গত ৩ মে ২০২৪ কুকিদের বসবাসের এলাকা পাহাড়গুলোতে উদযাপিত হলো কালা দিবস, পালিত হলো বন্ধ, সব কুকি বাড়িতে উড়ল কালো পতাকা। সমস্ত গির্জায় অনুষ্ঠিত হলো গণপ্রার্থনা, গণকবরে জানানো হল হিংসায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা, কুকি বাড়িগুলোতে জ্বালানো হলো মোমবাতি। মেইতেইদের বিদ্বেষ-প্রসূত অভিধায় কুকিরা হল ‘মাদক সন্ত্রাসবাদী’, আর তাই ৩ মে উপত্যকায় তারা উদযাপন করল মাদক সন্ত্রাসবাদীদের মণিপুর আক্রমণের বর্ষপূর্তি দিবস। দাবি তুলল, মাদক সন্ত্রাসবাদকে স্বীকৃতি দিয়ে কুকিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, কুকি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির নবীকরণ করা চলবে না। কুকিরা মণিপুরের আদি বাসিন্দা নয়, এই উদ্ভট যুক্তি হাজির করে কুকিদের মণিপুরের জনজাতি তালিকা থেকে অপসারণের উদ্যোগও সক্রিয় হয়েছে। মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে সহিংস সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল ২০২৩’র ৩ মে। তার বর্ষপূর্তি যে ধারায় মণিপুরের দুই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চল উপত্যকা ও পাহাড়ে উদযাপিত হলো তার থেকে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই রইল না যে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পারিক বিভেদ ও বিদ্বেষের গভীরতায় প্রশমন তো একটুও হয়নি, বরং তা গভীরতরই হয়েছে।
দশক দশক ধরে পাহাড়ে কুকিদের মধ্যে অনেক মেইতেই মানুষও থাকতেন, আবার উপত্যকায়, বিশেষভাবে ইম্ফলে মেইতেইদের মধ্যে কুকিদের বাসও অস্বাভাবিক বা নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু ২০২৩ সালের ৩ মে’র পর থেকে উপত্যকায় কোনো কুকির অস্তিত্ব অভাবনীয়, আবার পাহাড়ে কোনো মেইতেই মানুষের দেখা মেলাটা একইরকম অচিন্তনীয়। বসবাস দূরে থাক, এমনকি পরস্পরের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়া এলাকায় অপরের যাওয়াটাও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কুকি এলাকায় চিকিৎসার প্রয়োজন না মিটলে কুকিরা ভিনরাজ্য মিজোরামে যাবেন, কিন্তু রাজ্য রাজধানী ইম্ফলে গিয়ে চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়ার কথা ভাবতে পারবেন না। বিমান ধরতেও রাজ্যের একমাত্র বিমানবন্দর ইম্ফলে যাওয়াও তাদের হবে না। মেইতেইদের কাছেও পাহাড়ে পদার্পণ একইরকম বিপদজনক। উপত্যকার জেলা বিষ্ণুপুর ও পাহাড়ি জেলা চুড়াচাঁদপুর, উপত্যকার পশ্চিম ইম্ফল ও পাহাড়ের কাংপোকপি’র মধ্যে বিভাজনের অদৃশ্য সীমারেখাই আজ বলতে গেলে বিরাজ করছে। সরকারি কর্মী ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও এই বিভাজন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে — কুকি কর্মীকে উপত্যকায় পাওয়া এবং পাহাড়ে মেইতেই কর্মীর সন্ধান আক্ষরিক অর্থেই অকল্পনীয়। রাজ্যে কুকি বিধায়কদের সংখ্যা ৭ বিজেপি বিধায়ক সহ ১০, এদের মধ্যে দুজন আবার রাজ্যের মন্ত্রী। কিন্তু গত এক বছরে এদের সঙ্গে সরকার বা মন্ত্রীসভার কোনো সম্পর্ক থাকেনি। অতএব যদি বলা হয় যে, ২০২৩ সালের ৩ মে মণিপুর বিভাজিত হয়ে দুই মণিপুরের অস্তিত্বকে সামনে এনেছিল তার মধ্যে অতিশয়োক্তি বোধকরি থাকবে না।
এক বছরের পারস্পরিক সংঘর্ষে উভয় পক্ষই প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। দুই সম্প্রদায় মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ২২৫’র বেশি, ২০,০০০ শিশু-কিশোর সহ ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সংখ্যা ৭০,০০০, ত্রাণ শিবিরগুলোতে এখনও থাকতে হচ্ছে ৫০,০০০ মানুষকে। ত্রাণ শিবিরগুলোর অবস্থাও শোচনীয় — খাওয়া ও চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। ধ্বংস হয়েছে প্রচুর বাড়ি ও বাণিজ্যিক ভবন, ভস্মীভূত হয়েছে কয়েকশত চার্চ ও কিছু মন্দির। মাসের পর মাস ইম্ফলের মর্গে পড়ে থাকা কুকি মৃতদেহগুলোকে সড়ক পথে পাহাড়ে আনা যায়নি, আনতে হয়েছে আকাশ পথে। ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হয়ে বহু মানুষের ঠাঁই নিজ রাজ্যে হয়নি, তাদের চলে যেতে হয়েছে মেঘালয়-মিজোরাম-আসামের মতো পার্শ্ববর্তী ভিনরাজ্যে। বীরেন সিং’এর নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার মেইতেইপন্থী, এ নিয়ে প্রশ্নের বিশেষ অবকাশ না থাকায় এটাও স্বাভাবিক যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার অনেক বেশি হতে হয়েছে কুকিদেরই। নিহতের সংখ্যা, নারীদের যৌননিগ্ৰহ, জীবিকা হারানো, সম্পত্তি ধ্বংস — এই সমস্ত বিষয়েই মেইতেইদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে কুকিদেরই।
বীরেন সিং সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাওয়া মণিপুরের জনগণের কাছে দুরূহ ব্যাপার হয়েই দাঁড়িয়েছে। এর অনিবার্য পরিণাম স্বরূপ মেইতেই ও কুকি উভয় এলাকাতেই গড়ে উঠেছে সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী, যাদের ঘোষিত লক্ষ্য জনগণকে নিরাপত্তা প্রদান। এরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পালা করে পাহাড়া দেয়, এবং কখনও কখনও বিপক্ষ বাহিনী এবং এমনকি রাজ্যের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গেও সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য মেইতেইদের সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আরাম্বাই টেঙ্গল’এর বাড়বাড়ন্তের কথা। মণিপুরে হিন্দু সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বিজেপি সাংসদ এল সানওয়াজ গড়ে তোলেন এই বাহিনী; আর বীরেন সিং সরকারও এদের মদত জুগিয়ে চলে যে মদতকে প্রচ্ছন্ন বললে ভুল বলাই হবে। এরা বহুবারই থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করেছে, এবং তা করতে গিয়ে বিশেষ বাধার মুখে তাদের পড়তে হয়নি। সশস্ত্র ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে এদের ঔদ্ধত্য এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে এরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও করণীয় কাজের নির্দেশ দেয়। মণিপুরের পুলিশ বাহিনীও এখন অভিযোগ করে থাকে যে আরাম্বাই টেঙ্গল তাদেরও হুমকি দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর কে রঞ্জন এবং বিজেপি রাজ্য সভাপতি সারদা দেবীর ইম্ফলের সরকারি আবাসনের আবাসও এদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি। জঙ্গি বাহিনীর সক্রিয়তা মাথাচাড়া দিয়েছে, কোথাও পরিস্থিতি এমন হলে সেখানে সেনা নামিয়ে তাদের দমন এবং এমনকি পাইকারি হারে হত্যাই মোদী সরকারের দস্তুর বলেই ভারতবাসী জানে। কিন্তু আরাম্বাই টেঙ্গল’এর বিরুদ্ধে মোদী সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অত্যন্ত প্রকট। প্রতিপক্ষ বিশেষভাবে সংখ্যালঘুদের দমনে আরএসএস যে নানা বাহিনী তৈরি ও মজুত করেছে বলে জানা যায়, আরাম্বাই টেঙ্গলও তাদের সমগোত্রীয় রূপেই দেখা দিচ্ছে।
মণিপুরের পরিস্থিতি থেকে যে প্রশ্নগুলো স্বাভাবিকভাবেই মাথাচাড়া দিচ্ছে তা হল — মণিপুরের জন্য কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক বৈরিতা কি এতটাই অতিমাত্রিক যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কোনো সুযোগ আর নেই? সমস্যার সমাধান সম্ভব হলে কোন পথে তা বাঞ্ছনীয়? সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে কুকিরা স্বতন্ত্র প্রশাসনিক এলাকার দাবি জানিয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন, মণিপুরে ২০১৭ ও ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কুকিদের বিজেপিকে সমর্থনের পিছনে এই প্রত্যাশা ছিল যে, নির্বাচিত বিজেপি সরকার তাদের এই আকাঙ্খা পূরণ করবে। কিন্তু বীরেন সিং’এর বিজেপি সরকার কুকিদের ঐ দাবির বিরোধিতাতেই শুধু দাঁড়ায়নি, তাদের দমনে ও পদে-পদে প্রতিকূলতা সৃষ্টিতেও তৎপর হয়েছে। মণিপুরে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে অমিত শাহও মেইতেইদের দাবির প্রতিধ্বনি করে বলেছেন — মণিপুরকে অখণ্ড রাখতে হবে। নরেন্দ্র মোদীর দশ বছরের শাসনে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিযান জনজাতিদের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলতে উদ্যত হয়েছে, সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রান্তিক অবস্থানই তাদের অবধারিত নিয়তি হয়েছে ও হচ্ছে। মণিপুর হাইকোর্টের যে রায় মেইতেইদের জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ কেন্দ্রের কাছে করতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল, এবং যে রায়কে কেন্দ্র করেই এক বছর আগে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটেছিল, সেই রায়ের অভিমুখও এই নিয়তির অনুসারী বলেই কুকিদের চেতনায় ধরা দিয়েছিল। প্রান্তিকতায় পর্যবসিত জনগণ ও সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রতিষ্ঠা, পোশাক-ভাষা-খাদ্যাভাস ইত্যাদির ভিন্নতা সহ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সুরক্ষা, পছন্দের ধর্ম অনুসরণকে অবাধ করা — এর আন্তরিক বাস্তবায়নই হতে পারে মণিপুর সহ ভারতের সামাজিক ঐক্যের, সম্প্রদায়গত বিভেদ দূরিকরণের নির্ধারক শর্ত।