কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যা যদি দেখায় যে হাসপাতাল মহিলা ডাক্তারের জন্য নিরাপদ স্থান নয়, তবে মহারাষ্ট্রের ঠানের বাদলাপুর প্রমাণ করল স্কুলও শিশুদের জন্য সুরক্ষিত স্থান নয়। আক্ষরিক অর্থেই দুই দুধের শিশু ধর্ষিত হল বাদলাপুরের নামিদামি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের পরিচারক অক্ষয় শিন্ডের হাতে।
ঘটনা ১৩ আগস্টের, এক শিশু বাড়িতে গিয়ে যৌনাঙ্গে ব্যাথার কথা জানালে অভিভাবকরা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। এবং চিকিৎসক শিশুকে পরীক্ষা করে জানিয়ে দেন শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণ কি আজকের ভারতে এতটাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে চার বছরের শিশুকেও ধর্ষণযোগ্য মনে করছে মনুষ্যরূপী পিশাচরা?
ঘটনার পর পুলিশ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তারা শিশু ধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। পুলিশ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ ক্রোধে ফেটে পড়লেন। গত ২০ আগস্ট স্থানীয় জনগণ ও ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা স্কুলের সামনে বিক্ষোভে শামিল হলেন। পুলিশ সমবেত জনগণকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে তাদের দিকে ইট-পাথর ধেয়ে এল। হাজার-হাজার জনগণ বাদলাপুর রেল স্টেশন অবরোধ করলেন, ট্রেন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটল, বহু ট্রেন বাতিল হল। আক্রান্ত হল রেলের কার্যালয়ও। পুলিশ লাঠি চালালো, সমস্ত স্থানে পুলিশ মোতায়েন হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রইল না। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ২০ আগস্ট ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হল, পরদিন ২১ আগস্ট বিভিন্ন জেলা ও শহরে সংগঠিত হলো প্রতিবাদ। পুলিশ ৭২ জনকে গ্রেপ্তার করলো, এফআইআর হল আরো ৫০০ জনের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তকে স্কুলের প্রশ্রয় দান ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাজ্যের বিরোধী পক্ষ রাস্তায় নামল এবং ২৪ আগস্ট মহারাষ্ট্র বনধের ডাক দিল। কিন্তু মহারাষ্ট্র হাইকোর্ট নির্দেশ দিল — এই ঘটনায় কেউ বনধ ডাকতে পারবে না। হাইকোর্টের নির্দেশে বিজেপির জোট সরকার কিছুটা স্বস্তি পেল, কেননা শিশু ধর্ষণের নারকীয় অপরাধের বিরুদ্ধে জনগণের যে মেজাজ দেখা গিয়েছিল তাতে বনধ সফল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনাই ছিল। বিরোধী নেতা উদ্ধব ঠাকরে বললেন, “আমরা ২৪ আগস্টের মহারাষ্ট্র বনধ তুলে নিয়েছি, তবে বিরোধী নেতারা মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ জানাবেন। বনধ নিয়ে মহারাষ্ট্র হাইকোর্টের নির্দেশের সঙ্গে আমরা সহমত নই।”
স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগটা ঠিক কি? ঘটনাটা ১৩ আগস্ট ঘটলেও এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ ঘটনাটা সম্পর্কে অবহিত হলেও অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয় তার তিন দিন পর, ১৬ আগস্ট। এই সংবাদও বেরিয়েছে যে স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রথমে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি, নীরব থেকেছিলেন এবং অভিযুক্তর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছিলেন। পুলিশও তদন্তে গড়িমসি করেছে, নিগৃহীতা শিশুদের বাবা-মাকে ১১ ঘন্টা থানায় বসিয়ে রাখার পরই এফআইআর নেওয়া হয়। এই সংবাদও বেরিয়েছে যে, থানার এক মহিলা অফিসার শিশুদের মা-বাবাকে বলেন, স্কুলে গিয়ে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ হলে তবেই এফআইআর নেওয়া হবে। মহারাষ্ট্রের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সভাপতি সুজিবেন শাহ বলেন, “স্কুল পুলিশে অভিযোগ না জানিয়ে বিষয়টা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল। এমনকি দুটি শিশুকে ধর্ষণের মতো অপরাধ স্কুলের ভিতরে হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ নিগৃহীতাদের পরিবারকে কোনো রকম সাহায্য করেনি। আমার তাঁদের কাছে প্রশ্ন, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন পকসো আইনে মামলা হবে না।” আর এটাও বাস্তব যে, জেলা নারী ও কল্যাণ বিভাগ হস্তক্ষেপ করার পরই পুলিশ পকসো আইনে মামলা দায়ের করে।
অপরাধে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ১৯ আগস্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল, শ্রেণী শিক্ষক ও দুই অশিক্ষক কর্মীকে সাসপেন্ড করে। কর্তব্যে গাফিলতি ও এফআইআর নিতে দেরি করার জন্য এক ইন্সপেক্টর-সহ তিন পুলিশ কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তের জন্য এক আইপিএস অফিসারের নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছে। তবে, এই সমস্ত পদক্ষেপই হয়েছে জনগণ রাস্তায় নামার পরই।
জোট সরকারের শাসক দল বিজেপির সঙ্গে স্কুলের পরিচালকদের যোগ থাকার জন্যই কি স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ অপরাধের তদন্তে, অপরাধীকে গ্রেপ্তারে ঐ রকম টালবাহানা করছিল? ঐ ইংরাজি মাধ্যম স্কুল পরিচালনা করে আদর্শ বিদ্যা প্রসারক নামে একটি ট্রাস্ট। ঐ ট্রাস্টের সভাপতি উদয় কোটওয়াল বিজেপি কর্মকর্তা। ট্রাস্টের সম্পাদক তুষার আপ্তের সঙ্গেও বিজেপির যোগ রয়েছে। উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা সাংসদ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী জানিয়েছেন, শিশু ধর্ষণে অভিযুক্ত অক্ষয় শিন্ডে স্কুলের কাজে যোগ দেওয়ার আগে বিজেপির অফিস কর্মকর্তা তুষার আপ্তের খামারবাড়িতে কাজ করত। অতএব, স্কুল পরিচালকদের সঙ্গে শাসক বিজেপির যোগ একেবারেই পরিষ্কার, এবং শিশু ধর্ষণের ঘটনাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিপ্রায়, অপরাধের তদন্তে পুলিশের অনাগ্ৰহের পিছনে কারণকে খুঁজে পাওয়াটা মোটেই দুরূহ নয়।
হাসপাতাল, স্কুল, পথঘাট, রেল স্টেশন থেকে সমস্ত স্থানই আজ যদি নারী-শিশুদের পক্ষে নিরাপত্তাহীন হয়ে দাঁড়ায় তার দায় কি রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায় না? আজ যাঁরা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন, কেন্দ্রে ও বিভিন্ন রাজ্যে যাঁরা ক্ষমতায় রয়েছেন, কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁরা পরিস্থিতিকে নারীর অনুকূল করতে উদ্যোগ নিয়েছেন? সব বড় দলই কি নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্তদের, ধর্ষণে অভিযুক্তদের তোষণ করে না, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করে না?
নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ শ্লোগান দিয়েছিলেন। বাস্তব পরিস্থিতি প্রতিদিনই ঐ শ্লোগানকে বিদ্রুপ করে চলেছে। গত ২৫ আগস্ট মহারাষ্ট্রেরই জলগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধকে ‘অমার্জনীয় পাপ’ বলে বর্ণনা করলেন এবং আরও বললেন, অপরাধীরা যেন কোনওভাবে ছাড় না পায়। কিন্তু তাঁর নিজের দলই কী নারী-বিরোধী হিংসায় যুক্তদের সবচেয়ে বেশি পুরস্কৃত করে না। জাতীয় অপরাধ নথিভুক্তি ব্যুরো, এনসিআরবি’র হিসাব অনুযায়ী মোদী জমানায় ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে ৩১ শতাংশ; ২০১৪ সালে যে সংখ্যাটা ছিল ৩,৩৭,৯২২ সেটা বেড়ে ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৪,৪৫,২৫৬। এটা শুধুই পুলিশের কাছে দায়ের হওয়া অপরাধের সংখ্যা, এর বাইরে প্রতিদিনই নারীদের আরো অসংখ্য নিপীড়ন, হিংসার মুখে পড়তে হয়। নারী-বিরোধী অপরাধে জড়িত থেকছেন, নারীদের বিরুদ্ধে হিংসা সংঘটিত করেছেন, এমন সাংসদ ও বিধায়করা সব বড় দলে থাকলেও বিজেপিতে তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রাইটস জানিয়েছে, বিজেপিতে এই ধরনের সাংসদ ও বিধায়ক রয়েছেন ৫৪ জন। নারী-বিরোধী হিংসায়, যৌন নিগ্ৰহে বিজেপি নেতাদের জড়িত থাকার বহু ঘটনা থাকলেও এখানে আমরা দৃষ্টান্তমূলক দুটি ঘটনারই উল্লেখ করব। জম্মুর কাঠুয়ায় ২০১৮ সালে ধর্ষণ করে হত্যা করা হল যাযাবর সম্প্রদায়ের ৮ বছরের এক বালিকাকে। সেই ধর্ষক, বিশেষ পুলিশ অফিসার দীপক খাজুরিয়ার সমর্থনে, তার মুক্তির দাবিতে বিজেপি আওয়াজ তোলে, মিছিল সংগঠিত করে। আর বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর আখ্যান বহু চর্চিত হলেও এখানে তার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কুস্তি সংস্থার প্রধান হিসাবে তিনি মহিলা কুস্তিগীরদের কাছে দাবি করতেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রার্থী হতে গেলে তাঁর যৌন আকাঙ্খাকে তৃপ্ত করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীররা দীর্ঘ আন্দোলন চালালে মোদী সরকারের নিপীড়নের মুখে তাদের পড়তে হয়। এই ধরনের রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-নেত্রীরা মুখে নারীর সম্মান-মর্যাদা রক্ষার কথা বললেও বাস্তবে তাঁদের ক্রিয়াকলাপ নারীর নিরাপত্তার বিপর্যয় ঘটায়, তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। বাদলাপুরের স্কুলের শিশুদের সুবিচার সুনিশ্চিত করতে হলে জন আন্দোলনের চাপের মধ্যে দিয়েই তাকে সম্পন্ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট কলকাতার আরজিকরের ঘটনায় যেমন স্বতঃপ্রণোদিত ব্যবস্থা নিয়েছিল, বাদলাপুরের শিশুদের যৌন হেনস্থাও তাদের কাছে গুরুত্ব পাবে না কেন?
- জয়দীপ মিত্র