রাত দখল কর আর দিন জয় কর, লিঙ্গ ন্যায়ের দাবিতে গণজাগরণ এগিয়ে নিয়ে চল
seize-the-night

৯ আগস্ট ভোরে, একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ পশ্চিমবঙ্গকে হতবাক করে দিয়েছে। কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের চেস্ট মেডিসিন বিভাগে কর্মরত এক তরুণ স্নাতকোত্তর শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে নির্মমভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। এই নৃশংসতা শুধু চিকিৎসক সম্প্রদায়কেই নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের গভীরে থাকা দুর্নীতি এবং পুরুষতান্ত্রিক হিংসার নির্মম দিকটিকেও প্রকাশ করেছে।

আরজি কর মেডিকেল কলেজ প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া এই ট্র্যাজেডিকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। অধ্যক্ষ মিঃ সন্দীপ ঘোষ, নির্যাতিতার মা বাবাকে ডেকে পাঠান এবং তাদের মেয়ের মৃতদেহ দেখার জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বাধ্য করেন। নির্যাতিতার শরীরে ভয়ঙ্কর জখম থাকা সত্ত্বেও যা একটি ফৌজদারি অপরাধের ইঙ্গিত দেয়, প্রাথমিক পুলিশ রিপোর্টে তাঁর মৃত্যুকে “অস্বাভাবিক” হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং অধ্যক্ষ এটিকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। জনরোষ ছড়িয়ে পড়ার পর, প্রায় পুরো একদিন পরে রাত ১১.৪৫টায় একটি এফআইআর দায়ের করা হয়। ১০ আগস্ট, প্রধান সন্দেহভাজন সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করা হলেও জনগণের ক্ষোভ কমেনি। ঘটনায় সরকারী হাসপাতালের অভ্যন্তরে বিদ্যমান দুর্নীতির গভীরতা এবং অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ ও কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। এহেন অধ্যক্ষ্য সন্দীপ ঘোষ সংবাদ সম্মেলনে নির্যাতিতার পরিচয় প্রকাশ করে এবং নির্যাতিতা রাতে একা থাকাকে ঘটনার জন্য দায়ী করেন তার উপর হওয়া নির্যাতনের জন্য। এই মন্তব্য সমাজের পিতৃতান্ত্রিক ধর্ষণ সংস্কৃতির একটি প্রতিফলন।

নির্লজ্জভাবে নির্যাতিতাকে দোষারোপ করা এবং নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় একটি শক্তিশালী আন্দোলনের জন্ম হয়। শ্রেণী, বর্ণ, যৌনতা, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে সকল স্তরের নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক যৌন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষেরা স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে রাতের দখল করতে একত্রিত হয়েছিল। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, দুই বছর আগে স্বাধীনতা দিবসেই, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের গুজরাট হাইকোর্ট বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল এবং বিজেপি কর্মীরা মালা দিয়ে তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতা পরিচয়ের মানুষদের সমানাধিকার ও স্বাতন্ত্র‍্যের সংকটকে তুলে ধরার বিপরীতে, দুই বছর পর, ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ ব্যানারে এই গণ-অভ্যুত্থান লিঙ্গ ন্যায়বিচারের, ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার আহ্বান তোলে। লক্ষাধিক নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক যৌন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষেরা পশ্চিমবঙ্গের ২৫০টিরও বেশি এলাকা থেকে এবং মুম্বাই ও দিল্লিসহ ভারতের অন্যান্য শহরগুলোতে রাতকে ভরিয়ে রেখেছিলেন আর জি করের নির্যাতিতার ন্যায়-বিচারের দাবিকে সামনে রেখে। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি যার অন্যতম দিক হল মেয়েদের শরীর জীবন যাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা তাকে ধাক্কা দিয়েছে এই গণজাগরণ। যৌন-হিংসার ন্যায়বিচারের দাবিতে এই গণ-অভ্যুত্থান শুধুমাত্র আর জি করের নির্যাতিতার জন্য ছিল না; তার সাথে জুড়ে গেছিল প্রতিটি নারী, ট্রান্স এবং কুইয়ার ব্যক্তির রাগ ও আকাঙ্ক্ষা, যারা প্রতিদিনের ভিত্তিতে ধর্ষণের সংস্কৃতির মুখোমুখি হয়।

seize-the-night-and-conquer-the-day_0

যখন এই আন্দোলনটি গতি পাচ্ছিল, রিক্লেইম দ্য নাইটের একই রাতে, আরজি কর এবং এনআরএস হাসপাতালে প্রতিবাদরত পড়ুয়া এবং ডাক্তারদের অবস্থানমঞ্চের উপর রাষ্ট্রীয় উদ্দ্যেশ্য-প্রণোদিত গুন্ডারা আক্রমণ চালায় এবং মহিলা নার্স ও ডাক্তারদের ধর্ষণের হুমকি দেয়। এই রাতটি আরও একটি ভয়ঙ্কর অপরাধের সাক্ষী ছিল: বর্ধমানের শক্তিগড়ে এক আদিবাসী মহিলাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হিংসা সেখানেই থেমে থাকেনি। ১৫ আগস্ট, রবীন্দ্র সদনে রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনী (আরপিএফ)-র বেশ কয়েকজন রূপান্তরকামী মহিলাদের হেনস্থা করে, এছাড়াও নন্দীগ্রামে বিজেপি কর্মীদের দ্বারা একজন মহিলাকে নগ্ন করে ঘোরানো হয়। অনেক নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষ তাদের হেনস্থার অভিজ্ঞতা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছিলেন। এর থেকে স্পষ্ট যে এই আন্দোলন একটি প্রতীকী প্রতিবাদের চেয়ে অনেক বৃহৎ; এই আন্দোলনের ক্ষমতা আছে সত্যিকার অর্থে গণ-পরিসর ও সমাজে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার সমীকরণকে বদলানোর এবং হিংসা ও বঞ্চনার ঊর্ধ্বে সমাজে নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের দখল প্রতিষ্ঠা করার। আই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও,  আন্দোলনের সংকল্প আরও শক্তিশালী হয়েছে। ১৪ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত হচ্ছেন। রাত দখল অধিকার দখল আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১৭ আগস্ট, প্রায় ৩০০০ জনেরও বেশি নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষরা সংহতি প্রকাশ করতে আরজি কর-এর দিকে রওনা হয়েছিলেন এবং ২৫ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জবাব চাওয়ার জন্য গণপরিসরে মেয়েদের দখল, সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থা বিরোধী কাঠামোগুলিকে দায়বদ্ধ ও শক্তিশালী করা এবং স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার দুর্নীতির প্রশ্নকে সামনে রেখে তিন দফা দাবিতে হাজার হাজার মানুষ মিছিলে সংগঠিত হন।

জনগণের এই অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে এবং আরএসএস এবং বিজেপির মতো ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি এই অভ্যুত্থানের ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে। এই গোষ্ঠীগুলি, যারা ঐতিহাসিকভাবে পিতৃতন্ত্র ও ধর্ষণ সংস্কৃতির হাত শক্ত করেছে এবং লিঙ্গ ন্যায়ের কণ্ঠস্বরকে দমন করেছে, তারা এখন তাদের স্বার্থে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, আরজি কর-এর এই ঘটনাটি পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রতিফলন এবং এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

আজ আমাদের নির্ভয়া আন্দোলনের দিকে ফিরে তাকানো প্রয়োজন, যা ভারতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিকায় এক গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছিল। এই আন্দোলন কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা ও সমানাধিকারের প্রশ্নে, বিশেষত কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের বিষয় নীতি নির্ধারণে দীর্ঘস্থায়ী কিছু বদল এনেছিল। আন্দোলনের ফলস্বরূপ জাস্টিস ভার্মা কমিশন তৈরি হওয়া এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধ (পিওএসএইচ) আইন প্রণয়ন হওয়া লিঙ্গ রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় জয় ছিল। লিঙ্গ রাজনীতির বিষয় কাজ করা সংগঠন, পড়ুয়া সংগঠন, এআইপিডব্লিউএ, এবং এআইএসএ সহ নাগরিক সংগঠনগুলো এই বদলের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে যৌন হেনস্থাকে নারীদের জীবন ও মর্যাদার মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হিসাবে চিহ্নিত করে। এই আইন অনুযায়ী প্রতিটি সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে স্থানীয় তদন্ত কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়াও প্রতিটি ক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থা রুখতে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা তৈরি করার বিষয় বিভিন্ন সুপারিশ দেয়। কিন্তু আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা POSH আইনের বাস্তবায়ন ও কমিটি গুলির উপস্থিতি ও কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে।

seize-the-night-and-conquer-the-day_1

এই প্রেক্ষাপটে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ১৭-দফা সার্কুলার, রাত দখল অধিকার দখল আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা দাবিগুলিকে চুপ করানোর একটা প্রচেষ্টা বলে মনে হয়। প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো, যেমন মেয়েদের রাতের ডিউটি কমিয়ে দেওয়ার নিদান, আন্দোলন থেকে উঠে আসা মহিলাদের স্বাধীনতার দাবি নিশ্চিত করার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির রাস্তা পরিষ্কার করছে। উদাহরণস্বরূপ, আরজি কর-এ যেখানে ঘটনা ঘটে সেই স্থানটি সিসিটিভি দিয়ে ঘেরা ছিল, তবুও অপরাধ আটকানো যায়নি। এই প্রশ্ন থেকে যায় যে নারী, প্রান্তিক লিঙ্গ, যৌন পরিচয়ের মানুষের জন্য নিরাপদ স্থান বলতে কী বোঝায়। নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রের প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায়, ‘সংহতি, নজরদারি নয়; মুক্তি, সুরক্ষা নয়।’ এই আহ্বানে নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের ডাকে ১৯ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ৩০টি স্থানে মানব-বন্ধন সংগঠিত হয়।

এছাড়াও রাত দখল অধিকার দখল আন্দোলন আরজি কর-এ পিটিজি ডাক্তারের নৃশংস হত্যা ও ধর্ষণের দ্রুত এবং স্বচ্ছ সিবিআই তদন্তের দাবি করা হয়েছে। এছাড়া, ১৪ আগস্ট রাতে আরজি কর-এ ভাঙচুর ও হামলার জন্য দায়ী সকলের বিরুদ্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। সেই রাতে ডিউটিতে থাকা পুলিশ অফিসারদেরও দায়িত্বে ত্রুটি হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এখন আমাদের সময় এসেছে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোগুলির পরিবর্তনের দাবিকে জোরদার করার জন্য গণ ক্ষোভকে কাজে লাগানোর, যা নারী ও লিঙ্গ সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে এবং রাষ্ট্রের সমান নাগরিক হিসেবে আমাদের স্থান দখল করতে সাহায্য করতে পারে।

মুখ্য দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে: নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা আইসিসি এবং এলসিসির পুনর্গঠন, প্রতি ১ কিলোমিটার দূরত্বে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, ২৪ ঘন্টা গণপরিবহন ব্যবস্থা, কর্মজীবী মহিলাদের জন্য ক্রেস এবং রাতে কাজ করা মেয়েদের, রূপান্তরকামী মানুষ ও প্রান্তিক যৌন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের জন্য বিশ্রামাগার ও কর্মরত উক্ত মানুষদের জন্য হোস্টেল নির্মাণ করা। এসব পরিষেবা অবশ্যই বিনামূল্যে অথবা ভর্তুকিযুক্ত হারে প্রাপ্ত হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পিওএসএইচ আইনের প্রণয়ন এবং ভারত জুড়ে আইসিসি এবং এলসিসির অবস্থার ব্যাপক পর্যালোচনা করার জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা উচিত। এই ব্যবস্থাগুলি নিশ্চিত করবে যে নারী এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সংখ্যালঘু মানুষেরা সত্যিই গনপরিসরে দখল কায়েম করতে সক্ষম হবে।

রাত দখল ও অধিকার আন্দোলন একটি শক্তিশালী অনুস্মারক যে পিতৃতান্ত্রিক হিংসার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই এখনও শেষ হয়নি। যারা ন্যায়বিচার, সমনাধিকার ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকারে বিশ্বাসী, তাদের জন্য এই আন্দোলন এক আকাশ সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আমাদের সংগ্রাম কেবল অপরাধীদের বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যা এই ধরনের নৃশংস ঘটনাকে উসকে দেয়। যতদিন না সমস্ত নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা যায় এবং এমন একটি সমাজ নির্মিত হয় যেখানে প্রত্যেকেই নিরাপদে এবং মর্যাদায় বাঁচতে পারে, ততদিন আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।

সম্প্রীতি মুখার্জী

খণ্ড-26