কলকাতা প্রসিদ্ধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আরজিকরের অভ্যন্তরে ৯ আগস্টের মধ্যরাতে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ধর্ষণের ঘটনায় আজ সমগ্র দেশ উত্তাল। প্রতিবাদের মিছিলে সামিল হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। অন্যায়ের বিরূদ্ধে ধর্ষকের শাস্তির বিচার পাওয়ার প্রত্যাশায় জনরোষের আগুণ জ্বলছে দেশের অভ্যন্তরে। বাদ পড়েনি বিশ্বের সভ্য সমাজের প্রগতিশীল মানুষের দৃষ্টিও। কিন্তু এ ঘটনা নতুন নয়, আকস্মিকও নয়। সদ্য দগদগে হাথরাস থেকে মনিপুরের স্মৃতি আজও রক্ত শীতল করে তোলে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি)তথ্য অনুসারে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে মোট ১ লাখ ৮৯ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছরে ৩০ হাজার মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন — প্রতিদিন গড়ে ৪ জন। নিঃসন্দেহে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর এই তথ্য শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিকে যেমন চমকে দেবে, তেমনি সমাজের ভয়াবহতা সাক্ষাতে তুলে ধরবে। তথ্যবিচারে একথা দৃঢ়ভাবে বলা যায় সমাজে ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বিরাট স্বার্থকে চরিতার্থ করার কৌশল।
এখন প্রশ্ন হল, কার বা কাদের স্বার্থ? কিসের স্বার্থ? ধর্ষণ আদতে পিতৃতন্ত্রের আস্ফালন। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় পিতৃতন্ত্র সাধারণ বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদী সমাজ পিতৃতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে টিকিয়ে রাখতে চায় নিজেদের দীর্ঘস্থায়ীত্বের স্বার্থে। পিতৃতন্ত্র মুখ্যত পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যা প্রতিক্ষেত্রেই নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই আধিপত্যবাদের বহিঃপ্রকাশ পরিবারের চৌহদ্দির পাশাপাশি বাহ্যিক জগতের অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও, যেমন, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের বিস্তৃত পরিসরে। পিতৃতন্ত্রই প্রণয়ন করে আইন বা বিধিবিধান। যেগুলির বেশিরভাগ অংশই সুপরিকল্পিতভাবে রচিত ও প্রয়োগ করা হয় নারীদের পীড়নের উদ্দেশ্যে। উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈষম্যই এর মূল কারণ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীকে গ্রহণ করা হয়েছে পণ্য হিসাবে। নারীর নারীত্বকে বাজারে সামিল করে মুনাফা অর্জনের পথ তৈরি করা হচ্ছে। মুনাফা সর্বস্ব পুঁজিবাদী সমাজে নারীকে কুক্ষিগত করে রাখার বিরামহীন প্রচেষ্টা চালানো হয় পিতৃতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার মধ্য দিয়ে। এই সমাজে নারী ভোগের প্রতীক — ভোগ্যপণ্য। পুরুষ মনে করে নারী তার অধীনস্থ শ্রেণী। নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য পুরুষের কাছে নেই। নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রশ্নটি চাপা পড়ে থাকে পিতৃতন্ত্রের কঠোর বিধি-নিষেধের আয়তায়। তাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণ নিয়মিত ঘটনা হিসাবে প্রতিভাত হয়।
অন্যদিকে আরও একটি বিষয় ধর্ষণের ক্ষেত্রে আলোচনার দাবি রাখে, পুঁজিতন্ত্রে পুঁজিপতিরা নিজেদের অনুগামী সরকার গঠনে সর্বদা প্রয়াসী থাকে। পুঁজিপতিদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সহযোগিতার ভিত্তিতে নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতা লাভ করে, তারা পুঁজিপতিদের স্বার্থকে চরিতার্থ করার ব্রতে দীক্ষিত। প্রতি পাঁচবছর অন্তর জনগণের সামনে দক্ষিণপন্থী দলগুলির মধ্যে বিকল্প নির্মাণ করে পুঁজিবাদ জনগণের উপর শোষণ, নিপীড়ন চালিয়ে মুনাফা অর্জনের কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রকৃত বামপন্থীদলগুলি পুঁজিপতিদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা জারি রাখে। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা, দাবি, চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে তা পূরণের অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থায় পদার্পন করে। কিন্তু প্রকৃত জনগণের সরকার না হওয়ায় দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি আপামর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দাবি, চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাকে পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। ধীরে ধীরে জনগণ বুঝতে শুরু করে সরকারের প্রকৃত জনবিরোধী চরিত্র। জনগণ ধীরে ধীরে সরকার বিরোধী হয়ে ওঠে।
এমতাবস্থায় অধিষ্ঠিত সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করে ক্ষমতা ভোগের সময়কালকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। জনগণ ও সরকারের এই টানাপোড়েনের মাঝে সরকারের পক্ষে পুঁজিপতিরা সমর্থন যুগিয়ে নিজেদের কাজ হাসিল করে। জনরোষের তীব্রতাকে উপলব্ধি করে সরকার নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় সমাধানের পথ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়। যেহেতু সরকার জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেলে, তাই জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজে বলপ্রয়োগকারী লুম্পেন গোষ্ঠী তৈরি করে। এই লুম্পেন গোষ্ঠীর মূল কাজই হয়ে দাঁড়ায় সমাজের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসমূলক কাজ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আপামর জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা। সরকারের মদতপুষ্ট এই লুম্পেনগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভোটে ছাপ্পা, অবৈধ জমি দখল, বেআইনি নির্মাণ, মিথ্যা মামলাসহ ধর্ষণের ঘটনা বাস্তবায়িত করে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় পুঁজিতন্ত্রে ধর্ষণ নিঃসন্দেহে একটি দমনের সংস্কৃতি, আধিপত্যের সংস্কৃতি। ধর্ষণের মতো এই নিলজ্জ, অমানবিক, ঘৃণিত অপকর্মকে চিরতরে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে হলে অবশ্যই সমাজটাকে পরিবর্তন করতে হবে। ভেঙে ফেলতে হবে পুঁজিবাদের সুউচ্চ প্রাচীর। এক্ষেত্রে আন্দোলনের নেতৃত্ব তুলে নিতে হবে বামপন্থীদের হাতে। বামপন্থীরাই তাঁদের প্রগতিশীল চেতনা, রাজনৈতিক সচেতনতার উপর ভর করে সমাজ পরিবর্তনের মহাযজ্ঞে সামিল হবেন। তাই সমস্ত বামপন্থীদের কাছে আহ্বান করি, ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলির চিরতরে বিনাশ করে সমাজে ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য ও অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আপামর জনসাধারণকে নিয়ে আন্দোলনের পথে শামিল হওয়ার।
- সেখ আসরাফ আলি