চন্দননগরে (হুগলি) অনুষ্ঠিত আয়ারলার ৭ম সর্বভারতীয় সম্মেলন পরবর্তীতে এটি ছিল আয়ারলার নতুন কমিটির প্রথম জাতীয় কাউন্সিল বৈঠক। বৈঠকে শুরুতেই কমরেড নাগভূষণ পট্টনায়েকের মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। আয়ারলা’র প্রয়াত জাতীয় সভাপতি শ্রদ্ধেয় কমরেড ক্ষিতীশ বিসওয়ালের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। সকল শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরদিন ৫ আগস্ট নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড সরোজ দত্তের শহীদ দিবসে তাঁর প্রতি নীরব শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
বিহার থেকে নির্বাচিত দুই এমপি কমরেড সুদামা প্রসাদ ও কমরেড রাজারাম সিং’এর বিজয়ে আয়ারলা জাতীয় কাউন্সিল আনন্দ প্রকাশ করে এবং আশা প্রকাশ করে যে এই বিজয় দেশের দলিত, গরিব, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুবদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
গৌরবময় দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ কে রায়ের প্রতিষ্ঠিত ঝাড়খণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ বাম সংগঠন মার্ক্সিস্ট কোঅর্ডিনেশন কমিটি ‘এমসিসি’র সাথে সিপিআই(এমএল)-এর সংযুক্তির ঘোষণা একটি উৎসাহজনক অগ্রগতি। বিহার-ঝাড়খণ্ডের শ্রমিক-আদিবাসী-বঞ্চিত জনগণের লড়াইয়ে এই সংযুক্তি নতুন মাত্রা যোগ করবে।
জাতীয় কাউন্সিল বৈঠকে অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের কমরেডরা আসতে পারেননি। বিজেপির সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কর্মসূচি সংগঠিত করতে ব্যস্ত থাকায় ত্রিপুরার কমরেডদের উপস্থিতি সম্ভব হয়নি।
আয়ারলা জাতীয় কাউন্সিল বৈঠকে গৃহীত মূল সিদ্ধান্তসমূহ
(১) মোদী সরকারের সাম্প্রতিক বাজেট দলিত-গরীব-শ্রমিক বিরোধী বাজেট। আজকের এই কর্পোরেট জমানায় বিশাল পরিমাণ মজুরি ঘোটালা চলছে। এমএনআরইজিএ সহ কোন ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। দেশের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কোন গুণগত পরিবর্তন আনা হয়নি। নীচুতে রাখা মজুরি হারের অমানবিক বাতাবরণে দেশে চলছে কর্পোরেট মজুরি লুঠ। বুলডোজার রাজ চলছে দরিদ্র-দলিত-আদিবাসী সহ বঞ্চিত মানুষের উপর। মানুষ নিজের দেশেই বাসস্থানের অধিকার থেকে বঞ্চিত। জল-জঙ্গল-জমি থেকে উচ্ছেদ এক সাধারণ পরিঘটনায় পরিণত। ২০২২-এর মধ্যে সকলকে আবাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল মোদী সরকারের, আজ তারাই দলিত-গরিব-সংখ্যালঘু জনগণের ঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাজেট বরাদ্দ ইতিমধ্যে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ আবাস একটি জাতীয় ইস্যু হয়ে আছে। বিহারের অর্ধেক মানুষ প্রয়োজনীয় আবাস থেকে বঞ্চিত। দেশ থেকে ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করতে খাদ্যের অধিকার আইনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে তারা ৫ কেজি শুকনো রেশন দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে! কৃষক সহ ভাগচাষীদের জমি দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে। মহিলা শ্রমশক্তির সংখ্যাগত বৃদ্ধি এবং আর্থিক উপার্জনের লক্ষ্যে তাদের ক্রমবর্ধমান স্বাধীন অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। অন্যদিকে মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানীগুলির জুলুম ও লুটতরাজ আরো বড় পরিধিতে ছড়িয়ে পড়েছে, যা মহিলা আত্মহত্যার ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। নারীদের শ্রমশক্তি ও দক্ষতাকে সরকার দ্বিতীয় মানের সস্তা শ্রম রূপে ব্যবহার করছে। যে সরকার ‘এক দেশ, এক কর ব্যবস্থা’র কথা বলে তারা কিন্তু দেশের বৃদ্ধ, মহিলা ও অক্ষমদের জন্য সম্মানজনক সামাজিক নিরাপত্তা পেনশনের ‘একটিই জাতীয় ব্যবস্থা’ চালু করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। বিহারে যখন মাসিক পেনশন ৪০০ টাকা, সেখানে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার দেয় ৪,০০০ টাকা পেনশন। বিদ্যুৎ, জল, স্বাস্থ্য সামগ্রীর অধিকার, দরিদ্র ঘরের বাচ্ছাদের শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে গোটা ব্যবস্থা দিনের পর দিন নিরুত্তাপ থাকছে।
আমাদের সংগঠন স্থির করেছে ‘৫ গ্যারান্টি ও ১০ দাবি’তে দেশজুড়ে প্রচারাভিযান সংগঠিত করা হবে। স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন, ১৪ আগস্ট এই দাবিসনদ আয়ারলার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি, বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে পাঠানো হবে।
(২) বিহারে সিপিআই(এমএল) দলিত ও দরিদ্রদের এক বিরাট আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। ২১ আগস্ট থেকে ২৩ আগস্ট ব্লকে ব্লকে আবাসের দাবিতে এবং বিহারের অতি দরিদ্র ৯৫ লক্ষ পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে অনুদানের যে ঘোষণা করা হয়েছিল, তার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। আয়ারলা এই কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে পূর্ণ শক্তিতে নিয়োজিত আছে। একারণে জাতীয় কাউন্সিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে ২৩ আগস্ট দেশজুড়ে ব্লক, মণ্ডল, তহশীলগুলিতে জাতীয় দাবিসনদের পাশাপাশি ঐ রাজ্যগুলির নিজ নিজ জ্বলন্ত সমস্যাগুলিতে সমাবেশ/ধর্ণা প্রদর্শন করা হবে।
২৩ সেপ্টেম্বর জেলা সদরগুলিতে এই কর্মসূচি সংগঠিত করতে হবে। গ্রামীণ দরিদ্রদের শ্রেণী ভিত্তিক সামাজিক-রাজনৈতিক দাবিগুলির তুলে ধরা হবে। এগুলিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। এই কর্পোরেট রাজত্বে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবদের স্বাভাবিক অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এই দাবিগুলিতে আগামী নভেম্বরে ‘দিল্লী চলো’র যে প্রস্তাব এসেছে, সেটি বিবেচনা করা হবে।
(৩) সুপ্রিম কোর্ট ৭ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ এসসি/এসটি সংরক্ষণ নিয়ে যে রায়দান করেছে, আমরা সেক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করি। আমাদের দৃঢ়ভাবে এটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে দলিত ও আদিবাসীদের জন্য সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি দুর্বল করা চলবে না। আর্টিকেল ৩৪১’র স্পিরিটকে অক্ষত রাখতে হবে। ক্রিমি লেয়ার ধরণের কোন ধারণা চাপিয়ে দেওয়ার কোন প্রচেষ্টা চলবে না। অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং দলিত-আদিবাসী যাতে সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে তা সুনিশ্চিত করতেই সংরক্ষণ ব্যবস্থা।
এটা ঠিক যে দলিত-আদিবাসীদের মধ্যে বঞ্চিতরা যাতে এই ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে, তার জন্য সাংবিধানিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। একই সাথে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে বিজেপি যাতে দলিত-আদিবাসীদের মধ্যে বিভাজনের নোংরা রাজনীতি খেলতে না পারে।
২১ আগস্টের ভারত বনধ আমাদের কর্মসূচি নয়। কারা এই বনধ ডেকেছে, এটাও পরিষ্কার নয়। আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ডাক দেওয়া এড়িয়ে যাব।
(৪) জাতীয় কাউন্সিল এমএনআরইজিএ ও মহিলা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে বিশেষ জোর দিচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গরিবমুখী প্রকল্প যে কারণে প্রতিটি রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ জমেছে। দেশে সরকার ঘোষিত যে ন্যূনতম মজুরি তার থেকে নারেগা’য় মজুরি অনেক কম, এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার কর্মদিবস (প্রতিদিনের কাজের সময়সীমা) বাড়িয়ে এবং মজুরি প্রদান পদ্ধতি জটিল করে, এই প্রকল্প তুলে দিতে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এটি চাহিদা ভিত্তিক কাজের আইন হলেও একে বদলে দেওয়া হচ্ছে এবং এরজন্য বাজেট বরাদ্দ খুবই কম করা হয়েছে। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে অর্থ দিতে টালবাহানা চলছে। পশ্চিমবঙ্গ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বকেয়া মজুরি প্রদান না করায় শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন। আমাদের সংগঠন স্থির করেছে নারেগা নিয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হবে। প্রথমে ১০০ ব্লকে জোর দেওয়া হবে। রাজ্য ও জেলাগুলিকে এই ব্লকগুলি চিহ্নিত করতে হবে এবং এই দিশায় জোর দিতে হবে। বর্ষায় নারেগা’য় কোনো কাজ সেভাবে হয় না, এসময় জবকার্ড তৈরি করা এবং বাতিল জবকার্ডগুলির পুনরুদ্ধারে জোর দিতে হবে।
সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে নারেগা শ্রমিক ও মহিলা শ্রমিকদের বৈঠক সংগঠিত করতে হবে।
মাইক্রোফিন্যান্সে যুক্ত মহিলাদের মধ্যে এবং জীবিকা মিশনে যুক্ত মহিলাদের মধ্যে সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। ইতিপূর্বে আসাম ও পঞ্জাবে এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি সকল রাজ্যেও এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
গান্ধী জয়ন্তীর আগে, ১ অক্টোবর পঞ্চায়েত ভবনের সামনে নারেগা শ্রমিকদের সমাবেশ সংগঠিত করতে হবে এবং কাজের দাবিতে দরখাস্ত (ফর্ম ৪ক) জমা করতে হবে।
দিল্লী অভিযানের কেন্দ্রীয় বিষয় থাকবে এমজিএনআরইজিএ।
বৈঠকে নারেগা সেলের কনভেনর পি এস অজয় কুমার একটি পেপার উপস্থিত করেন। নারেগা আন্দোলনের ২য় পর্যায়ে একটি বুলেটিন প্রকাশ করা হবে। নভেম্বর/ডিসেম্বরের দিল্লী অভিযান অন্যান্য সংগঠনগুলির সাথে যুক্তভাবে হতে পারে।
(৫) আগামী জাতীয় সম্মেলনের পূর্বে জাতীয় কাউন্সিল সংগঠনের কাজের বিস্তার ৩০০ জেলা, ৩০০০ ব্লক এবং ৫০০০ পঞ্চায়েতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে। এরজন্য জোর দিতে হবে বাকি রাজ্যগুলি এবং নিষ্ক্রিয় থাকা রাজ্যগুলির উপর। আয়ারলা নেতৃত্বের টিম কাজের এই দিশায় সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করবে। উড়িষ্যা, কর্নাটক, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে আয়ারলা কাঠামো স্থাপনে মনোযোগ বাড়ানো হবে। জেলা সম্মেলনগুলি এবং বাকি যে রাজ্যগুলির সম্মেলন হয়নি, সেখানকার সম্মেলন এই বছরের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। রাজ্য সম্মেলনগুলি থেকে সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। পঞ্জাব, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ডে বড় সংখ্যায় সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করতে হবে।
দরিদ্র মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা পঞ্চায়েত ও গ্রাম কমিটিগুলিই আয়ারলা আন্দোলনের ভিত্তি। কাঠামো স্থাপনে এই বিষয়ে জোর রাখতে হবে। ব্লক/অঞ্চল/মণ্ডল/তহশিল কমিটি শক্তিশালী করতে বিশেষ নজর দিতে হবে কারণ এই কমিটিগুলির সাথে আমজনতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে। যুব ও মহিলাদের থেকে ক্যাডার গড়ে তুলতে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে।
(৬) আয়ারলা’র হিন্দি বুলেটিন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
(৭) আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চার সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করা এবং এর সাংগঠনিক বিস্তার নিয়েও কাউন্সিল চর্চা করে।
(৮) কয়েকটি শ্লোগান প্রতিটি গ্রামে জনপ্রিয় করে তুলতে সংগঠন ডাক দিয়েছে,
• দাম বাঁধো, কাজ দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও।
• দাম বাঁধো, কাজ দাও, কাজের সঠিক মজুরি দাও।
• বুলডোজার রাজ খতম কর, আবাস অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাও।
• এমএনআরইজিএতে দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি, ২০০ দিনের কাজ দাও ।
• অবসরপ্রাপ্ত সকল মেহনতি, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের মাসিক ৫০০০ টাকা পেনশন সুনিশ্চিত কর।
- ধীরেন্দ্র ঝা, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, আয়ারলা