রামদাস প্রিণি শিভনন্দন মেধাবী ছাত্র। টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস (টিস) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সে এখন গবেষণা করছে। ইউজিসি নেট পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় মন্ত্রক তাকে দলিত ছাত্রদের দেয় বৃত্তিও প্রদান করেছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের চোখে সে অপরাধ প্রবণও ছিল — প্রগ্রেসিভ স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় সে ছিল বাম মানসিকতা সম্পন্ন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্র অধিকারকে সে দ্ব্যর্থহীনভাবেই তুলে ধরত, ন্যায়ের ইস্যুগুলোর প্রতিও তার থাকত অবিচল মদত। টিস কর্তৃপক্ষ গত ১৮ এপ্রিল তার কাছে নোটিশ পাঠিয়ে বলল তার কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে সে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে — কারণ, সে ভগৎ সিং স্মৃতি বক্তৃতার আয়োজনে এমন বক্তাদের এনেছিল যাদের উপস্থিতি এই প্রতিষ্ঠানে অভিপ্রেত ছিল না। সে ডাইরেক্টরের বাংলোর বাইরে রাতে জোরে জোরে শ্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। এছাড়া প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন ২৬ জানুয়ারি সে আনন্দ পট্টবর্ধনের তৈরি তথ্যচিত্র ‘রাম কে নাম’এর প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করেছিল। কর্তৃপক্ষের চোখে এই তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী অযোধ্যায় রামলালার মূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি অসম্মান ও প্রতিবাদ। পাঠানো নোটিশে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হলো যে, “তোমার কার্যকলাপ জাতির স্বার্থের অনুকূল নয়। রাষ্ট্রের অধীনস্থ এক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় টিস তার ছাত্রছাত্রীদের এমন সমস্ত কাজে অনুমোদন দিতে বা সেগুলোকে বরদাস্ত করতে পারেনা যেগুলো দেশদ্রোহী এবং দেশের সম্মানের হানি ঘটায়। এই সমস্ত কার্যকলাপ তাই ফৌজদারি অপরাধের মধ্যেই পড়ে।”
গেরুয়া মতাদর্শের প্রতি এই অনুরাগ কি টিস’এর ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? শিক্ষা, গবেষণা ও সামাজিক সমীক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসাবে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের যথেষ্ট খ্যাতিই ছিল। বিভিন্ন ধারার স্বরের প্রকাশে সেখানে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু যে গেরুয়া সরকার সমস্ত প্রতিষ্ঠানকেই নিজেদের মতাদর্শের ধারায় পরিচালিত করতে উন্মুখ, সেই মোদী সরকার সেই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শাসক বিরোধী গণতান্ত্রিক স্বর ওঠাকে স্তব্ধ করতে পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে এগিয়ে গেল যেগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ভালো পরিমাণ আর্থিক সাহায্য পায়। গতবছরের মাঝামাঝি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত আইন সংশোধন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি আর্থিক সহায়তা পাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে মোদী সরকার এই নিয়ম নিয়ে এল যে, সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রধান নির্ধারণ করবে কেন্দ্রীয় সরকারই। টিস কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি আর্থিক সহায়তা পাওয়ায় তার প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে গেরুয়া ধ্যানধারণার অনুগামী ব্যক্তির মনোনীত হওয়ার পথে কোনো বাধা রইল না এবং যে কোনো ন্যায়কামী ও বিরোধী স্বরকেই অপরাধ বলে দেগে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ হতে থাকল। রামদাসের কার্যকলাপ প্রতিষ্ঠানের অনুসরণীয় বিধি ভঙ্গ করেছিল কিনা তার বিবেচনায় তৈরি করা কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, সে অন্যায্য কার্যকলাপ সংগঠিত করে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানি ঘটিয়েছিল এবং কমিটি সুপারিশ করে যে, রামদাসকে সাসপেন্ড করতে হবে এবং মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, গুয়াহাটি ও তুলজাপুরে টিস’এর যে ক্যাম্পাস আছে সেখানে তাকে দু’বছর ঢুকতে দেওয়া হবে না।
রামদাসকে সাসপেন্ড করা ও টিস’এর যে কোনো শাখার দরজা তার কাছে দু’বছরের জন্য বন্ধ করার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ছাত্র ইউনিয়নই প্রতিবাদ জানিয়েছে। ছাত্র সংগঠন এআইএসএ বলেছে, রামদাসের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা দেখাচ্ছে যে, বিজেপি সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামোকে আরএসএস’এর শাখায় পরিণত করতে কোমর বেঁধেলেগেছে। রামদাসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এআইএসএ তাদের বিবৃতিতে বলেছে, “টিস আমাদের আন্দোলনের সহকর্মী রামদাসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের আশ্রয় নিয়ে যে কর্তৃত্ববাদের পরিচয় দিয়েছে আমরা তার নিন্দা করছি। আমরা রামদাসকে পাঠানো নোটিশ অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। সমস্ত ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, আরএসএস এবং বিজেপির মতো ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করার জন্য সাধ্যমত বৃহত্তম আকারের ঐক্য গড়ে তুলুন।”