একনায়ক দুর্বল হয়েছে, এবারে ওকে ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলুন
the-dictator-is-down

লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় যে প্রবণতাগুলি প্রকাশ হতে শুরু করেছিল দ্বিতীয় দফায় সেগুলি আরো জোরালো ও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে — বিজেপির ভোটারদের মধ্যে ক্লান্তি ও মোহভঙ্গ এবং সঙ্ঘ-বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশা। সারা দেশে প্রায় দুই শত আসনে ভোটদান পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। তামিলনাড়ু, কেরালা, রাজস্থান ও উত্তরাখণ্ডের মত রাজ্য ইতিমধ্যে জোরালো বার্তা দিয়ে দিয়েছে যে প্রত্যাশা মত ‘দক্ষিণে সাফ, উত্তরে হাফ’ (দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে এনডিএ’কে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দাও, আর উত্তরের রাজ্যগুলিতে অর্ধেকে নামিয়ে আনো) ফর্মুলা মোতাবেক ২০২৪’র নির্বাচনী ফলাফল এগোচ্ছে। কিন্তু ভোটদানের হার ও ফলাফলের ভবিষ্যৎবাণীর ঊর্ধ্বে যে বিষয়টি আমাদের অধিক মনোযোগ দাবি করে তা হল এই প্রলম্বিত নির্বাচনী সংগ্রামে সামনে আসা বিতর্ক ও চর্চা।

৪০০’র অধিক আসন জেতার প্রত্যয়ী দাবি সামনে রেখে বিজেপি তার প্রচারের এক আগ্রাসী সুর বেঁধে দেয় এবং ‘পরিবারবাদ’ ও ‘ভ্রষ্টাচার’এর ধুয়ো তুলে বিরোধীপক্ষের ওপর আক্রমণ নামায়। কিন্তু নির্বাচনের এক সপ্তাহ শেষ হতে না হতেই এইসব শ্লোগান হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সঙ্ঘ পরিবারের রণনীতিবিদেরা বুঝে গেলেন যে এইসব শ্লোগান আর তেমন অনুরণন তুলছে না। গণচর্চার পরিসরটা বদলে গেছে বিজেপির প্রত্যাশিত পতন এবং বিজেপির ছাতার তলায় সব ধরণের ভ্রষ্টাচারী পরিবারের রাজত্বের সমাহার বিষয়ক আলোচনায়। মরিয়া মোদী তাই তার চিরাচরিত ও পরীক্ষিত হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের এজেন্ডায় ফিরে যায়।

কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটের বিরুদ্ধে ‘মুসলমান তোষণ’এর দুইটি নির্লজ্জ অভিযোগ আনা হচ্ছে — হিন্দুদের সম্পত্তি এমনকি বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের গলার মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করে মুসলমানদের মাঝে বিতরণ করে দেওয়া হবে, এবং ওবিসি সংরক্ষণ কমিয়ে দিয়ে তার জায়গায় ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ চালু করা হবে। যোগী আদিত্যনাথ দুটি নতুন অভিসন্ধিমূলক অভিযোগ যুক্ত করেছেন — সারা দেশে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ তথা শরিয়া আইন লাগু হবে এবং দেশজুড়ে বেলাগাম গোহত্যা প্রোমোট করা হবে। ৪০০ প্লাস আসন পাওয়ার প্রত্যয়ী ঘোষণা দিয়ে যে প্রচার শুরু হয়েছিল তা পর্যবসিত হল এরকম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কে দেওয়া এবং বিরোধী দলগুলির ক্ষমতায় আসা সম্পর্কে এরকম ভয় ছড়িয়ে দেওয়ায়।

এই সমস্ত অবাস্তব অভিযোগ কেবলমাত্র বিজেপি শিবিরের ক্রমবর্ধমান হতাশাকে দেখিয়ে দেয়। আসলে বিজেপির এই ঔদ্ধত্য তার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে দেওয়ারই কথা। ভারতের খেটে খাওয়া মানুষের রুটিরুজিকে যে দলটি একাই ব্যাপক ধ্বংস করেছে, লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত পরিবারের উপার্জন, সঞ্চয় ও সামাজিক সুরক্ষা ক্ষয়ে যাওয়ার জন্য যে দলটি সম্পূর্ণভাবে দায়ী, সেই দলটি গরিব মানুষের কথাবলে কুমিরের কান্না কাঁদছে — এর থেক বড় শয়তানি আর কী হতে পারে। ওবিসি কোটা মুসলমানেরা নিয়ে নিচ্ছে বলে দেখিয়ে ওবিসিদের এইভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা সম্পূর্ণত তথ্যবিকৃতির ওপর দাঁড়িয়ে হচ্ছে। মুসলমানদের একটা অংশ বর্তমানে সংরক্ষণ পান সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে নয়, পেশা ও জাতের ভিত্তিতে এবং বেশিরভাগ রাজ্যে মুসলিম ওবিসি/ইবিসি জাতকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য সামগ্রিক কোটা বাড়ানো হয়েছে।

বস্তুত সংরক্ষণ প্রশ্নে আজকের সময়ের মূল উদ্বেগের বিষয় হল মোদী রাজত্বে সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে ধারাবাহিক ও সুপরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে খর্ব করা হয়েছে। অর্থনেতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের নির্বিচার বেসরকারিকরণ এবং সর্বত্র চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে সংরক্ষণ ব‍্যবস্থার সুযোগ বহুলাংশে সীমিত এবং প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। সমাজের যে অংশ এযাবৎকাল বহিষ্কৃত ছিল, জনসংখ্যার অনুপাতে যাদের ভাগিদারী ছিল নগণ্য, তাদের যথাযথ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার হাতিয়ার হিসেবেই যে সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রণয়ন সেই ধারণাকেই পরিত্যাগ করে ও পাশ কাটিয়ে আমলাতন্ত্রের উর্ধ্বতন স্তরে ল্যাটেরাল এন্ট্রির বন্দোবস্ত অনেক বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টি থেকে যে বাস্তব দাবি বর্তমানে উঠে এসেছে তা হল জাতজনগণনা করে সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো, বিহারে যেমনটা হয়েছে। বিজেপি এর চরম বিরোধী। এবং তাদের এই চরম বিরোধিতাকে আড়াল করতে, তাদের সংরক্ষণ বিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে এই ওবিসি বনাম মুসলমানের ধূয়ো তুলছে বিজেপি।

সামাজিক ন্যায় ও সংরক্ষণের ধারণার প্রতি আরএসএসের ঐতিহাসিক বিরোধিতা ভারতে কোনো গোপন বিষয় নয়। ১৯৯০ সালে ভি পি সিং সরকার থেকে বিজেপি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল মূলত মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ওবিসি সংরক্ষণ চালু করার ভি পি সিং সরকারের ঘোষণায় বিজেপির বিরোধের কারণে। ২০১৪ সালে মোদীর বিজয়লাভের পর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত স্বয়ং প্রস্তাব আনেন ভারতে বিদ্যমান সংরক্ষণ ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করে দেখার। আজ সেই একই মোহন ভাগবত বলতে শুরু করেছেন গত দুই সহস্র বছর জাতের নিপীড়ন থাকার কারণে আগামী আরো দুইশত বছর সংরক্ষণকে ‘সহ্য করা’র কথা! এবং মোদীর এমন ঔদ্ধত্য তিনি এসসি/এসটিদের ভয় দেখান যে বিরোধীপক্ষ জিতলে এসসি/এসটিদের সংরক্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে।

ভারতে এখন জনগণের মূল উদ্বেগের বিষয় নিছক সংরক্ষণে আটকে নেই। ভারতের সংবিধানের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েই দুশ্চিন্তার নানা কারণ হাজির হয়েছে। আম্বেদকরের সংবিধানের সাথে গোলওয়ালকরের আরএসএসের মৌলিক ঐতিহাসিক বিরোধকে আজ অবহেলা করলে তা আধুনিক ভারতের পক্ষে সর্বনাশের কারণ হবে। ভারতের সংবিধান গ্রহণের সময়ই আরএসএস প্রকাশ্যে মনুস্মৃতিকে ভারতের আদর্শ সংবিধান হিসেবে তুলে ধরেছিল। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও বাজপেয়ি ও আডবাণীর নেতৃত্বে চলা এনডিএ সরকার সংবিধানের কার্যকারিতা খতিয়ে দেখতে কমিশন গঠন করতে পিছপা হয়নি। ইতিমধ্যে গত দশ বছরে মোদী সরকার দেশের সংবিধানের শরীরে সহস্র কোপ মেরে দিয়েছে, যে কোনো সুযোগে সংবিধানের মূল সুর ও নীতিমালায় অন্তর্ঘাত চালিয়ে এমনকি তার বুনিয়াদি কাঠামোকেও পাল্টে দিয়ে।

স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে মোদীর প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিবেক দেবরায় একটি নিবন্ধ লিখে একটি নতুন সংবিধান রচনার পক্ষে সওয়াল করেন যে সংবিধান মোদী রাজত্বের নীতিসমূহের ‘সম্পূর্ণ সম্ভাবনা’ বাস্তবায়িত করতে পারে। সঙ্ঘ পরিবারের কিছু কিছু মার্গদর্শকের এতটাই ঔদ্ধত্য যে তাঁরা আম্বেদকরের সংবিধানকে ঔপনিবেশিক দস্তাবেজ বলে অভিহিত করে ‘বি-উপনিবেশকরণ’এর নামে নতুন সংবিধান রচনার কথা বলেন। ফলত, সংবিধান গ্রহণের প্রাক্কালে বাবাসাহেব আম্বেদকর যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন তা আজ ভারতের স্মরণ করার সময় এসেছে। আম্বেদকরের সংবিধানের সার বস্তু — সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা, এর তদারকি এবং সন্তুলনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপনাসমূহ, আলাদা আলাদা ক্ষমতার বন্টন এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো — এই সবই এখন বড় ধরণের বিপদের মুখে আছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাই এখন প্রশ্নের মুখে আছে বিজেপির ‘অপারেশন লোটাস’ অভিযানের ফলে। এই অভিযানে এখন তারা নতুন মডেলও সামনে এনেছে — চণ্ডিগড় ও খাজুরাহ থেকে সুরাট, ইন্দোর ও অরুণাচল প্রদেশ — নমিনেশন থেকে শুরু করে ভোট গণনা অবধি নির্বাচনের বিভিন্ন স্তরে।

মোদী, শাহ ও ভাগবত যখন ভারতকে গ্যারান্টি দেওয়া শুরু করেছে সংবিধানের স্থায়িত্ব ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিষয়ে তখন এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই ক্ষমতাসীনেরা তাদের নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে মিথ্যা বলতে শুরু করেছে। প্রথম দুই পর্ব এই নির্বাচনের মূল সুর ও অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছে, আমরা ভারতের জনগণ এখন অবশ্যই একে আগামী পাঁচ পর্বের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাব ইণ্ডিয়া জোটের নির্ধারক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন তথা সুস্পষ্ট বিজয়ের লক্ষ্যে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৬ মে ২০২৪

খণ্ড-31
সংখ্যা-17