৯ আগস্ট ভোরে, একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ পশ্চিমবঙ্গকে হতবাক করে দিয়েছে। কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের চেস্ট মেডিসিন বিভাগে কর্মরত এক তরুণ স্নাতকোত্তর শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে নির্মমভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। এই নৃশংসতা শুধু চিকিৎসক সম্প্রদায়কেই নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের গভীরে থাকা দুর্নীতি এবং পুরুষতান্ত্রিক হিংসার নির্মম দিকটিকেও প্রকাশ করেছে।
আরজি কর মেডিকেল কলেজ প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া এই ট্র্যাজেডিকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। অধ্যক্ষ মিঃ সন্দীপ ঘোষ, নির্যাতিতার মা বাবাকে ডেকে পাঠান এবং তাদের মেয়ের মৃতদেহ দেখার জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বাধ্য করেন। নির্যাতিতার শরীরে ভয়ঙ্কর জখম থাকা সত্ত্বেও যা একটি ফৌজদারি অপরাধের ইঙ্গিত দেয়, প্রাথমিক পুলিশ রিপোর্টে তাঁর মৃত্যুকে “অস্বাভাবিক” হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং অধ্যক্ষ এটিকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। জনরোষ ছড়িয়ে পড়ার পর, প্রায় পুরো একদিন পরে রাত ১১.৪৫টায় একটি এফআইআর দায়ের করা হয়। ১০ আগস্ট, প্রধান সন্দেহভাজন সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করা হলেও জনগণের ক্ষোভ কমেনি। ঘটনায় সরকারী হাসপাতালের অভ্যন্তরে বিদ্যমান দুর্নীতির গভীরতা এবং অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ ও কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। এহেন অধ্যক্ষ্য সন্দীপ ঘোষ সংবাদ সম্মেলনে নির্যাতিতার পরিচয় প্রকাশ করে এবং নির্যাতিতা রাতে একা থাকাকে ঘটনার জন্য দায়ী করেন তার উপর হওয়া নির্যাতনের জন্য। এই মন্তব্য সমাজের পিতৃতান্ত্রিক ধর্ষণ সংস্কৃতির একটি প্রতিফলন।
নির্লজ্জভাবে নির্যাতিতাকে দোষারোপ করা এবং নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় একটি শক্তিশালী আন্দোলনের জন্ম হয়। শ্রেণী, বর্ণ, যৌনতা, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে সকল স্তরের নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক যৌন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষেরা স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে রাতের দখল করতে একত্রিত হয়েছিল। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, দুই বছর আগে স্বাধীনতা দিবসেই, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের গুজরাট হাইকোর্ট বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল এবং বিজেপি কর্মীরা মালা দিয়ে তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতা পরিচয়ের মানুষদের সমানাধিকার ও স্বাতন্ত্র্যের সংকটকে তুলে ধরার বিপরীতে, দুই বছর পর, ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ ব্যানারে এই গণ-অভ্যুত্থান লিঙ্গ ন্যায়বিচারের, ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার আহ্বান তোলে। লক্ষাধিক নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক যৌন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষেরা পশ্চিমবঙ্গের ২৫০টিরও বেশি এলাকা থেকে এবং মুম্বাই ও দিল্লিসহ ভারতের অন্যান্য শহরগুলোতে রাতকে ভরিয়ে রেখেছিলেন আর জি করের নির্যাতিতার ন্যায়-বিচারের দাবিকে সামনে রেখে। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি যার অন্যতম দিক হল মেয়েদের শরীর জীবন যাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা তাকে ধাক্কা দিয়েছে এই গণজাগরণ। যৌন-হিংসার ন্যায়বিচারের দাবিতে এই গণ-অভ্যুত্থান শুধুমাত্র আর জি করের নির্যাতিতার জন্য ছিল না; তার সাথে জুড়ে গেছিল প্রতিটি নারী, ট্রান্স এবং কুইয়ার ব্যক্তির রাগ ও আকাঙ্ক্ষা, যারা প্রতিদিনের ভিত্তিতে ধর্ষণের সংস্কৃতির মুখোমুখি হয়।
যখন এই আন্দোলনটি গতি পাচ্ছিল, রিক্লেইম দ্য নাইটের একই রাতে, আরজি কর এবং এনআরএস হাসপাতালে প্রতিবাদরত পড়ুয়া এবং ডাক্তারদের অবস্থানমঞ্চের উপর রাষ্ট্রীয় উদ্দ্যেশ্য-প্রণোদিত গুন্ডারা আক্রমণ চালায় এবং মহিলা নার্স ও ডাক্তারদের ধর্ষণের হুমকি দেয়। এই রাতটি আরও একটি ভয়ঙ্কর অপরাধের সাক্ষী ছিল: বর্ধমানের শক্তিগড়ে এক আদিবাসী মহিলাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হিংসা সেখানেই থেমে থাকেনি। ১৫ আগস্ট, রবীন্দ্র সদনে রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনী (আরপিএফ)-র বেশ কয়েকজন রূপান্তরকামী মহিলাদের হেনস্থা করে, এছাড়াও নন্দীগ্রামে বিজেপি কর্মীদের দ্বারা একজন মহিলাকে নগ্ন করে ঘোরানো হয়। অনেক নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষ তাদের হেনস্থার অভিজ্ঞতা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছিলেন। এর থেকে স্পষ্ট যে এই আন্দোলন একটি প্রতীকী প্রতিবাদের চেয়ে অনেক বৃহৎ; এই আন্দোলনের ক্ষমতা আছে সত্যিকার অর্থে গণ-পরিসর ও সমাজে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার সমীকরণকে বদলানোর এবং হিংসা ও বঞ্চনার ঊর্ধ্বে সমাজে নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের দখল প্রতিষ্ঠা করার। আই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, আন্দোলনের সংকল্প আরও শক্তিশালী হয়েছে। ১৪ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত হচ্ছেন। রাত দখল অধিকার দখল আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১৭ আগস্ট, প্রায় ৩০০০ জনেরও বেশি নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষরা সংহতি প্রকাশ করতে আরজি কর-এর দিকে রওনা হয়েছিলেন এবং ২৫ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জবাব চাওয়ার জন্য গণপরিসরে মেয়েদের দখল, সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থা বিরোধী কাঠামোগুলিকে দায়বদ্ধ ও শক্তিশালী করা এবং স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার দুর্নীতির প্রশ্নকে সামনে রেখে তিন দফা দাবিতে হাজার হাজার মানুষ মিছিলে সংগঠিত হন।
জনগণের এই অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে এবং আরএসএস এবং বিজেপির মতো ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি এই অভ্যুত্থানের ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে। এই গোষ্ঠীগুলি, যারা ঐতিহাসিকভাবে পিতৃতন্ত্র ও ধর্ষণ সংস্কৃতির হাত শক্ত করেছে এবং লিঙ্গ ন্যায়ের কণ্ঠস্বরকে দমন করেছে, তারা এখন তাদের স্বার্থে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, আরজি কর-এর এই ঘটনাটি পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রতিফলন এবং এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
আজ আমাদের নির্ভয়া আন্দোলনের দিকে ফিরে তাকানো প্রয়োজন, যা ভারতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিকায় এক গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছিল। এই আন্দোলন কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা ও সমানাধিকারের প্রশ্নে, বিশেষত কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের বিষয় নীতি নির্ধারণে দীর্ঘস্থায়ী কিছু বদল এনেছিল। আন্দোলনের ফলস্বরূপ জাস্টিস ভার্মা কমিশন তৈরি হওয়া এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধ (পিওএসএইচ) আইন প্রণয়ন হওয়া লিঙ্গ রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় জয় ছিল। লিঙ্গ রাজনীতির বিষয় কাজ করা সংগঠন, পড়ুয়া সংগঠন, এআইপিডব্লিউএ, এবং এআইএসএ সহ নাগরিক সংগঠনগুলো এই বদলের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে যৌন হেনস্থাকে নারীদের জীবন ও মর্যাদার মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হিসাবে চিহ্নিত করে। এই আইন অনুযায়ী প্রতিটি সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে স্থানীয় তদন্ত কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়াও প্রতিটি ক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থা রুখতে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা তৈরি করার বিষয় বিভিন্ন সুপারিশ দেয়। কিন্তু আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা POSH আইনের বাস্তবায়ন ও কমিটি গুলির উপস্থিতি ও কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে।
এই প্রেক্ষাপটে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ১৭-দফা সার্কুলার, রাত দখল অধিকার দখল আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা দাবিগুলিকে চুপ করানোর একটা প্রচেষ্টা বলে মনে হয়। প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো, যেমন মেয়েদের রাতের ডিউটি কমিয়ে দেওয়ার নিদান, আন্দোলন থেকে উঠে আসা মহিলাদের স্বাধীনতার দাবি নিশ্চিত করার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির রাস্তা পরিষ্কার করছে। উদাহরণস্বরূপ, আরজি কর-এ যেখানে ঘটনা ঘটে সেই স্থানটি সিসিটিভি দিয়ে ঘেরা ছিল, তবুও অপরাধ আটকানো যায়নি। এই প্রশ্ন থেকে যায় যে নারী, প্রান্তিক লিঙ্গ, যৌন পরিচয়ের মানুষের জন্য নিরাপদ স্থান বলতে কী বোঝায়। নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রের প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায়, ‘সংহতি, নজরদারি নয়; মুক্তি, সুরক্ষা নয়।’ এই আহ্বানে নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের ডাকে ১৯ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ৩০টি স্থানে মানব-বন্ধন সংগঠিত হয়।
এছাড়াও রাত দখল অধিকার দখল আন্দোলন আরজি কর-এ পিটিজি ডাক্তারের নৃশংস হত্যা ও ধর্ষণের দ্রুত এবং স্বচ্ছ সিবিআই তদন্তের দাবি করা হয়েছে। এছাড়া, ১৪ আগস্ট রাতে আরজি কর-এ ভাঙচুর ও হামলার জন্য দায়ী সকলের বিরুদ্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। সেই রাতে ডিউটিতে থাকা পুলিশ অফিসারদেরও দায়িত্বে ত্রুটি হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এখন আমাদের সময় এসেছে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোগুলির পরিবর্তনের দাবিকে জোরদার করার জন্য গণ ক্ষোভকে কাজে লাগানোর, যা নারী ও লিঙ্গ সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে এবং রাষ্ট্রের সমান নাগরিক হিসেবে আমাদের স্থান দখল করতে সাহায্য করতে পারে।
মুখ্য দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে: নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা আইসিসি এবং এলসিসির পুনর্গঠন, প্রতি ১ কিলোমিটার দূরত্বে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, ২৪ ঘন্টা গণপরিবহন ব্যবস্থা, কর্মজীবী মহিলাদের জন্য ক্রেস এবং রাতে কাজ করা মেয়েদের, রূপান্তরকামী মানুষ ও প্রান্তিক যৌন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের জন্য বিশ্রামাগার ও কর্মরত উক্ত মানুষদের জন্য হোস্টেল নির্মাণ করা। এসব পরিষেবা অবশ্যই বিনামূল্যে অথবা ভর্তুকিযুক্ত হারে প্রাপ্ত হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পিওএসএইচ আইনের প্রণয়ন এবং ভারত জুড়ে আইসিসি এবং এলসিসির অবস্থার ব্যাপক পর্যালোচনা করার জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা উচিত। এই ব্যবস্থাগুলি নিশ্চিত করবে যে নারী এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সংখ্যালঘু মানুষেরা সত্যিই গনপরিসরে দখল কায়েম করতে সক্ষম হবে।
রাত দখল ও অধিকার আন্দোলন একটি শক্তিশালী অনুস্মারক যে পিতৃতান্ত্রিক হিংসার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই এখনও শেষ হয়নি। যারা ন্যায়বিচার, সমনাধিকার ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকারে বিশ্বাসী, তাদের জন্য এই আন্দোলন এক আকাশ সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আমাদের সংগ্রাম কেবল অপরাধীদের বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যা এই ধরনের নৃশংস ঘটনাকে উসকে দেয়। যতদিন না সমস্ত নারী, রূপান্তরকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা যায় এবং এমন একটি সমাজ নির্মিত হয় যেখানে প্রত্যেকেই নিরাপদে এবং মর্যাদায় বাঁচতে পারে, ততদিন আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।
- সম্প্রীতি মুখার্জী
(কেন্দ্রের সমন্বিত পেনশন প্রকল্প চালু করার পরিপ্রেক্ষিতে এআইসিসিটিইউ’র বিবৃতি)
তৃতীয় দফার মোদী সরকার যে ইউপিএস (সমন্বিত পেনশন প্রকল্প) চালুতে অনুমোদন দিয়েছে তা সরকারি কর্মচারীদের ধোঁকা দেওয়া ও তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিরই একটা চাল। সরকার যদি মনে করে থাকে যে তারা ইউপিএস (সমন্বিত পেনশন প্রকল্প) চালু করে এনপিএস (নয়া পেনশন প্রকল্প) বিরোধী এবং ওপিএস (পুরনো পেনশন প্রকল্প) ফিরিয়ে আনার আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে পারবে, তবে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। ইউপিএস চালু করাটা এনপিএসের সাপেক্ষে গুণগত কোনো পরিবর্তনকে সূচিত করছে না। বিপরীতে, এটা পুরনো পেনশন প্রকল্পের প্রতি কর্মচারীদের অধিকারের, দশকের পর দশক সরকারকে পরিষেবা দেওয়ার বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ লাভের সুবিধা প্রকল্পের সম্পূর্ণ বঞ্চনা।
ওপিএস একটা সুনির্দিষ্ট সুবিধা প্রকল্প এবং এর অধীনে পেনশন লাভের জন্য কর্মচারীদের কোনো অর্থ প্রদান করতে হত না। আদালতগুলো পেনশনকে বকেয়া বেতন বলেই ব্যাখ্যা করেছে। ইউপিএসে অর্থ প্রদান করতে হয় এনপিএসের মতই এবং সেই পরিমাণটা হল কর্মচারীদের ডিএ-সহ বেতনের ১০ শতাংশ।
অবসরগ্রহণ কালে গ্র্যাচুইটির পরিমাণ যথেষ্ট মাত্রায় কমিয়ে দিয়েও কর্মচারীদের বড় ধরনের আঘাত দেওয়া হয়েছে। অবসরগ্রহণ কালে কর্মচারীরা গড়ে সাধারণত ন্যূনতম ২০ লক্ষ টাকা পেতেন, এখন সেটাকে কমিয়ে প্রতি ছ’মাস কাজের জন্য মাসিক বেতনের ১০ শতাংশ করা হয়েছে আর সেটা কয়েক দশক সরকারকে পরিষেবা প্রদানের বিনিময়ে যৎসামান্য অর্থ মাত্র। ওপিএসের মধ্যে যে জিপিএফের সুবিধা ছিল সেটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ইউপিএস হল বাজার নির্ভর প্রকল্প এবং বাজারের মতিগতির ওপর নির্ভরশীল। অতএব, ন্যূনতম পেনশন গ্যারান্টির যে প্রস্তাবই দেওয়া হোক না কেন, ইউপিএস চূড়ান্তরূপেই নিরাপত্তাহীন।
শেষমেষ, এনপিএসের মতো ইউপিএস’ও পেনশনকে প্রাপ্য সুবিধারূপে গণ্য করতে অস্বীকার করে এবং কর্মচারী তাঁর কর্মকালে যে অর্থ প্রদান করেন তারই আনুপাতিক করে তোলে। অধিকন্তু, ইউপিএস সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকটি রায় ও সংবিধানের প্রকট লঙ্ঘন। ইউপিএসের বিরোধিতা তাই করতে হবে এবং ওপিএস’কে ফিরিয়ে আনার আন্দোলন তীব্রতর করে তুলতে হবে।
ওপিএস’কে ফিরিয়ে আনার জন্য দেশের সরকারি কর্মচারীরা যে আন্দোলন গড়ে তুলছেন এআইসিসিটিইউ তার প্রতি সংহতি জানাচ্ছে।
লেনিন একবার বলেছিলেন, “দেয়ার আর ডিকেডস্ হোয়েন নথিং হ্যাপেন্স, দেয়ার আর উইকস্ হোয়েন ডিকেড হ্যাপেন্স”। অর্থাৎ, কখনও কখনও নিস্তরঙ্গ ঘটনাবিহীন কয়েকটা দশক কেটে যায়, আবার এমনও হয় যখন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রবেশ করে একাধিক আন্দোলিত উত্তাল দশক। আজ এ’রাজ্য যেন সেই ঘটনাবহুল পর্বকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে।
ক্ষমতার লাল চোখকে পরোয়া না করে এমনকি বিভিন্ন প্রান্তে এবার স্কুল পড়ুয়ারাও পথে নামছে। বিভিন্ন বর্গের, স্তরের, স্বরের, মতের নাগরিকরা এক পক্ষকাল ব্যাপী তুমুল বিক্ষোভ, প্রতিবাদে রাজপথকে কাঁপাচ্ছে একটাই স্লোগানে — আরজিকর চায় ন্যায়বিচার! এদিকে, দু’সপ্তাহের বেশি সময় পার হল, এখনও চিকিৎসক খুনের রহস্য কাটল না। উত্তর মিলল না রাশি রাশি প্রশ্নের। মৃতার মা একই প্রশ্ন তুলেছেন। যে সিবিআই’কে বিরোধী নেতানেত্রীদের ধড়পাকড় করতে এত সক্রিয় ও তৎপর দেখা যেত, তারা আজও অন্ধকারে। আন্দোলনরত ডাক্তাররা সিবিআই দপ্তরে এই সব প্রশ্ন নিয়ে গেলে তাঁদেরও হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়।
খুন ধর্ষণের হাত ধরে আরজিকর কাণ্ডে প্রকাণ্ড এক দুর্নীতির অভিযোগ আসতে শুরু করেছে, যার মূল পান্ডাই হলেন সন্দীপ ঘোষ। বেওয়ারিশ লাশ পাচার, বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য বিক্রি, দরপত্র ও আর্থিক অনিয়মের ভুরি ভুরি অভিযোগ যে আজ সামনে আসছে, তা নয়। ভূতপূর্ব ডেপুটি সুপার তা নিয়ে রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশনের কাছে অভিযোগ করেন, তদন্তেও তা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত কেন ছাড় পেয়ে যায়, তা আজও রহস্যাবৃত। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট জানাচ্ছে, আরজিকরে অন্য বর্জ্যের থেকে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের পৃথকীকরণ ব্যবস্থার দশা ছিল শোচনীয়। একবার স্যালাইন বোতল ব্যবহার করার পর তা পরিত্যাগ করার বদলে পুনরায় ব্যবহার করা হোত। শুধু আরজিকর নয়, কলকাতার একাধিক সরকারি হাসপাতালে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মর্মান্তিক চিত্রও ফুটে ওঠে। জাতীয় পরিবেশ আদালতও ভর্ৎসনা করে মন্তব্য করে, শহরের প্রধান সরকারি হাসপাতালগুলো জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষাকে বিপন্ন করে তুলছে। এ নিয়ে ২০১৫-২১ পর্যন্ত যে মামলা চলে, তার মোট ৩০টি শুনানিতেই আদালত নিজের বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার উপরে। আরজিকর হাসপাতালে চলতে থাকা অব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় সন্দীপ ঘোষ।
সংবাদমাধ্যমে এটাও উঠে এসেছে, শাসকদলের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করলে পরীক্ষা সহ বিভিন্ন বিষয়ে সুবিধা মিলবে, নয়তো উত্তরবঙ্গে বদলি করা হবে। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা, রেশন ব্যবস্থার পর চিকিৎসা ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্রকে দুর্নীতির গভীর পাঁকে ডুবিয়ে সন্দীপ ঘোষের মতো জনতার আদালতে সাব্যস্ত অপরাধীরা ক্ষমতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রভাবের ছত্রছায়ায় অবাধে তৈরি করেছিল এক বাস্তু ঘুঘুর বাসা।
আজ আরজিকর ইস্যুতে দুকূলপ্লাবি ন্যায়বিচার আন্দোলন এই বিরাট অন্যায় অবিচারকে সমূলে উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে পরিচালিত করার উপরই জোর দিতে হবে। ‘রাত দখলের’ ডাক দেওয়া মেয়েরা সমগ্র ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতির সিন্ডিকেট ভাঙা, কাজের জায়গা ও জনপরিসরে নারী ও রূপান্তরকামীদের নিরাপত্তার আর্জি, সর্বব্যাপী পিতৃতন্ত্রের ও ধর্ষণ মানসিকতার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ প্রতিরোধের মশাল জ্বেলেছেন আর যার সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছেন হাজার হাজার সর্বস্তরের নাগরিক, তার প্রতি রাজ্য সরকারের কোনো ইতিবাচক মনোভাব আজ পর্যন্ত দেখা গেল না।
এই চরম উদ্ধত, অসংবেদী দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের মাধ্যমে আঘাতের পর আঘাত হেনেই দাবি আদায় করতে হবে। পিতৃতান্ত্রিকতা ও ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্ষকদের প্রশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে, ভয়মুক্ত এক নতুন আরম্ভের লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে জাগ্রত জনতার মিছিল।
“জাতিপ্রথা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং যিনি জাতিপ্রথাকে আক্রমণ করেন তিনি ভারতের শত্রু।” এমন মন্তব্য করা হয়েছে আরএসএসের হিন্দি মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’র সম্পাদকীয়তে। জাতিপ্রথাকে এমন খোলাখুলিভাবে গৌরবান্বিত করাটা সাম্প্রতিককালে আর দেখা যায়নি। ভারতের স্বাধীনতার ৭৭তম বার্ষিকীর ঠিক আগেই যে প্রকাশিত হল এই সম্পাদকীয় এবং আজকের ভারতের ‘সরকারি মতাদর্শের’ অভিভাবক যে আরএসএস সামনের বছর তাদের শতবার্ষিকী উদযাপন করবে, এগুলো আমাদের জানাচ্ছে কেন এটাকে দক্ষিণপন্থী পশ্চাদমুখী বিক্ষিপ্ত জিগির বলে উপেক্ষা করা যাবে না।
এটা সুবিদিত যে আরএসএসের ভারত বীক্ষা আর ভরতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিকশিত হওয়া এবং বাবা সাহেব আম্বেদকরের সভাপতিত্বে রচিত ভারতের সংবিধান অনুমোদিত ভারতের বীক্ষা — এই দুই বীক্ষা সর্বদাই পরস্পরের বৈপরীত্যমূলক হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর ঐ সংগঠনের কব্জা থেকে জন্ম নেওয়া ঔদ্ধত্য ও শাস্তি থেকে অব্যাহতি লাভের বোধ থেকেই এই ধরনের রাখঢাক না রাখা কথা আসতে পারে। এই সেদিনই আমরা দেখলাম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সার্কুলার জারি করে আরএসএস সংগঠনে ও তাদের কার্যকলাপে সরকারি কর্মচারীদের যোগদানের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞাকে তুলে নিল।
তার গড়ে ওঠার বছরগুলোতে আরএসএস তাত্ত্বিকরা কখনই তাঁদের মতামতকে গোপন করার চেষ্টা করেননি এবং মনুস্মৃতিকে ভারতের সামাজিক আচরণবিধি রূপে গ্ৰহণ করা এবং মুসোলিনি ও হিটলারের ধারণা ও নীতিসমূহকে অনুকরণ করার কথা খোলাখুলিভাবেই ব্যক্ত করেন। তবে, স্বাধীন ভারতে তার আইনি মর্যাদাকে বজায় রাখার জন্য আরএসএস’কে সংবিধান অনুসারী এক আখ্যানের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এরপর আবার ক্ষমতা অর্জন করা ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের জন্য তাকে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গেও খাপ খাওয়াতে হয়েছিল। আরএসএসের ব্রাহ্মণ্যবাদী কেন্দ্র আজ নিপুণভাবে রপ্ত করেছে এসসি/এসটি/ওবিসি বান্ধব হওয়ার প্রতারণামূলক কৌশলকে।
এই প্রক্রিয়ায় এগোনোর সাথে আরএসএস জাতপ্রথা ও তার সাথে সংরক্ষণ প্রশ্নের মোকাবিলায় এক বহুমুখী কৌশলের উদ্ভব ঘটিয়েছে। তিন দশক আগে ভি পি সিং সরকার যখন মণ্ডল কমিশনের কিছু সুপারিশ রূপায়ণের কথা প্রথম ঘোষণা করে আরএসএস তখন উগ্ৰ সংরক্ষণ-বিরোধী অবস্থানের জন্যই পরিচিত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্ঘ বাহিনী সংরক্ষণ বিরোধিতার নিরর্থকতার বিষয়টা উপলব্ধি করল, এবং তার পরিবর্তে ওবিসিদের একটা অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে জাতপ্রথাকে বিভেদ সৃষ্টিকারী সামাজিক বিন্যাস ঘটানোর হাতিয়ার রূপে ব্যবহারে বিশারদ হয়ে উঠতে লাগল। ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে আমরা শুনলাম, নিম্নবর্ণের জনগণ ২০০০ বছর ধরে যে বৈষম্য ভোগ করেছেন তার অবসানের জন্য মোহন ভাগবত ২০০ বছর ধরে সংরক্ষণকে মেনে নেওয়ার জন্য উচ্চবর্ণের ভারতীয়দের বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
মোহন ভাগবতের মুখে ২০০০ বছর ধরে জাতভিত্তিক বৈষম্যর কথা শোনাটা দশক দশক ধরে অস্বীকারের পর বিলম্বিত স্বীকৃতি বলেই শোনালো। ক্ষমতায় থেকে বিজেপির হাতে এখন সংরক্ষণকে কাটছাঁট করা ও অগ্রাহ্য করার অনেক উপায় রয়েছে — সংরক্ষণকে সরাসরি বাতিল করার পরিবর্তে সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে অবিবেচকের মতো ব্যবহার করা।
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য কোটার নামে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণের প্রবর্তন, যোগ্য প্রার্থী খুঁজে না পাওয়ার ভুয়ো ও তুচ্ছ অজুহাতের অবাধ প্রয়োগে এসসি/এসটি/ওবিসি কোটাকে অপূর্ণ রাখা, ‘সরাসরি নিয়োগ’ ব্যবস্থা এবং বেসরকারিকরণকে যথেচ্ছভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে সংরক্ষণকে পুরোপুরি নাকচ করা — এই সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থাটাকেই বানচাল করার বহু উপায় মোদী সরকার ছকেছে।
এ সত্ত্বেও জাতগণনার দাবিটা আরএসএস’কে কিছুটা বিপাকে ফেলেছে বলেই মনে হয়। জাতগণনা হলে তা যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে ন্যায্য প্রতিনিধিত্বের দাবির জন্ম দেবে সেই বিষয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠে সঙ্ঘ বাহিনী জাতগণনার ধারণাটারই মর্যাদাহানি ঘটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ‘পাঞ্চজন্য’র সম্পাদকীয় বলছে, জাতপ্রথা হল হিন্দু ধর্ম, জাতপ্রথা ভারতীয় জাতি এবং সমস্ত জাত এক সৌহার্দ্যপূর্ণ বিন্যাসে ঐক্যবদ্ধ। জাতপ্রথা যদি অমন কেন্দ্রীয় বিষয় এবং সর্বত্র বিরাজমানই হয় তা হলে একেবারে হালফিলের জাতগণনা নিয়ে আরএসএসের এত ভয় কেন? কারণ, জাতপ্রথা এবং তার সাথে লিঙ্গ হল ভারতে সামাজিক অসাম্য ও অসামঞ্জস্যের সবচেয়ে বড় নির্দেশক। সঙ্ঘের প্রচার যেমন ভারতীয় অর্থনীতির সার্বিক আকার দেখিয়ে ভারতের কলঙ্কজনক অর্থনৈতিক অসাম্যকে আড়াল করতে চায়, একইভাবে তারা জাতপ্রথার সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সমন্বয় বিশিষ্ট সামাজিক বিন্যাসের ভিত্তি হওয়ার কল্পকথাকে ছড়িয়ে সামাজিক প্রতিনিধিত্বের চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক ধরনটিকেও ধামাচাপা দিতে চায়।
জাতপ্রথার মতোই ভারতের সাঙাতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কেও সঙ্ঘ-বিজেপি একইরকম রক্ষণাত্মক অবস্থানে রয়েছে। আদানির চোখধাঁধানো উত্থান ও সুবিশাল কর্পোরেট জালিয়াতি এবং আদানি গোষ্ঠীর হাতে অপরিমেয় ধনসম্পত্তি ও সরকারি সম্পদের কেন্দ্রীভবনের মূলে মোদী-আদানি দোস্তির মুখ্য ভূমিকা নিয়ে যে কোনো প্রশ্নকেই ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আদানি-আম্বানিদের নিয়ে কাহিনিগুলো মূলত হল রাষ্ট্রীয় মদতে আগ্রাসী পথে সম্পদের পুঞ্জীভবন এবং বৈভবের অশ্লীল প্রদর্শন; এ সত্ত্বেও সঙ্ঘ তাদের আলোচনায় এগুলোকে মহান জাতীয় কীর্তি রূপে উদযাপন করে এবং এই ঘটনাটাকে আড়াল করতেই সেগুলোকে তুলে ধরে যে, ধনীতমদের পাঁচ শতাংশকে বাদ দিলে ভারতের মাথাপিছু আয় পৃথিবীর দরিদ্রতম কয়েকটি দেশের সমতুল্য হয়েই দেখা দেবে। এটা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে যে, জাতপ্রথা ও সাঙাতি পুঁজিবাদের পথেই অনিবার্যভাবে এসেছে ভারতের সুতীব্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য; কিন্তু সঙ্ঘের ভারত বীক্ষায় এগুলো হলো ভারতের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দুটি স্তম্ভ।
সঙ্ঘের যে বীক্ষায় অসাম্যকে ভারতের সাফল্যের আখ্যায়িকা রূপে উদযাপন করা হয় তা কিন্তু আম্বেদকরের সর্বজনীন সমানাধিকার ভিত্তিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ভারত বীক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত, যে ভারতের ভিত্তি হবে স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্বের নীতি, যে তিন নীতি এক অখণ্ড সমগ্ৰকে গঠন করবে। আম্বেদকর মনে করতেন ‘এক ভোট, অভিন্ন মূল্য’র রাজনৈতিক সমতার প্রতি সবচেয়ে বড় বিপদটা রয়েছে ভারতের গভীরে শিকড় চাড়ানো সামাজিক অসাম্য ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে, এবং ঐক্যবদ্ধ আধুনিক জাতি রূপে ভারতের বিকাশে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল জাতপ্রথা। আর ভারতে যে আরএসএসের উপস্থিতি তারা জাতপ্রথাকে ভারতের স্থিতিশীলতা ও শক্তির বুনিয়াদি উৎস রূপে গণ্য করে।
মোদী মুখে যতই সংবিধানের প্রতি আনুগত্য দেখান না কেন, আরএসএসের বিশ্ববীক্ষা ন্যায়বিচার ও সমতা ভিত্তিক সাংবিধানিক বীক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত, যেগুলি ছাড়া ঐক্যবদ্ধ আধুনিক ভারত হতে পারে না। কলকাতায় এক যুবতী ডাক্তারের বীভৎস ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে সারা পশ্চিমবাংলা যেভাবে ক্রোধে ফেটে পড়ল এবং সারা দেশও সংহতি জানালো, স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে ‘রাতের দখল নাও’এর বহু প্রতিবাদ সমাবেশ এবং ‘আমরা সুবিচার চাই’ গর্জনের মধ্যে দিয়ে অভূতপূর্ব মাত্রায় নারী স্বাধীনতার সমবেত আত্মঘোষণার উদযাপন হল, তা যথেষ্ট অনুপ্রেরণা সঞ্চার করল। আজ স্বাধীনতা দিবস অতীত স্মরণের ক্ষণ নয়, তা সাংবিধানিক অভীষ্ট ও অধিকারের সুরক্ষায় লড়াইয়ের দিন এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য ভারতকে আরএসএসের অভিপ্রায়ের সামগ্রিক পরাজয়কে সুনিশ্চিত করতে হবে।
- লিবারেশন পত্রিকা, সেপ্টেম্বর ২০২৪
চন্দননগরে (হুগলি) অনুষ্ঠিত আয়ারলার ৭ম সর্বভারতীয় সম্মেলন পরবর্তীতে এটি ছিল আয়ারলার নতুন কমিটির প্রথম জাতীয় কাউন্সিল বৈঠক। বৈঠকে শুরুতেই কমরেড নাগভূষণ পট্টনায়েকের মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। আয়ারলা’র প্রয়াত জাতীয় সভাপতি শ্রদ্ধেয় কমরেড ক্ষিতীশ বিসওয়ালের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। সকল শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরদিন ৫ আগস্ট নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড সরোজ দত্তের শহীদ দিবসে তাঁর প্রতি নীরব শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
বিহার থেকে নির্বাচিত দুই এমপি কমরেড সুদামা প্রসাদ ও কমরেড রাজারাম সিং’এর বিজয়ে আয়ারলা জাতীয় কাউন্সিল আনন্দ প্রকাশ করে এবং আশা প্রকাশ করে যে এই বিজয় দেশের দলিত, গরিব, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুবদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
গৌরবময় দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ কে রায়ের প্রতিষ্ঠিত ঝাড়খণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ বাম সংগঠন মার্ক্সিস্ট কোঅর্ডিনেশন কমিটি ‘এমসিসি’র সাথে সিপিআই(এমএল)-এর সংযুক্তির ঘোষণা একটি উৎসাহজনক অগ্রগতি। বিহার-ঝাড়খণ্ডের শ্রমিক-আদিবাসী-বঞ্চিত জনগণের লড়াইয়ে এই সংযুক্তি নতুন মাত্রা যোগ করবে।
জাতীয় কাউন্সিল বৈঠকে অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের কমরেডরা আসতে পারেননি। বিজেপির সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কর্মসূচি সংগঠিত করতে ব্যস্ত থাকায় ত্রিপুরার কমরেডদের উপস্থিতি সম্ভব হয়নি।
আয়ারলা জাতীয় কাউন্সিল বৈঠকে গৃহীত মূল সিদ্ধান্তসমূহ
(১) মোদী সরকারের সাম্প্রতিক বাজেট দলিত-গরীব-শ্রমিক বিরোধী বাজেট। আজকের এই কর্পোরেট জমানায় বিশাল পরিমাণ মজুরি ঘোটালা চলছে। এমএনআরইজিএ সহ কোন ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। দেশের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কোন গুণগত পরিবর্তন আনা হয়নি। নীচুতে রাখা মজুরি হারের অমানবিক বাতাবরণে দেশে চলছে কর্পোরেট মজুরি লুঠ। বুলডোজার রাজ চলছে দরিদ্র-দলিত-আদিবাসী সহ বঞ্চিত মানুষের উপর। মানুষ নিজের দেশেই বাসস্থানের অধিকার থেকে বঞ্চিত। জল-জঙ্গল-জমি থেকে উচ্ছেদ এক সাধারণ পরিঘটনায় পরিণত। ২০২২-এর মধ্যে সকলকে আবাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল মোদী সরকারের, আজ তারাই দলিত-গরিব-সংখ্যালঘু জনগণের ঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাজেট বরাদ্দ ইতিমধ্যে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ আবাস একটি জাতীয় ইস্যু হয়ে আছে। বিহারের অর্ধেক মানুষ প্রয়োজনীয় আবাস থেকে বঞ্চিত। দেশ থেকে ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করতে খাদ্যের অধিকার আইনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে তারা ৫ কেজি শুকনো রেশন দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে! কৃষক সহ ভাগচাষীদের জমি দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে। মহিলা শ্রমশক্তির সংখ্যাগত বৃদ্ধি এবং আর্থিক উপার্জনের লক্ষ্যে তাদের ক্রমবর্ধমান স্বাধীন অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। অন্যদিকে মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানীগুলির জুলুম ও লুটতরাজ আরো বড় পরিধিতে ছড়িয়ে পড়েছে, যা মহিলা আত্মহত্যার ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। নারীদের শ্রমশক্তি ও দক্ষতাকে সরকার দ্বিতীয় মানের সস্তা শ্রম রূপে ব্যবহার করছে। যে সরকার ‘এক দেশ, এক কর ব্যবস্থা’র কথা বলে তারা কিন্তু দেশের বৃদ্ধ, মহিলা ও অক্ষমদের জন্য সম্মানজনক সামাজিক নিরাপত্তা পেনশনের ‘একটিই জাতীয় ব্যবস্থা’ চালু করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। বিহারে যখন মাসিক পেনশন ৪০০ টাকা, সেখানে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার দেয় ৪,০০০ টাকা পেনশন। বিদ্যুৎ, জল, স্বাস্থ্য সামগ্রীর অধিকার, দরিদ্র ঘরের বাচ্ছাদের শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে গোটা ব্যবস্থা দিনের পর দিন নিরুত্তাপ থাকছে।
আমাদের সংগঠন স্থির করেছে ‘৫ গ্যারান্টি ও ১০ দাবি’তে দেশজুড়ে প্রচারাভিযান সংগঠিত করা হবে। স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন, ১৪ আগস্ট এই দাবিসনদ আয়ারলার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি, বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে পাঠানো হবে।
(২) বিহারে সিপিআই(এমএল) দলিত ও দরিদ্রদের এক বিরাট আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। ২১ আগস্ট থেকে ২৩ আগস্ট ব্লকে ব্লকে আবাসের দাবিতে এবং বিহারের অতি দরিদ্র ৯৫ লক্ষ পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে অনুদানের যে ঘোষণা করা হয়েছিল, তার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। আয়ারলা এই কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে পূর্ণ শক্তিতে নিয়োজিত আছে। একারণে জাতীয় কাউন্সিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে ২৩ আগস্ট দেশজুড়ে ব্লক, মণ্ডল, তহশীলগুলিতে জাতীয় দাবিসনদের পাশাপাশি ঐ রাজ্যগুলির নিজ নিজ জ্বলন্ত সমস্যাগুলিতে সমাবেশ/ধর্ণা প্রদর্শন করা হবে।
২৩ সেপ্টেম্বর জেলা সদরগুলিতে এই কর্মসূচি সংগঠিত করতে হবে। গ্রামীণ দরিদ্রদের শ্রেণী ভিত্তিক সামাজিক-রাজনৈতিক দাবিগুলির তুলে ধরা হবে। এগুলিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। এই কর্পোরেট রাজত্বে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবদের স্বাভাবিক অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এই দাবিগুলিতে আগামী নভেম্বরে ‘দিল্লী চলো’র যে প্রস্তাব এসেছে, সেটি বিবেচনা করা হবে।
(৩) সুপ্রিম কোর্ট ৭ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ এসসি/এসটি সংরক্ষণ নিয়ে যে রায়দান করেছে, আমরা সেক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করি। আমাদের দৃঢ়ভাবে এটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে দলিত ও আদিবাসীদের জন্য সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি দুর্বল করা চলবে না। আর্টিকেল ৩৪১’র স্পিরিটকে অক্ষত রাখতে হবে। ক্রিমি লেয়ার ধরণের কোন ধারণা চাপিয়ে দেওয়ার কোন প্রচেষ্টা চলবে না। অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং দলিত-আদিবাসী যাতে সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে তা সুনিশ্চিত করতেই সংরক্ষণ ব্যবস্থা।
এটা ঠিক যে দলিত-আদিবাসীদের মধ্যে বঞ্চিতরা যাতে এই ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে, তার জন্য সাংবিধানিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। একই সাথে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে বিজেপি যাতে দলিত-আদিবাসীদের মধ্যে বিভাজনের নোংরা রাজনীতি খেলতে না পারে।
২১ আগস্টের ভারত বনধ আমাদের কর্মসূচি নয়। কারা এই বনধ ডেকেছে, এটাও পরিষ্কার নয়। আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ডাক দেওয়া এড়িয়ে যাব।
(৪) জাতীয় কাউন্সিল এমএনআরইজিএ ও মহিলা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে বিশেষ জোর দিচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গরিবমুখী প্রকল্প যে কারণে প্রতিটি রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ জমেছে। দেশে সরকার ঘোষিত যে ন্যূনতম মজুরি তার থেকে নারেগা’য় মজুরি অনেক কম, এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার কর্মদিবস (প্রতিদিনের কাজের সময়সীমা) বাড়িয়ে এবং মজুরি প্রদান পদ্ধতি জটিল করে, এই প্রকল্প তুলে দিতে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এটি চাহিদা ভিত্তিক কাজের আইন হলেও একে বদলে দেওয়া হচ্ছে এবং এরজন্য বাজেট বরাদ্দ খুবই কম করা হয়েছে। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে অর্থ দিতে টালবাহানা চলছে। পশ্চিমবঙ্গ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বকেয়া মজুরি প্রদান না করায় শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন। আমাদের সংগঠন স্থির করেছে নারেগা নিয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হবে। প্রথমে ১০০ ব্লকে জোর দেওয়া হবে। রাজ্য ও জেলাগুলিকে এই ব্লকগুলি চিহ্নিত করতে হবে এবং এই দিশায় জোর দিতে হবে। বর্ষায় নারেগা’য় কোনো কাজ সেভাবে হয় না, এসময় জবকার্ড তৈরি করা এবং বাতিল জবকার্ডগুলির পুনরুদ্ধারে জোর দিতে হবে।
সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে নারেগা শ্রমিক ও মহিলা শ্রমিকদের বৈঠক সংগঠিত করতে হবে।
মাইক্রোফিন্যান্সে যুক্ত মহিলাদের মধ্যে এবং জীবিকা মিশনে যুক্ত মহিলাদের মধ্যে সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। ইতিপূর্বে আসাম ও পঞ্জাবে এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি সকল রাজ্যেও এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
গান্ধী জয়ন্তীর আগে, ১ অক্টোবর পঞ্চায়েত ভবনের সামনে নারেগা শ্রমিকদের সমাবেশ সংগঠিত করতে হবে এবং কাজের দাবিতে দরখাস্ত (ফর্ম ৪ক) জমা করতে হবে।
দিল্লী অভিযানের কেন্দ্রীয় বিষয় থাকবে এমজিএনআরইজিএ।
বৈঠকে নারেগা সেলের কনভেনর পি এস অজয় কুমার একটি পেপার উপস্থিত করেন। নারেগা আন্দোলনের ২য় পর্যায়ে একটি বুলেটিন প্রকাশ করা হবে। নভেম্বর/ডিসেম্বরের দিল্লী অভিযান অন্যান্য সংগঠনগুলির সাথে যুক্তভাবে হতে পারে।
(৫) আগামী জাতীয় সম্মেলনের পূর্বে জাতীয় কাউন্সিল সংগঠনের কাজের বিস্তার ৩০০ জেলা, ৩০০০ ব্লক এবং ৫০০০ পঞ্চায়েতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে। এরজন্য জোর দিতে হবে বাকি রাজ্যগুলি এবং নিষ্ক্রিয় থাকা রাজ্যগুলির উপর। আয়ারলা নেতৃত্বের টিম কাজের এই দিশায় সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করবে। উড়িষ্যা, কর্নাটক, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে আয়ারলা কাঠামো স্থাপনে মনোযোগ বাড়ানো হবে। জেলা সম্মেলনগুলি এবং বাকি যে রাজ্যগুলির সম্মেলন হয়নি, সেখানকার সম্মেলন এই বছরের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। রাজ্য সম্মেলনগুলি থেকে সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। পঞ্জাব, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ডে বড় সংখ্যায় সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করতে হবে।
দরিদ্র মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা পঞ্চায়েত ও গ্রাম কমিটিগুলিই আয়ারলা আন্দোলনের ভিত্তি। কাঠামো স্থাপনে এই বিষয়ে জোর রাখতে হবে। ব্লক/অঞ্চল/মণ্ডল/তহশিল কমিটি শক্তিশালী করতে বিশেষ নজর দিতে হবে কারণ এই কমিটিগুলির সাথে আমজনতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে। যুব ও মহিলাদের থেকে ক্যাডার গড়ে তুলতে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে।
(৬) আয়ারলা’র হিন্দি বুলেটিন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
(৭) আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চার সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করা এবং এর সাংগঠনিক বিস্তার নিয়েও কাউন্সিল চর্চা করে।
(৮) কয়েকটি শ্লোগান প্রতিটি গ্রামে জনপ্রিয় করে তুলতে সংগঠন ডাক দিয়েছে,
• দাম বাঁধো, কাজ দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও।
• দাম বাঁধো, কাজ দাও, কাজের সঠিক মজুরি দাও।
• বুলডোজার রাজ খতম কর, আবাস অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাও।
• এমএনআরইজিএতে দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি, ২০০ দিনের কাজ দাও ।
• অবসরপ্রাপ্ত সকল মেহনতি, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের মাসিক ৫০০০ টাকা পেনশন সুনিশ্চিত কর।
- ধীরেন্দ্র ঝা, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, আয়ারলা
গত ৪-৫ আগস্ট ২০২৪ ভুবনেশ্বরে আয়ারলার জাতীয় কাউন্সিল বৈঠকে দেশে সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় পরিস্থিতি ও কেন্দ্রীয় বাজেটের উপর দীর্ঘ আলোচনা হয়। বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫টা গ্যারান্টি ও ১০টা দাবি নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার অভিযান সংগঠিত করে রাষ্ট্রপতির কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবিসনদ পাঠানো হয়েছে। ২৩ আগস্ট ব্লকে ব্লকে বিক্ষোভ-ডেপুটেশনের মাধ্যমে দাবিসনদ রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীদের পাঠানো হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর জেলা শাসক অফিসে বিক্ষোভ-অবস্থান ও ডেপুটেশনের মাধ্যমে দাবিসনদ পাঠাতে হবে। তাছাড়া বিডিও-জেলাশাসক’কে এলাকার অবস্থা অনুযায়ী আশু দাবিতে ডেপুটেশন দিতে হবে। নভেন্বরে দিল্লী অভিযান সংগঠিত করতে হবে। এবং দেশজুড়ে প্রচারের জন্য ৫টা মূল শ্লোগান ঠিক করা হয়।
১) দাম বাঁধ কাজ দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও।
২) দাম বাঁধো কাজ দাও, কাজের সঠিক মজুরি দাও ।
৩) বুলডোজার রাজ খতম কর, বাস-আবাস অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাও।
৪) এমজিএনআরইজিএ’তে বছরে ২০০ দিন কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি দাও।
৫) সমস্ত অবসরপ্রাপ্ত মেহনতি, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের মাসিক ৫০০০ টাকা পেনশন দাও।
৮ আগস্ট আরজিকর হাসপাতালে নারকীয় ধর্ষণ-হত্যার পর পশ্চিমবাংলার জনচেতনায় একমুখী জাগরণ সঞ্চারিত হয়। মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদ প্রতিরোধের বৈচিত্রমূলক রুপ ও বৈশিষ্ট্য অতীতের যেকোনো অবস্থাকে ছাড়িয়ে যায়। তাই আয়ারলা’র জাতীয় কর্মসূচির সাথে সাথে রাজ্যের চলমান আন্দোলনে বিভিন্নভাবে আয়ারলার কর্মীরা সক্রিয় থাকে। বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রুপে কর্মসূচি পালন করা হয়। সমস্ত ক্ষেত্রেই আরজিকর ও শক্তিগড় হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তোলা হয়।
পুর্ব বর্ধমান জেলার ৬টা ব্লকে ডেপুটেশন দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রপতি’কে দাবি-সনদের মেমোরেন্ডাম পাঠানো হয়। কালনা ২নং, সদর ২নং, গলসী ২নং, মন্তেশ্বর, পুর্বস্থলী ১নং ও কাটোয়া ২নং ব্লকে এলাকার দাবীতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন কোন ব্লকেই ১০০ দিনের কাজ দেওয়া হচ্ছেনা। নির্বাচনের সময় মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রাজ্য সরকার ৫০ দিন কাজ দেবে। কিন্তু এখনও একদিনও দেয়নি। আবাস যোজনার নতুন তালিকা প্রকাশ করা হল না। ঘরের অনুদান দিচ্ছেনা। ২০২২ সালের মধ্যে সমস্ত গৃহহীনদের পাকা ঘর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল কিন্তু এখনও বহু গরিব মানুষকে ত্রিপলের তলায় বসবাস করতে হচ্ছে। শৌচাগার নিয়ে বহু প্রচার করলেও একটা গ্রামেই শতাধিক পরিবার থেকে শৌচাগার তৈরি করে দেবে বলে তৃণুমূল নেতারা ৯০০ টাকা করে জমা নিয়ে কয়েক বছর হল শৌচাগার তৈরি করেনি। বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের ক্ষতিপূরণের দাবী তোলা হয়। কালনা ও কাটোয়া মহকুমায় ব্যাপক পাট চাষ। এখন মরশুমে পাটের দাম ৩০০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা কুইন্টালের মধ্যে। সরকারী সহায়ক মুল্য ৫৩৩৫ টাকা। তাই সরকারী দামে পাট ক্রয়ের দাবি তোলা হয়। চরের জমির পাট্টার দাবি করা হয়।
হুগলী জেলার ৩টি ব্লকে কর্মসূচি হয়। ধনেখালী ব্লকে ডেপুটেশন হয়। পান্ডুয়া ও বলাগড় ব্লকের ১টি করে অঞ্চল অফিসে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত হয়।
হাওড়া জেলার বাগনান ব্লকে ডেপুটেশন হয়, নেতৃত্বে ছিলেন নবীন সামন্ত ও সোনাতন মনি। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর ২নং ব্লকে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। নেতৃত্বে ছিলেন আনসারুল হক ও কাজল দত্তগুপ্ত। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় বজবজ ব্লকে ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় হাবড়া ১নং ব্লকের শ্রীকৃষ্ণপুর অঞ্চলে বিক্ষোভ সভা হয়। জলপাইগুড়ি জেলায় সদর ব্লকে অন্যান্য কৃষক সংগঠনের সাথে যুক্তভাবে বিক্ষোভ অবরোধ সংগঠতিত করা হয়।
আয়ারলার ১০টি দাবি হল,
১) পুনর্বাসনের বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া কোনো গরিব পরিবারের ঘরে বুলডোজার চালানো চলবে না। অবিলম্বে প্রত্যেক দরিদ্র পরিবারকে ৫ ডেসিমেল জমি সহ আবাস নিশ্চয়তা দিতে হবে। আবাস যোজনায় অর্থ বরাদ্দ ৫ লক্ষ টাকা করতে হবে।
২) অবিলম্বে এরাজ্যে এমএনআরইজিএ চালু করা ও এই প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ, ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। রাজ্য সরকারকে প্রতিশ্রুত ৫০ দিনের কাজ অবিলম্বে চালু করতে হবে।
৩) প্রত্যেক অবসরপ্রাপ্ত গ্রামীণ মেহনতি সহ বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের মাসিক ৪ হাজার টাকা পেনশন সুনিশ্চিত করতে হবে।
৪) দলিত-আদিবাসী সহ গ্রামীণ দরিদ্রদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল এবং বিনামূল্যে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ সুনিশ্চিত করতে হবে। ন্যূনতম মজুরি যথাযথ বৃদ্ধি ও কার্যকর করতে হবে।
৫) ভূমি সংস্কার পুনরায় শুরু করতে হবে। এরাজ্যে ভাগচাষি এবং লিজচাষীদের সরকারি সহায়তা ও অধিকার সুরক্ষিত করতে সরকারি নথিভুক্ত করতে হবে।
৬) খাদ্য সুরক্ষা আইনকে যথাযথ করতে চাল, গমের সাথে ডাল, তেল, মশলা সহ মাসিক ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য দিতে হবে।
৭) এসসি/এসটি’দের উন্নয়নে এসসি/এসটি সাব-প্ল্যান কার্যকর করা ও এই খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
৮) পিইএসও আইন ও অরণ্য আইন কার্যকর করে আদিবাসী, বনবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে।
৯) অবিলম্বে নতুন করে মাইক্রোফিন্যান্স নিয়ন্ত্রণ আইন এনে ঋণগ্রস্ত দরিদ্রদের সুরক্ষা সহ সব ধরনের ঋণ মকুব করতে হবে।
১০) আরজিকরের চিকিৎসক ছাত্রী ও শক্তিগড়ের আদিবাসী ছাত্রীর নারকীয় খুন-ধর্ষণের অপরাধীদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
হুগলি জেলায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি একদিকে ব্যানার ছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত মেয়েদের নিরাপত্তা ও অধিকার আন্দোলনে সামিল হচ্ছে, আবার নিজস্ব ব্যানারে কর্মসূচি নিয়ে চলেছে। এভাবে দুটো দিক সমন্বয় করে আমরা এগোচ্ছি।
২১ আগস্ট চুঁচুড়া ইমামবাড়া সদর হাসপাতালে সমিতির পক্ষ থেকে সুপারকে ও একই দিনে সিএমওএইচ’কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
দাবি ছিল,
• হাসপাতালে কর্মরত মহিলা ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং রোগীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
• হাসপাতালে দালাল ও অপরাধীচক্র বন্ধ করতে হবে।
• অবিলম্বে মহিলা ইনচার্জের নেতৃত্বে কার্যকরী আইসিসি গঠন করতে হবে।
• মহিলা ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আলাদা বিশ্রাম ঘর ও শৌচালয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
সুপার বলেন, নারী-পুরুষদের আলাদা শৌচাগার নেই। আমাদের চাপে জরুরি ভিত্তিতে স্টিকার লাগিয়ে আলাদা ব্যবস্থা করা হবে কথা দিলেন। সক্রিয় আইসিসি আছে। নিরাপত্তারক্ষী বাড়ানো হবে। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশের জন্য কড়াকড়ি ব্যবস্থার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মহিলাদের নাইট শিফট কাজের প্রশ্নে, ওনার বক্তব্য মেয়েরা রাতে ডিউটি না করলে সব কোলাপ্স করে যাবে। দালাল চক্রের বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, আমরা চাপ দিতে উনি বলেন, কোনো রোগী যদি ঠিকমতো পরিষেবা না পায় তাহলে কমপ্লেন্ট জানাতে হবে। আমরা দাবি রাখি, তাহলে দ্রুত কমপ্লেন্ট জানানোর জন্য সমস্ত ডিপার্টমেন্টে কমপ্লেন্ট বক্সের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত সেগুলি দেখতে হবে। ওনার ফোন নাম্বার দিলেন কোনো সমস্যা হলে জানাতে বলেন। ডেপুটেশন চলাকালীন হাসপাতাল চত্বরে পোস্টার ব্যানার সমেত নীরব বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।
এরপর মিছিল করে সিএমওএইচ অফিস যাওয়া হয়। মিছিলে লিফলেট বিতরণ করা হয় এবং স্লোগান ওঠে — আরজিকরের অভয়া ও প্রিয়াঙ্কার ধর্ষক ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, দ্রুত সিবিআই তদন্ত শেষ করে ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ, ঘরে বাইরে কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা, সমস্ত থানায় মহিলাদের গ্রিভ্যান্স সেল গঠন ইত্যাদি দাবি।
সিএমওএইচ’র কাছে দাবি রাখা হয় — অবিলম্বে বড় হাসপাতালগুলোর সঙ্গে ব্লক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে সমস্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উনি প্রতিনিধিদের বলেন, এই মুহূর্তে বড় হাসপাতালগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কিছু পরিকাঠামগত উন্নতির উদ্যোগ চলছে। দালালচক্র প্রসঙ্গে বলেন, ডাক্তাররাই তো দালাল। বড় হাসপাতালগুলোতে আইসিসি আছে। তবুও কখনো আপনাদের পরামর্শ ও সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে, তাই ওনার ফোন নাম্বার দিলেন এবং আমাদের নম্বর চেয়ে নিলেন।
ডেপুটেশন চলাকালীন দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ সভা চলে, সেখানে সংগঠনের সদস্য ছাড়া একজন আয়াদিদি ও আরেকজন পথচারী মহিলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে বক্তব্য রাখেন।
এরপর আবার মিছিল করে চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে এসে সংক্ষিপ্ত সভা হয়। নারীর অধিকার ও নিরাপত্তার দাবিতে অঞ্জনা ভৌমিক কবিতা পাঠ করেন। আরজিকরের অভয়া ও প্রিয়াঙ্কার স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করার মধ্য দিয়ে কর্মসূচি সমাপ্ত হয়।
সমিতির সদস্য ছাড়াও ব্যান্ডেল ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ কিছু নতুন মহিলা এতে অংশ নিয়েছিলেন। আদিবাসী মহিলা কমরেডরাও সামিল হয়েছিলেন। গোটা কর্মসূচি পরিচালনা করেন জেলা সভানেত্রী শোভা ব্যানার্জি, সম্পাদিকা শিপ্রা চ্যাটার্জি, জেলা নেত্রী রুমা গুপ্তা ও রাজ্য সভানেত্রী চৈতালি।
সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন স্থানীয় পার্টি কমিটির সেক্রেটারি ভিয়েত ব্যানার্জি ও পার্টির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ।
কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যা যদি দেখায় যে হাসপাতাল মহিলা ডাক্তারের জন্য নিরাপদ স্থান নয়, তবে মহারাষ্ট্রের ঠানের বাদলাপুর প্রমাণ করল স্কুলও শিশুদের জন্য সুরক্ষিত স্থান নয়। আক্ষরিক অর্থেই দুই দুধের শিশু ধর্ষিত হল বাদলাপুরের নামিদামি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের পরিচারক অক্ষয় শিন্ডের হাতে।
ঘটনা ১৩ আগস্টের, এক শিশু বাড়িতে গিয়ে যৌনাঙ্গে ব্যাথার কথা জানালে অভিভাবকরা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। এবং চিকিৎসক শিশুকে পরীক্ষা করে জানিয়ে দেন শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণ কি আজকের ভারতে এতটাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে চার বছরের শিশুকেও ধর্ষণযোগ্য মনে করছে মনুষ্যরূপী পিশাচরা?
ঘটনার পর পুলিশ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তারা শিশু ধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। পুলিশ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ ক্রোধে ফেটে পড়লেন। গত ২০ আগস্ট স্থানীয় জনগণ ও ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা স্কুলের সামনে বিক্ষোভে শামিল হলেন। পুলিশ সমবেত জনগণকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে তাদের দিকে ইট-পাথর ধেয়ে এল। হাজার-হাজার জনগণ বাদলাপুর রেল স্টেশন অবরোধ করলেন, ট্রেন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটল, বহু ট্রেন বাতিল হল। আক্রান্ত হল রেলের কার্যালয়ও। পুলিশ লাঠি চালালো, সমস্ত স্থানে পুলিশ মোতায়েন হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রইল না। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ২০ আগস্ট ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হল, পরদিন ২১ আগস্ট বিভিন্ন জেলা ও শহরে সংগঠিত হলো প্রতিবাদ। পুলিশ ৭২ জনকে গ্রেপ্তার করলো, এফআইআর হল আরো ৫০০ জনের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তকে স্কুলের প্রশ্রয় দান ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাজ্যের বিরোধী পক্ষ রাস্তায় নামল এবং ২৪ আগস্ট মহারাষ্ট্র বনধের ডাক দিল। কিন্তু মহারাষ্ট্র হাইকোর্ট নির্দেশ দিল — এই ঘটনায় কেউ বনধ ডাকতে পারবে না। হাইকোর্টের নির্দেশে বিজেপির জোট সরকার কিছুটা স্বস্তি পেল, কেননা শিশু ধর্ষণের নারকীয় অপরাধের বিরুদ্ধে জনগণের যে মেজাজ দেখা গিয়েছিল তাতে বনধ সফল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনাই ছিল। বিরোধী নেতা উদ্ধব ঠাকরে বললেন, “আমরা ২৪ আগস্টের মহারাষ্ট্র বনধ তুলে নিয়েছি, তবে বিরোধী নেতারা মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ জানাবেন। বনধ নিয়ে মহারাষ্ট্র হাইকোর্টের নির্দেশের সঙ্গে আমরা সহমত নই।”
স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগটা ঠিক কি? ঘটনাটা ১৩ আগস্ট ঘটলেও এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ ঘটনাটা সম্পর্কে অবহিত হলেও অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয় তার তিন দিন পর, ১৬ আগস্ট। এই সংবাদও বেরিয়েছে যে স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রথমে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি, নীরব থেকেছিলেন এবং অভিযুক্তর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছিলেন। পুলিশও তদন্তে গড়িমসি করেছে, নিগৃহীতা শিশুদের বাবা-মাকে ১১ ঘন্টা থানায় বসিয়ে রাখার পরই এফআইআর নেওয়া হয়। এই সংবাদও বেরিয়েছে যে, থানার এক মহিলা অফিসার শিশুদের মা-বাবাকে বলেন, স্কুলে গিয়ে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ হলে তবেই এফআইআর নেওয়া হবে। মহারাষ্ট্রের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সভাপতি সুজিবেন শাহ বলেন, “স্কুল পুলিশে অভিযোগ না জানিয়ে বিষয়টা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল। এমনকি দুটি শিশুকে ধর্ষণের মতো অপরাধ স্কুলের ভিতরে হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ নিগৃহীতাদের পরিবারকে কোনো রকম সাহায্য করেনি। আমার তাঁদের কাছে প্রশ্ন, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন পকসো আইনে মামলা হবে না।” আর এটাও বাস্তব যে, জেলা নারী ও কল্যাণ বিভাগ হস্তক্ষেপ করার পরই পুলিশ পকসো আইনে মামলা দায়ের করে।
অপরাধে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ১৯ আগস্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল, শ্রেণী শিক্ষক ও দুই অশিক্ষক কর্মীকে সাসপেন্ড করে। কর্তব্যে গাফিলতি ও এফআইআর নিতে দেরি করার জন্য এক ইন্সপেক্টর-সহ তিন পুলিশ কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তের জন্য এক আইপিএস অফিসারের নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছে। তবে, এই সমস্ত পদক্ষেপই হয়েছে জনগণ রাস্তায় নামার পরই।
জোট সরকারের শাসক দল বিজেপির সঙ্গে স্কুলের পরিচালকদের যোগ থাকার জন্যই কি স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ অপরাধের তদন্তে, অপরাধীকে গ্রেপ্তারে ঐ রকম টালবাহানা করছিল? ঐ ইংরাজি মাধ্যম স্কুল পরিচালনা করে আদর্শ বিদ্যা প্রসারক নামে একটি ট্রাস্ট। ঐ ট্রাস্টের সভাপতি উদয় কোটওয়াল বিজেপি কর্মকর্তা। ট্রাস্টের সম্পাদক তুষার আপ্তের সঙ্গেও বিজেপির যোগ রয়েছে। উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা সাংসদ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী জানিয়েছেন, শিশু ধর্ষণে অভিযুক্ত অক্ষয় শিন্ডে স্কুলের কাজে যোগ দেওয়ার আগে বিজেপির অফিস কর্মকর্তা তুষার আপ্তের খামারবাড়িতে কাজ করত। অতএব, স্কুল পরিচালকদের সঙ্গে শাসক বিজেপির যোগ একেবারেই পরিষ্কার, এবং শিশু ধর্ষণের ঘটনাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিপ্রায়, অপরাধের তদন্তে পুলিশের অনাগ্ৰহের পিছনে কারণকে খুঁজে পাওয়াটা মোটেই দুরূহ নয়।
হাসপাতাল, স্কুল, পথঘাট, রেল স্টেশন থেকে সমস্ত স্থানই আজ যদি নারী-শিশুদের পক্ষে নিরাপত্তাহীন হয়ে দাঁড়ায় তার দায় কি রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায় না? আজ যাঁরা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন, কেন্দ্রে ও বিভিন্ন রাজ্যে যাঁরা ক্ষমতায় রয়েছেন, কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁরা পরিস্থিতিকে নারীর অনুকূল করতে উদ্যোগ নিয়েছেন? সব বড় দলই কি নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্তদের, ধর্ষণে অভিযুক্তদের তোষণ করে না, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করে না?
নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ শ্লোগান দিয়েছিলেন। বাস্তব পরিস্থিতি প্রতিদিনই ঐ শ্লোগানকে বিদ্রুপ করে চলেছে। গত ২৫ আগস্ট মহারাষ্ট্রেরই জলগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধকে ‘অমার্জনীয় পাপ’ বলে বর্ণনা করলেন এবং আরও বললেন, অপরাধীরা যেন কোনওভাবে ছাড় না পায়। কিন্তু তাঁর নিজের দলই কী নারী-বিরোধী হিংসায় যুক্তদের সবচেয়ে বেশি পুরস্কৃত করে না। জাতীয় অপরাধ নথিভুক্তি ব্যুরো, এনসিআরবি’র হিসাব অনুযায়ী মোদী জমানায় ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে ৩১ শতাংশ; ২০১৪ সালে যে সংখ্যাটা ছিল ৩,৩৭,৯২২ সেটা বেড়ে ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৪,৪৫,২৫৬। এটা শুধুই পুলিশের কাছে দায়ের হওয়া অপরাধের সংখ্যা, এর বাইরে প্রতিদিনই নারীদের আরো অসংখ্য নিপীড়ন, হিংসার মুখে পড়তে হয়। নারী-বিরোধী অপরাধে জড়িত থেকছেন, নারীদের বিরুদ্ধে হিংসা সংঘটিত করেছেন, এমন সাংসদ ও বিধায়করা সব বড় দলে থাকলেও বিজেপিতে তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রাইটস জানিয়েছে, বিজেপিতে এই ধরনের সাংসদ ও বিধায়ক রয়েছেন ৫৪ জন। নারী-বিরোধী হিংসায়, যৌন নিগ্ৰহে বিজেপি নেতাদের জড়িত থাকার বহু ঘটনা থাকলেও এখানে আমরা দৃষ্টান্তমূলক দুটি ঘটনারই উল্লেখ করব। জম্মুর কাঠুয়ায় ২০১৮ সালে ধর্ষণ করে হত্যা করা হল যাযাবর সম্প্রদায়ের ৮ বছরের এক বালিকাকে। সেই ধর্ষক, বিশেষ পুলিশ অফিসার দীপক খাজুরিয়ার সমর্থনে, তার মুক্তির দাবিতে বিজেপি আওয়াজ তোলে, মিছিল সংগঠিত করে। আর বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর আখ্যান বহু চর্চিত হলেও এখানে তার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কুস্তি সংস্থার প্রধান হিসাবে তিনি মহিলা কুস্তিগীরদের কাছে দাবি করতেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রার্থী হতে গেলে তাঁর যৌন আকাঙ্খাকে তৃপ্ত করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীররা দীর্ঘ আন্দোলন চালালে মোদী সরকারের নিপীড়নের মুখে তাদের পড়তে হয়। এই ধরনের রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-নেত্রীরা মুখে নারীর সম্মান-মর্যাদা রক্ষার কথা বললেও বাস্তবে তাঁদের ক্রিয়াকলাপ নারীর নিরাপত্তার বিপর্যয় ঘটায়, তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। বাদলাপুরের স্কুলের শিশুদের সুবিচার সুনিশ্চিত করতে হলে জন আন্দোলনের চাপের মধ্যে দিয়েই তাকে সম্পন্ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট কলকাতার আরজিকরের ঘটনায় যেমন স্বতঃপ্রণোদিত ব্যবস্থা নিয়েছিল, বাদলাপুরের শিশুদের যৌন হেনস্থাও তাদের কাছে গুরুত্ব পাবে না কেন?
- জয়দীপ মিত্র
কলকাতা প্রসিদ্ধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আরজিকরের অভ্যন্তরে ৯ আগস্টের মধ্যরাতে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ধর্ষণের ঘটনায় আজ সমগ্র দেশ উত্তাল। প্রতিবাদের মিছিলে সামিল হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। অন্যায়ের বিরূদ্ধে ধর্ষকের শাস্তির বিচার পাওয়ার প্রত্যাশায় জনরোষের আগুণ জ্বলছে দেশের অভ্যন্তরে। বাদ পড়েনি বিশ্বের সভ্য সমাজের প্রগতিশীল মানুষের দৃষ্টিও। কিন্তু এ ঘটনা নতুন নয়, আকস্মিকও নয়। সদ্য দগদগে হাথরাস থেকে মনিপুরের স্মৃতি আজও রক্ত শীতল করে তোলে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি)তথ্য অনুসারে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে মোট ১ লাখ ৮৯ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছরে ৩০ হাজার মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন — প্রতিদিন গড়ে ৪ জন। নিঃসন্দেহে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর এই তথ্য শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিকে যেমন চমকে দেবে, তেমনি সমাজের ভয়াবহতা সাক্ষাতে তুলে ধরবে। তথ্যবিচারে একথা দৃঢ়ভাবে বলা যায় সমাজে ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বিরাট স্বার্থকে চরিতার্থ করার কৌশল।
এখন প্রশ্ন হল, কার বা কাদের স্বার্থ? কিসের স্বার্থ? ধর্ষণ আদতে পিতৃতন্ত্রের আস্ফালন। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় পিতৃতন্ত্র সাধারণ বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদী সমাজ পিতৃতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে টিকিয়ে রাখতে চায় নিজেদের দীর্ঘস্থায়ীত্বের স্বার্থে। পিতৃতন্ত্র মুখ্যত পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যা প্রতিক্ষেত্রেই নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই আধিপত্যবাদের বহিঃপ্রকাশ পরিবারের চৌহদ্দির পাশাপাশি বাহ্যিক জগতের অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও, যেমন, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের বিস্তৃত পরিসরে। পিতৃতন্ত্রই প্রণয়ন করে আইন বা বিধিবিধান। যেগুলির বেশিরভাগ অংশই সুপরিকল্পিতভাবে রচিত ও প্রয়োগ করা হয় নারীদের পীড়নের উদ্দেশ্যে। উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈষম্যই এর মূল কারণ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীকে গ্রহণ করা হয়েছে পণ্য হিসাবে। নারীর নারীত্বকে বাজারে সামিল করে মুনাফা অর্জনের পথ তৈরি করা হচ্ছে। মুনাফা সর্বস্ব পুঁজিবাদী সমাজে নারীকে কুক্ষিগত করে রাখার বিরামহীন প্রচেষ্টা চালানো হয় পিতৃতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার মধ্য দিয়ে। এই সমাজে নারী ভোগের প্রতীক — ভোগ্যপণ্য। পুরুষ মনে করে নারী তার অধীনস্থ শ্রেণী। নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য পুরুষের কাছে নেই। নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রশ্নটি চাপা পড়ে থাকে পিতৃতন্ত্রের কঠোর বিধি-নিষেধের আয়তায়। তাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণ নিয়মিত ঘটনা হিসাবে প্রতিভাত হয়।
অন্যদিকে আরও একটি বিষয় ধর্ষণের ক্ষেত্রে আলোচনার দাবি রাখে, পুঁজিতন্ত্রে পুঁজিপতিরা নিজেদের অনুগামী সরকার গঠনে সর্বদা প্রয়াসী থাকে। পুঁজিপতিদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সহযোগিতার ভিত্তিতে নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতা লাভ করে, তারা পুঁজিপতিদের স্বার্থকে চরিতার্থ করার ব্রতে দীক্ষিত। প্রতি পাঁচবছর অন্তর জনগণের সামনে দক্ষিণপন্থী দলগুলির মধ্যে বিকল্প নির্মাণ করে পুঁজিবাদ জনগণের উপর শোষণ, নিপীড়ন চালিয়ে মুনাফা অর্জনের কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রকৃত বামপন্থীদলগুলি পুঁজিপতিদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা জারি রাখে। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা, দাবি, চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে তা পূরণের অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থায় পদার্পন করে। কিন্তু প্রকৃত জনগণের সরকার না হওয়ায় দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি আপামর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দাবি, চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাকে পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। ধীরে ধীরে জনগণ বুঝতে শুরু করে সরকারের প্রকৃত জনবিরোধী চরিত্র। জনগণ ধীরে ধীরে সরকার বিরোধী হয়ে ওঠে।
এমতাবস্থায় অধিষ্ঠিত সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করে ক্ষমতা ভোগের সময়কালকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। জনগণ ও সরকারের এই টানাপোড়েনের মাঝে সরকারের পক্ষে পুঁজিপতিরা সমর্থন যুগিয়ে নিজেদের কাজ হাসিল করে। জনরোষের তীব্রতাকে উপলব্ধি করে সরকার নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় সমাধানের পথ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়। যেহেতু সরকার জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেলে, তাই জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজে বলপ্রয়োগকারী লুম্পেন গোষ্ঠী তৈরি করে। এই লুম্পেন গোষ্ঠীর মূল কাজই হয়ে দাঁড়ায় সমাজের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসমূলক কাজ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আপামর জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা। সরকারের মদতপুষ্ট এই লুম্পেনগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভোটে ছাপ্পা, অবৈধ জমি দখল, বেআইনি নির্মাণ, মিথ্যা মামলাসহ ধর্ষণের ঘটনা বাস্তবায়িত করে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় পুঁজিতন্ত্রে ধর্ষণ নিঃসন্দেহে একটি দমনের সংস্কৃতি, আধিপত্যের সংস্কৃতি। ধর্ষণের মতো এই নিলজ্জ, অমানবিক, ঘৃণিত অপকর্মকে চিরতরে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে হলে অবশ্যই সমাজটাকে পরিবর্তন করতে হবে। ভেঙে ফেলতে হবে পুঁজিবাদের সুউচ্চ প্রাচীর। এক্ষেত্রে আন্দোলনের নেতৃত্ব তুলে নিতে হবে বামপন্থীদের হাতে। বামপন্থীরাই তাঁদের প্রগতিশীল চেতনা, রাজনৈতিক সচেতনতার উপর ভর করে সমাজ পরিবর্তনের মহাযজ্ঞে সামিল হবেন। তাই সমস্ত বামপন্থীদের কাছে আহ্বান করি, ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলির চিরতরে বিনাশ করে সমাজে ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য ও অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আপামর জনসাধারণকে নিয়ে আন্দোলনের পথে শামিল হওয়ার।
- সেখ আসরাফ আলি
হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলন, সেই সূত্রে সরকারের পতন, নতুন তদারকি সরকারের চরিত্র ও ভবিষ্যৎ কার্যপ্রণালীর মতো কয়েকটি মূল বিষয়ে আমাদের অবস্থান আপনারা আপনাদের পাঠানো চিঠির মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলেন। আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে সেগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি।
১) ছাত্র জনতার এই অভূতপূর্ব গণজাগরণ
গণঅভ্যুত্থান আকস্মিক ঘটনা ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের বহুমাত্রিক পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছাত্র জনতার এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। চরম দমন নিপীড়ন মোকাবিলা করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি নৃশংস ফ্যাসিবাদী শাসনকে বিদায় করতে যে জোরদার লড়াই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে শিক্ষার্থীরা শেষে তাকে মরনপণ লড়াইয়ে পরিণত করেছে; হাসিনা সরকারকে উৎখাত করেছে। ছাত্র জনতা সমগ্র সশস্ত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থার মোকাবিলা করে কার্যত রাষ্ট্রকে অচল করে দিয়েছে।
ছাত্রদের সঙ্গে এই গণঅভ্যুত্থানে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে শহরের শ্রমজীবী মেহনতি সাধারণ মানুষ। যে এক/দেড় হাজার (সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি) মানুষ শহীদ হয়েছেন তার মধ্যে শহরাঞ্চলের সর্বহারা আধা-সর্বহারা মানুষের সংখ্যাই বেশি।
হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিদায়ের দিন ৫ আগস্টকে অনেকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মতো বিজয় হিসাবেও দেখছেন।
এই অভ্যুত্থান সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে নতুন এক গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জমি তৈরি করে দিয়েছে।
এই অভ্যুত্থানের পরিণতিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আপাতত নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে একটি অন্তর্বতী সরকার গঠিত হয়েছে। তারা এখন সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণের সমর্থন পাচ্ছে।
এই সরকারের সামনে গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অর্থনীতির চাকা সচল করা, উপর থেকে নীচ পর্যন্ত গণহত্যার অপরাধীসহ ফ্যাসিবাদের সকল হোতাদের গ্রেফতার ও বিচার করা, রাষ্ট্র ও সরকারের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ব্যাপারে জাতীয় সমঝোতা তৈরি করা এবং সর্বোপরি একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা।
কিন্তু এই সরকারের যদি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ দেখা দেয় (সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা) তাহলে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে সরকারের বিরোধ দেখা দেবে।
২) এই সরকারের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা
ছাত্র জনতার অধিকার ও মুক্তির গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ধারণ করবে, তাকে সম্মান দেখাবে। তারা হাসিনার গণসমর্থনহীন সরকারের আবর্জনা পরিষ্কার করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তাদেরকে অনতিবিলম্বে সকল মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও আমলাতন্ত্রসহ রাষ্ট্রের সকল স্তর থেকে হাসিনা সরকারের দোসরদের অপসারণ, সকল অগণতান্ত্রিক কালো আইন বাতিল, সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একইভাবে গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদদের উপযুক্ত মর্যাদা, নিহত ও আহতদের পরিবারসমূহকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) এই গণজাগরণ প্রসঙ্গে
গণঅভ্যুত্থানে শহর ও শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক সহ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জেলা উপজেলা স্তরে শেষ দিকে কোথাও কোথাও গ্রামের কৃষক মজুরদেরও ভূমিকা নিতে দেখা গেছে।
তাদের প্রত্যাশা এই সরকার শ্রমিক, কৃষক ও গ্রামের গরীবদের বাঁচার আশু দাবিসমূহ পূরণ করবে; বন্ধ কলকারখানা চালু করার উদ্যোগ নেবে।
৪) আদিবাসীসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রত্যাশা
আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের প্রত্যাশা সকল ধরনের বৈষম্যের বিলোপ হবে। তাদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
৫) বর্তমান পরিস্থিতি
এখনও রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতি ফিরে আসেনি, এটা আসতে সময় নেবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে দেশের ভিতরে বাইরে বহু ধরনের তৎপরতা রয়েছে। অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতারও আশংকাও রয়েছে। সরকারের অনেকগুলো জরুরি চ্যালেঞ্জ আছে। ভারত ছাত্র জনতার গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় ও বিজেপির বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানিমূলক তৎপরতায় দেশের মানুষের প্রচন্ড বিক্ষোভ রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থনে এই সরকার কতদিন থাকবে, তাদের নিজেদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে কিনা, থাকলে কি — এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের এখনও পরিষ্কার কোনও উত্তর নেই। এই সরকারের উপর মার্কিনী প্রভাব কতখানি তা নিয়েও আলোচনা আছে।
৬) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা
আমাদের বার্তা হচ্ছে আমরা আমাদের এই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা চাই। আমরা হাসিনা সরকারের হাতে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে ইতিমধ্যে জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়েছি।
ভারতের ব্যাপারে আমাদের বিশেষ বার্তা হচ্ছে ভারত কোনভাবেই আর যেন পতিত স্বৈরতন্ত্রী ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সহযোগী না হয়। ভারত যদি হাসিনা সরকারকে একরোখা সমর্থন না যোগাতো তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতি এড়ানোর সুযোগ থাকতো।
ভারতের সাথে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমরা আমাদের সকল দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানও করতে চাই।
৭) বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে
আমরা মনে করি প্রশ্নটা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা নয়, প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী দলের দখলদারিত্ব, দলবাজি, সন্ত্রাস, মাস্তানি, গুন্ডামী, জিম্মি দশার অবসান ঘটানো। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। আর আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতার সূতিকাগার। এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যা করছে তা এখন পুরোটাই রাজনৈতিক চরিত্রের।
৮) বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রধান রক্ষাকবচ তার জনগণের ঐক্য। বাংলাদেশকে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের বাইরেই তার জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ যাতে কোনো পরাশক্তির লীলাক্ষেত্র না হয় তা আমাদের একটি বিশেষ মনোযোগের বিষয়।
- সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
অন্ধ্রপ্রদেশে মারাত্মক এক শিল্প দুর্ঘটনা কেড়ে নিল ১৭ শ্রমিকের প্রাণ, গুরুতর আহত হলেন আরও অনেকে। দুর্ঘটনাটি ঘটে অন্ধ্রপ্রদেশের আনাকাপালী জেলায় অচ্যুতাপুরাম এসইজেডে অবস্থিত ফার্মা কোম্পানি এসেনটিয়াতে। সাম্প্রতিককালে এটা হল সবচেয়ে মারাত্মক শিল্প দুর্ঘটনা। ওই একই দিনে ওই এসইজেডে অবস্থিত আরেকটি রাসায়নিক কারখানায় অগ্নি সংযোগের ফলে দুর্ঘটনায় দশজন শ্রমিক আহত হন। গতবছর, ৩০ জুন, এই এসইজেডে অন্য আরেকটি ফার্মা কারখানায় বিরাট বড় মাপের এক বিস্ফোরণ হয়, যাতে অনেক শ্রমিক মারা যান, আহত হন অনেকে। অচ্যুতাপুরাম এসইজেড হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশের বৃহত্তম অঞ্চল, যেখানে একশ’র উপর কারখানা রয়েছে। এই শিল্প দুর্ঘটনা স্মরণ করায় ৭ মে ২০২০ সালে আরেকটি মর্মান্তিক শিল্প দুর্ঘটনার কথা। বিশাখাপত্তনমের অদূরে ভেনকাটাপুরম গ্রামে পলিমার ইউনিট কারখানায় স্টাইরিন মনোমের ভেপার লিক করার ফলে ১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
পর পর ঘটে যাওয়া এই সমস্ত শিল্প দুর্ঘটনা অন্ধ্রপ্রদেশে, বিশেষ করে এসইজেডে অবস্থিত কারখানাগুলোর সুরক্ষা ও শ্রমিকদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে বিরাট বড় প্রশ্ন তুলে দিল।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভি অনিথা বলেছেন, কারখানার শ্রমিকরা একটি দ্রাবক এমটিবিই (মিথাইল টারশিয়ারি বুটাইল ইথার) ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসা রোধ করার চেষ্টা করছিলেন, যখন একটা বিদ্যুতের প্যানেলের সংস্পর্শে আসে আর বিস্ফোরণ হয়। ওই মারাত্মক দাহ্য পদার্থ ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশিকায় বলাই হয়েছে, যারা এ নিয়ে কাজ করবেন, তাঁদের ধারণা থাকা উচিত যে এই দাহ্য পদার্থের বাষ্প চোখে ও চামড়ায় প্রচন্ড জ্বালা সৃষ্টি করে। এর ব্যবহারেও রয়েছে একাধিক সুরক্ষা বিধি, যার কোনোটাই সেই ফার্মা কোম্পানিতে অনুসরণ করা হয়নি।
সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছে। ট্রেড ইউনিয়নগুলো দাবি তুলেছে, এসইজেডের সমস্ত ইউনিট ও গোটা অন্ধ্রপ্রদেশ জুড়ে সমস্ত শিল্প সংস্থার এক পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরাপত্তা সংক্রান্ত অডিট করা হোক। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, ২০১৬-তে এক সরকারি আদেশ বলে সরকারি ইন্সপেকশন থেকে এসইজেড ও রপ্তানীভিত্তিক প্রসেসিং জোনের ইউনিটগুলোকে অব্যহতি দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের সহজে ব্যবসা করার শর্তগুলো নিরাপত্তা সংক্রান্ত একের পর এক বিধিনিষেধকে শিথিল করেছে, সরাসরি পরিদর্শনের বদলে নিজেরাই সুরক্ষা সংক্রান্ত শংসাপত্র দিয়ে সংস্থাগুলো সমস্ত দায় থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজিকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠছে।
আর কত প্রাণ গেলে পরে শিল্প সুরক্ষা বিধি কঠোর হবে, তা ভবিষ্যতই বলবে।
খুব সম্প্রতি গিগ শ্রমিকদের মধ্যে এক সমীক্ষা চালিয়ে জানা গেল যে, দেশে তাঁদের মধ্যে ৭৭.৬ শতাংশ সারা বছরে আয় করেন মাত্র ২,৫০,০০০ টাকা! আন্তর্জাতিক ডেলিভারি সংস্থা বোরজো কিছুদিন আগে এক সমীক্ষা চালিয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। ভারতবর্ষের ৪০টি শহরে জোম্যাটো, সুইগি, উবের, অ্যামাজনে কর্মরত ২,০০০ গিগ শ্রমিকের মধ্যে তারা এক সমীক্ষা চালিয়েছে।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ৬১ শতাংশ গিগ শ্রমিক বলেন যে আয়করের কোন স্তরের মধ্যে তাঁরা পড়েন সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না। মাত্র ৩৯ শতাংশ গিগ শ্রমিক জানান, এ’ব্যাপারে তাঁরা ওয়াকিবহাল। মাত্র ৩৩.৫ শতাংশ গিগ শ্রমিক আয়কর রিটার্ণ দাখিল করেছেন, আর ৬৬.৫ শতাংশ কোনোদিনই সে পথে হাঁটেননি।
যারা যারা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই শূন্য রিটার্ণ জমা করেছেন।
সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, অর্থাৎ ৭৭ শতাংশ কোন ধরনের মিউচ্যুয়াল ফান্ডে টাকা বিনিয়োগ করেন না। আর, যে ৩৩ শতাংশ রয়েছেন, তাঁরা মাসিক ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বিনিয়োগ করেন।
মাত্র ২৪ শতাংশ গিগ শ্রমিক দীর্ঘমেয়াদে সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকেছেন। পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডে ওই হাতে গোনা শ্রমিক বিনিয়োগ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ গিগ শ্রমিকদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদের আর্থিক পরিকল্পনা নেই। আর যারা করেন, তাঁরা মাসে পিপিএফ’এ ১,০০০ থেকে ৩,০০০ টাকা বিনিয়োগ করেন।
- বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ আগস্ট ২০২৪
গত ১৫ আগস্ট ২০২৪ প্রয়াত হলেন কৃষ্ণনগরে নকশালবাড়ী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক কমরেড মহিমময় চন্দ। বার্ধক্যজনিত কারণে এইদিন শেষ রাতে শহরের শক্তিনগর হাসপাতালে তিনি চিরবিদায় নিলেন। তিনি ছিলেন ১৯৬৯ সালে গঠিত সিপিআই(এমএল)-এর প্রথম নদীয়া জেলা কমিটির শেষ জীবিত সদস্য। তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন, বিনয়ী ব্যবহার, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিপ্লবী মানসিকতায় ভরপুর থাকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কৃষ্ণনগরের বিপিসি কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং’এর অন্যতন ছাত্রনেতা রূপে তিনি ১৯৬৬’র খাদ্য আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেন। ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর কৃষ্ণনগরে নকশালবাড়ি সহায়ক সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। তিনি তার অন্যতম সদস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে এআইসিসিসিআর’এ যুক্ত হন। ১৯৬৯ সালের পার্টি গঠন হওয়ার পরে তিনি পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন, ক্যারিয়ার ত্যাগ করে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে পার্টির জেলাকমিটি সদস্য হন। এরপর তিনি জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। গোপালপুরঘাট-আরংঘাটা অঞ্চলে কাজ করতেন। ১৯৭১ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। প্রথমে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল তারপর কৃষ্ণনগর জেল, পরবর্তীতে তামিলনাড়ুর কুড্ডালুর জেলে বন্দী থাকেন। ১৯৭৬ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। এরপর তিনি এক কমিউনিস্ট বিপ্লবী গ্রুপে যুক্ত হন। ১৯৮১ সালে সেই সংগঠনের সম্পর্ক ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে কৃষ্ণনগরে মানবাধিকার ও নাগরিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারের কর্মকান্ডে ১৯৯০’র শুরুতে তিনি কৃষ্ণনগর একাডেমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিলেন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সমাজ পাল্টে দেওয়ার স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। অন্তিম পর্বের কয়েকবছর ধরে তাঁকে আমরা কিছুটা কাছ থেকে দেখেছি। কোনো নিরাশা নেই, সর্বদাই আশাবাদে ভরপুর, নতুন নতুন শক্তিকে, নতুন প্রজন্মকে সামনে আনার জন্য পরামর্শ দিতেন। নিজের যতটুকু ছিল আন্দোলন ও সংগঠনের প্রয়োজনে উজাড় করে দিতেন। তিনি ২০২২ সালে আমাদের পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। নিয়মিত দেশব্রতী পড়তেন। অশক্ত শরীরেও কৃষ্ণনগরে বিভিন্ন কর্মসূচীতে উপস্থিত থাকতেন।
=== XXX ===