দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার: আস্থা রাখুন মানুষের উপর, গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দায়বদ্ধ অনুরাগের প্রতি ভরসা রাখুন
esponsible-passion-for-democracy

[ সম্প্রতি মেনস্ট্রিম পত্রিকার সাংবাদিক পাপড়ি শ্রী রামন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের একটি সাক্ষাৎকার নেন। এর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর কাটাছেঁড়া। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই আলোচনা আমরা ‘আজকের দেশব্রতী’র পাঠকদের সামনে তুলে ধরলাম। শিরোনাম আমাদের। - সম্পাদকমণ্ডলী ]

প্রশ্নঃ দ্রুত পরিবর্তনশীল একটি দেশ, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলি এখন ‘বুনিয়াদি শ্রেণি সংগ্রামের’ লড়াই হয়তো লড়ছে না, সেখানে আপনার রাজনৈতিক পরিক্রমা নিয়ে যদি কিছু বলেন?

উত্তরঃ আমার মনে হয়, ভারতবর্ষে ‘শ্রেণি সংগ্রামের’ ধারণাটি নিয়ে বেশ ভুল বোঝাবুঝি আছে। আধিপত্যকারী শ্রেণি ক্ষমতা রাষ্ট্রকে, অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ভাবনার জগতেও আধিপত্য করে। এই আধিপত্যকারী শ্রেণি ক্ষমতার বিরুদ্ধে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণিগুলির সংগ্রামই হল শ্রেণি সংগ্রাম। ভারতে আধিপত্যকারী শ্রেণি ক্ষমতার মূল দুটি স্তম্ভ হল জাত ব্যবস্থা এবং পিতৃতন্ত্র। এই ‘ক্ষমতা’ যদি সামাজিক জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে, তখন তার বিরুদ্ধে লড়াইটাকেও আধিপত্যের প্রতিটি অভিমুখের বিরুদ্ধে চালিয়ে যেতে হবে।

আমরা রাজনীতিকে সাধারণ ভাবে তিন বা চারটি বড় ভাগে ভাগ করতে পারি। আধিপত্যকারী রাজনীতি হল ‘খবরদারির রাজনীতি’ (পলিটিক্স অব ম্যানেজমেন্ট), যা বর্তমান ব্যবস্থাটাকে টিঁকিয়ে রাখছে। এক স্বৈর প্রশাসনিক বিধির আওতায়, এই ব্যবস্থাপনা সর্বাত্মক দমনের মাধ্যমে, গণতন্ত্রের ক্ষয় ও ধ্বংসসাধনের মাধ্যমে, জায়গা করে নেয়। ঠিক এটাই আজ আমরা দেখছি মোদীর ভারতে।

এই খবরদারি বা ব্যবস্থাপনার রাজনীতির বিরুদ্ধে, আমরা তুলে ধরছি, যাকে বলতে পারেন, রূপান্তরণের, পরিবর্তনের রাজনীতি। এছাড়াও আছে প্রতিনিধিত্বের লোকপ্রিয় রাজনীতি। ভারতের মত একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে, এবং আমাদের মত একটি সমাজে, যেখানে রয়েছে গভীরে প্রোথিত একটি জাত ব্যবস্থা যার ফলশ্রুতিতে রয়েছে সামাজিক বহিষ্কার, প্রান্তিকীকরণ এবং উৎপীড়ন — সেখানে প্রতিনিধিত্বের রাজনীতিও আয়ত্ত করে নেয় রূপান্তরগত একটি অভিমুখ (ট্রান্সফরমেশনাল আসপেক্ট)।

এই গতিশীল এবং জীবন্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই শ্রেণিসংগ্রামকে আয়ত্ত করতে হবে এবং তা চালিয়ে যেতে হবে। মার্কসবাদ কখনোই শ্রেণিসংগ্রামকে শুধু অর্থনৈতিক লড়াই হিসেবে দেখেনি। রাজনীতি শেষ বিচারে অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ। কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামের প্রশ্নে, মার্কসবাদ রাজনীতিকেই অগ্রাধিকারে রাখে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের এইসব বহবিচিত্র উপাদান ও মাত্রাকে শ্রেণিসংগ্রামের এক অখণ্ড পরিকাঠামোয় সংযুক্ত করে।

প্রশ্নঃ বিগত এই পঞ্চাশ বছরে পার্টি কীভাবে এগিয়েছে? একটা উন্নয়নশীল দেশে পঞ্চাশ বছর অনেকটা সময়, আপনাদের মত একটি ছোটবাম দলকে প্রধান কী কী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং হচ্ছে, যখন আপনাদের পথ চলার শুরুতে কংগ্রেসী রাজনীতির (কংগ্রেসিজম) বিরোধিতা ছিল অন্যতম অ্যাজেন্ডা?

উত্তরঃ আমরা প্রথম দুটি দশক নির্বাচন থেকে দূরে ছিলাম। ১৯৮০’র দশকের শেষার্ধে আমরা উপলব্ধি করি, প্রাপ্ত বয়স্ক সার্বজনীন ভোটাধিকারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা সত্ত্বেও ভূমিহীন দরিদ্র এবং সামাজিক ভাবে নিপীড়িত মানুষজন কার্যত ভোটাধিকারে বঞ্চিতই থেকে গেছেন। ঐ অধিকার অর্জন করা ও ব্যবহার করা, ‘বয়কট’ করার থেকে বেশি যুক্তিযুক্ত। যেটা আপনার আদৌ নেই, সেটা সত্যিই আপনি ‘বয়কট’ করতে পারেন না। এতে অবশ্য ভয়ঙ্কর সামন্তী প্রতিক্রিয়া হল। ভীষণ নৃশংস হয়ে উঠল ভূস্বামীরা। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিহার ও ঝাড়খণ্ডে আমাদের যে সব সামন্তী হিংসা ও রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তার বেশিরভাগের কেন্দ্রেই রয়েছে এই ‘ভোটের অধিকার’।

মিথ্যে মামলাই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা যার ভুক্তভোগী আমাদের কমরেডরা প্রায় সর্বত্র, জনে জনে। কয়েকটা উদাহরণ দিই আপনাকে। ২০০০ বিহার বিধানসভা নির্বাচনে কমরেড শাহ চাঁদ, আরওয়ালে ভাদাসি পঞ্চায়েতের এক জনপ্রিয় মুখিয়া, আরওয়াল বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাত্র প্রায় ২০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত হলেন। ঠিক তারপরেই আরও ১৩ জন কমরেডের সঙ্গে তাঁকে টাডা মামলায় গ্রেফতার করে দোষী সাব্যস্ত করা হল ২০০৩-এ। জেল হেফাজতেই কমরেড শাহ চাঁদ সহ ৬ জন কমরেডের মৃত্যু হয়েছে।

২০১৫ সালে, বিহারে কমরেড সত্যদেও এবং অমরজিৎ কুশওয়াকে জেলে বসেই দারাউলি (এসসি আসন) এবং সিওয়ান জেলার জীরাদেই আসন থেকে নির্বাচন লড়তে হয়েছিল। কমরেড সত্যদেও জিতলেন এবং দু’বছর পর জামিন পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এলেন। কমরেড অমরজিৎ খুব সামান্য ব্যবধানে হারলেন, আর তার কারাযন্ত্রণা অব্যাহতই রইলো। ২০২০’র বিহার বিধানসভা নির্বাচনে দু’জনেই আবার লড়লেন, কমরেড অমরজিৎ অবশ্য সেই জেল থেকেই। এবার দুই কমরেডই জিতলেন। এখন, দশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সব কমরেড মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু কমরেড অমরজিতের ততদিনে সাত বছর জেল খাটা হয়ে গেছে।

আরেকটি দৃষ্টান্ত — মনোজ মঞ্জিল ২০১৫-তে ভোজপুরের আগিয়াওঁ (এসসি) আসনে জেল থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সামান্য ব্যবধানে তৃতীয় হন। ২০২০-তে ঐ একই আসন থেকে আবার লড়ে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তিনি জেতেন। কিন্তু সেই একই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় কমরেড মনোজ এবং অন্য ২২ জন কমরেডকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল। ফলে মনোজকে আবার নতুন করে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁর বিধানসভার সদস্যপদ খারিজ করা হয়। আমাদের আগাগোড়াই চরম প্রতিকূল সংঘাত বিদ্বেষের পরিবেশে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। বর্তমানে ফ্যাসিস্ত আগ্রাসনের এই পর্যায়ে সেটা আরও অনেকটাই বেড়ে গেছে।

প্রশ্নঃ গৈরিক অ্যাজেন্ডাকে যে দ্রুততায় আমরা সামনে হাজির হতে দেখেছি — সব বাম দলগুলি কি এটা মেনে নিতে প্রস্তুত যে বাম দলগুলির থেকে বৃহত্তর একটি পার্টির প্রয়োজন আছে, যা সমস্ত বিজেপি বিরোধী জোটের প্রধান মুখ হয়ে উঠবে?

উত্তরঃ গৈরিক অ্যাজেন্ডা প্রায় চার দশক ধরে ক্রমশ প্রকট করেছে নিজেকে। ১৯৯০’র দশকের গোড়ায় ভারতের অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্র নীতির অবস্থানগত পরিবর্তন এই উত্থানকে শুধু আরও সাহায্যই করেছে। আজ সঙ্ঘ বাহিনী শুধু যে হিন্দুত্বের এক আগ্রাসী ধ্বজাধারী হিসেবে সামনে এসেছে তাই’ই নয়, কর্পোরেট শক্তি এবং মার্কিন ও ইজরায়েলমুখী বৈদেশিক নীতির বিশ্বস্ত একনিষ্ঠতম সমর্থকও হয়ে উঠেছে। ২০১৪ থেকে এটি হঠাৎ পাওয়া দৈবধনের মত অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক লাভের ফসল নিজের গোলায় তুলছে। কারণ এই সময়ে অ-বিজেপি প্রায় সব ধারা এবং দলগুলি নানা কারণে নিজেদের শক্তি হারিয়ে দুর্বলতম অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল যা বিজেপির সামনে তৈরি করে দিয়েছিল অত্যন্ত অনুকূল, একচ্ছত্র আধিপত্যের এক মৃগয়াভূমি।

চরম দক্ষিণপন্থী আক্রমণকে প্রতিহত করতে আমাদের নিশ্চয়ই চাই ব্যাপক-ভিত্তিক ঐক্য। কৃষক আন্দোলন (২০২১-২০২২) আমাদের সামনে সেই ঐক্যের আদর্শ তুলে ধরেছে। ইন্ডিয়া জোটও পরিস্থিতির চাহিদার প্রতি এক ইতিবাচক সাড়া। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বা স্বাধীনতা-উত্তর দশকগুলিতে স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে ওঠা কোন একটি দল বা একটি মতাদর্শ স্বাধীনভাবে একক উদ্যোগে এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে পরাস্ত করার অবস্থানে নেই। আমাদের চাই একটি কার্যকরী এবং গতিশীল যুক্তফ্রন্ট। সমস্ত প্রধান মতাদর্শগত ধারা ও রাজনৈতিক প্রবণতাকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার উপযুক্ত পথ খুঁজে বার করতে হবে ও চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে হবে। আমরা গণতন্ত্রের সকল অংশভাগী, অংশীদারকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি গতিশীল এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ জনতার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রশ্নঃ ১৯৮৯-তে পার্টি তার প্রথম লোকসভা আসনটি অর্জন করে। দল তখন সদ্য তরুণ, সেই তুলনায় এই সাফল্য তাড়াতাড়িই এসেছিল। ১৯৯১-এ এল পার্টির দ্বিতীয় লোকসভা আসন। এখন বিজেপি অসমকে পুরোপুরি দখলে নিয়েছে। ১৯৯৯ সালেও পার্টি অসমের আসন জিতেছিল। ২০০৪এ ধাক্কা এল। ২০০০ থেকে এখন পর্যন্ত মাঝের এই সময়টাতে কী ঘটেছিল? ২০২০ থেকে বিধানসভা নির্বাচনের সাম্প্রতিক সাফল্য কি আপনাকে আশান্বিত করেছে?

উত্তরঃ ১৯৮৯-এ আরা থেকে জয়ের ব্যাপারটা সত্যিই ছিল বিশেষ এবং ঐতিহাসিক। আমরা বহু-কৌণিক এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিলাম আর আমাদের বিপুল সংখ্যক ভোটার সেবার জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভোটের দিন সন্ধ্যায় এক নৃশংস গণহত্যা ঘটেছিল, জনতাকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করার জন্য দিতে হল এক বিরাট মূল্য!

অসমের পার্বত্য জেলাগুলি থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯-তে পর পর চারটি নির্বাচনে জয় এসেছিল। সংবিধানের ২৪৪ক ধারায় প্রতিশ্রুত, একটি স্বশাসিত রাজ্যের দাবিতে এক জনপ্রিয় আন্দোলন এই জয় এনে দিয়েছিল।

উত্তর পূর্বাঞ্চলে এই আন্দোলন ছিল এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগানো ঘটনা। আঞ্চলিক ঐক্যের ভিত্তিতে এক শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সামাজিক সত্তার মানুষ। কিন্তু বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) সরকারের আমলে ভারতীয় রাষ্ট্র এই ঐক্য ভাঙার উদ্দেশ্যে সেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহের বীজ বুনে দিতে সক্ষম হয়েছিল যা আন্দোলনে ভাঙন ধরায়; ক্রমশ নিজস্ব শক্তি হারিয়ে ফেলে এই আন্দোলন।

প্রশ্নঃ বর্ধমান আসন নিয়ে আপনার বিবৃতি। যেখান থেকে সবকিছু শুরু হয়েছিল — কেউ ভাবতে পারে, পার্টি আর আসনটি নিয়ে তত জোরালোভাবে ভাবছে না। আপনার মতে সাতটি আসনের মধ্যে কোনটির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবচেয়ে কঠিন? এবং কেন?

উত্তরঃ পশ্চিমবঙ্গে ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের মধ্যে ভোটের আগে কোন আসন ভাগাভাগি হয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, একজন প্রার্থী দেওয়ার এবং গোটা রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর, নির্দিষ্টভাবে কোন দলের প্রতি সমর্থন ব্যতিরেকেই।

এই নির্বাচনগুলিতে আমরা সবচেয়ে কম সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি — ইন্ডিয়া জোটের অংশ হিসেবে বিহার ও ঝাড়খণ্ডে চারটি এবং পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে (স্বাধীনভাবে) একটি করে আসনে। বিহারে (আরা, কারাকাট এবং নালন্দা) এবং ঝাড়খণ্ডে (কোডারমা) আসনগুলির সবকটিই বর্তমানে এনডিএ’র দখলে, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বেশিরভাগ অন্য আসনগুলির মত। কিন্তু স্রোত ঘুরছে, আমরা যদি স্বৈরাচারী এবং বিপর্যয়কর মোদী-শাহ রাজত্বের অবসান ঘটাতে নির্বাচনকে একটি দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ জনতার আন্দোলনে পরিণত করতে পারি, তাহলে ২০১৯’র ফলকে উল্টে দেওয়া নিশ্চিত ভাবে সম্ভব হবে। ঝাড়খণ্ডে ২০১৯’র বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২০’র বিহার বিধানসভা নির্বাচন ইতিমধ্যেই সেই অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে। এই শক্তি ও সম্ভাবনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হচ্ছে এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ!

প্রশ্নঃ বেশ কয়েকটি রাজ্যে আপনার বিপুল সংখ্যক অনুগামীরা আছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, মার্কসবাদী পাঠচক্রে আছেন অনুরাগী তরুণ তরুণীরা। আপনার নিজের (রাজনৈতিক) বিকাশ ঘটেছিল পার্টি স্তরে নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে। ভারতে নির্বাচনী রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী, যখন বিজেপি বলছে, ৪০০+ আসনে জয়লাভ করবে?

উত্তরঃ একটি বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র এবং পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনের মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য একটি ট্র্যাক রেকর্ড — ভারতের ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আম্বেদকর সেইসব বিরোধ বা অসঙ্গতিগুলো খুব স্পষ্ট ভাবেই নির্দেশ করেছেন যা বারে বারেই ভারতীয় সংবিধানকে বিপন্ন করতে পারে — যেমন, নাগরিক পিছু একটি করে ভোটের সমতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিপুল বৈষম্য — এর মধ্যেকার বিরোধ বা অসঙ্গতি। একটা পর্যায়ের পরে এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক পাহাড় প্রমাণ বৈষম্য নির্বাচনী সমতাকে অর্থহীন করে তুলবে।

ভারতে, এমনকি নির্বাচনী ব্যবস্থাও তার যথাযথ কার্যকারিতা হারাতে শুরু করেছে। শাসক-অনুগত, নিরপেক্ষতাহীন নির্বাচন কমিশন, অস্বচ্ছ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবাধ কর্পোরেট ফান্ডিং, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের অস্বচ্ছ ব্যবস্থা এবং সরকারের ঢাক পেটানো মিডিয়া — এই সবকিছু মিলে ভারতীয় নির্বাচনগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা বিপুল পরিমাণে ক্ষয় করে ফেলেছে।

এই নির্বাচনগুলিই হয়তো গণতান্ত্রিক ভারতের নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার অধোগতিকে রোখার শেষ সুযোগ, ভারতীয় জনতার কাছে!

প্রশ্নঃ গত দুটি লোকসভায় কোন বিরোধী দলনেতা ছিলেন না। আচ্ছা, একটি উদারপন্থী (লেফ্ট অব সেন্টার) অথবা সমাজবাদী জোট কি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পরিমিত ভারসাম্য (মোডিকাম অব ব্যালান্স) আনতে পারে?

উত্তরঃ মানুষের ওপর আস্থা রাখুন! গণতন্ত্রের প্রতি সেই জনতার নিষ্ঠা, অনুরাগের ওপর বিশ্বাস রাখুন! ভারত স্বাধীনতার জন্য এক দীর্ঘলড়াই লড়েছে এবং সংবিধান ও গণতন্ত্র অর্জন করেছে যা স্বাধীন ভারতের অচ্ছেদ্য দুটি বৈশিষ্ট্য। আমরা সেগুলিকে স্বতঃসিদ্ধের মত স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম যতক্ষণ না জরুরি অবস্থা আমাদের প্রথম রূঢ় আঘাতটা হেনেছিল।

জরুরি অবস্থা-উত্তর কালে, গণতন্ত্র আবার নবজীবন পেল। পঞ্চায়েতী রাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও হস্তান্তর হল। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ’পর্যন্ত সমাজের যে অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব ছিল না, তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ল। আর এসব কিছুর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছিল। ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতীয় জনমতকে ব্যাপকভাবে আশ্বস্ত করেছিল।

২০১৪ থেকে, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের উপর সবচেয়ে ভয়ংকর এবং লাগাতার আক্রমণ হয়ে চলেছে। আর এই হুমকির মুখে আরও বেশি বেশি মানুষ জেগে উঠছেন। জনতার এই উপলব্ধি আর সংকল্প যখন দানা বাঁধবে, তখন তা যে শুধু হারিয়ে যাওয়া ভারসাম্যকে পুনরুদ্ধার করবে তাই নয়, ভারতকে আরও সবল এক গণতন্ত্র এবং সাম্যবাদী এক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

খণ্ড-31
সংখ্যা-17