্টিম রোলার চালিয়ে ভেতর থেকে টুকরো টুকরো করে দিতে চাইছে ভারতকে। ভাষিক সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক সমানাধিকারকে গুরুত্ব দেয়ার বদলে সংখ্যাগুরুর উগ্র আধিপত্যবাদকে দেওয়া হচ্ছে গভীর রাষ্ট্রীয় মদত। মহারাষ্ট্রে তো ছিলই, সম্প্রতি গুজরাটেও দেখা গেল বিহারী খেদাও অভিযান। বাঙলাতেও ভাষিক সংখ্যাগুরুর সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে যা ঐক্য ও সংহতির পক্ষে খতরনাক হয়ে উঠতে পারে।

assam killing

 

খণ্ড-25
সংখ্যা-34