সংগঠকের ডায়েরি
organizers-diary

‘পুরো প্যানেল বাতিল হলে তার অভিঘাত অস্বীকার করতে পারে না আদালত’ - বলছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তিনি যখন এই পর্যবেক্ষণ রাখছিলেন, সেসময় চোখের সামনে ভেসে উঠছিল কয়েকদিন আগে, ৩রা মে- র আশ্চর্যলড়াই এর টুকরো টুকরো ছবিগুলি। সেদিন কলকাতার রাজপথ অচল করে দিয়েছিলেন হাজার হাজার শিক্ষক, সদ্য চাকরিহারা তাঁরা। তাঁদের অতিসংগত ক্ষোভ, তাঁদের অসন্তোষ আছড়ে পড়েছিল নিয়োগ কর্তৃপক্ষ এসএসসির সদর দপ্তর আচার্যভবনে। ন্যায় বিচারের দাবিতে উত্তাল সেই ক্ষোভের সামনে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল পুলিশ প্রশাসন। মাইকে পুলিশের দায়িত্বশীলরা তারস্বরে ঘোষণা করে চলেছেন, উত্তেজিত না হওয়ার জন্য, কিন্তু কীভাবে থামানো যায় সমবেত এই ১০/১২ হাজার সদ্য কাজহারা শিক্ষকের আছড়ে পরা সুবিশাল গণরোষ, স্পষ্টতই তাঁরাও দিশেহারা।

৩০ এপ্রিল শহীদ মিনার মাঠের ধারে বসে কাজহারা শিক্ষকদের পক্ষ থেকে নিজেদের বৈঠকে যখন আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল, তখন কোন সাংবাদিক বৈঠক হয়নি। স্রেফ হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এই আহ্বান যে শিক্ষকদের সামনে আর অন্য কোন পথ নেই। কারণ হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পরেও এসএসসি চেয়ারম্যান সাংবাদিক বৈঠক করে সবটা ঘেঁটে দিয়ে বলেছেন, ৫ হাজারের বাইরে অর্থাৎ বাকি ১৯ হাজারের মধ্যেও অযোগ্য আছে কিনা, তিনি হলফ করে বলতে পারছেন না। এই কথাই যদি নিয়োগ কর্তৃপক্ষ এসএসসি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টেও বলেন, তবে হার অবধারিত। অতএব এসএসসি থেকে সেগ্রিগেশন বা বাছাই এর দাবিতে, যোগ্য -অযোগ্য বিভাজনের দাবিতে আচার্য ভবন ঘেরাও, ডেপুটেশন করতে হবে।

কাজহারাদের মরিয়া এই আহ্বান সময়োপযোগী ও যথার্থছিল, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে।

সূদূর উঃবঙ্গ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ;কলকাতা সংলগ্ন প্রত্যেকটি জেলা থেকে ১২টার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা, হাজারে-হাজারে।

ন্যায় বিচারের দাবিতে এই ক্ষোভকে বিপথে চালিত করতে , ভোটের মরশুমে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত করতে ভিড়ের মধ্যে প্রচেষ্টা চলেছিল, কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত এই গণবিস্ফোরণকে শক্তিশালী গণপ্রতিরোধে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হলেন। বিকেল প্রায় ৫টা পর্যন্ত অচল হয়ে গিয়েছিল করুণাময়ী । চেয়ারম্যান শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিলেন বিক্ষোভরত চাকরিহারাদের প্রতিনিধিদের সামনে হাজির হতে এবং তাঁদের দাবি মেনে শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে এই কথা নিজের মুখে বলতে যে এসএসসি সর্বোচ্চ আদালতে জানাবে প্যানেলে যোগ্য -অযোগ্য বিভাজন করা সম্ভব।

হাইকোর্টের রায়ে কর্মচ্যুত শিক্ষকদের এই ঐতিহাসিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে কার্যত অস্বীকার করল মেইনস্ট্রিম মিডিয়া! পরদিন মিডিয়া প্রচার করল, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী সভামঞ্চ থেকে চাকরিহারাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করলে এসএসসি চেয়ারম্যান বাধ্য হয়ে ‘ডিগবাজি’ খেয়েছেন, যোগ্য-অযোগ্য বিভাজনের অঙ্গীকার করেছেন।

একই কথা ওরা আজও বলতে চেষ্টা করল। শুভেন্দু অধিকারী বলল, কোর্টে এই জয় এসেছে প্রধানমন্ত্রী পাশে থাকার জন্যই! কিন্তু কাজ হারা শিক্ষকরা জানেন, তাঁদের লড়াই, তাঁদের আজকের জয় এনে দিয়েছে, ভবিষ্যতে চূড়ান্ত জয় নিজেরা লড়েই আদায় করতে হবে।

৩ তারিখ প্রকাশ্য রাজপথে কমপক্ষে ১০হাজার শিক্ষকের মরিয়া বিক্ষোভ দেখেও সংবাদমাধ্যমগুলি সেভাবে তুলে ধরে নি। বলেছে , প্রধানমন্ত্রীর চাপে এসএসসির অবস্হান বদল!পরদিন আনন্দবাজার একে হাজার খানেক শিক্ষকের বিক্ষোভ বলে উল্লেখ করেছে! এর একটা বড় কারণ সম্ভবত এই যে ঘোলাজলে মাছ ধরতে শিক্ষকদের বলি দিয়ে ভোটের মরশুমে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে বিজেপি সহ অন্যান্য কিছু বিরোধী শক্তি যে পরিকল্পনা করেছিল, সেদিন করুণাময়ীর জমায়েত সেই ফাঁদে পা দেয়নি। সেদিন ঐ জমায়েত থেকে বারবার গদি মিডিয়া সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করা হয়েছে। এমনকি এটাও দেখা গেছে যে একটি চ্যানেল কাজহারা শিক্ষকের ইন্টারভিউ নিতে নিতে তাকে বিজেপি অভিমুখী করতে চাইলে যিনি এতক্ষণ ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ গদি মিডিয়া বলে ফুঁসে উঠেছেন।

আজকের রায়ে এটাই পর্যবেক্ষণের মূল বিষয় যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এইভাবে দুর্নীতির দায়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের একটি সম্পূর্ণ প্যানেলকে বাতিল করতে একমত হয়নি এমন ধরণের রায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অভিঘাতকে মাথায় রেখেও। আদালত এই অভিঘাতের কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত অযোগ্যদের থেকে ১২% সুদ সহ বেতন ফেরৎ নেওয়ার পূর্ববর্তী রায়েও স্হগিতাদেশ দিয়েছে।

হাইকোর্ট রায় ঘোষণার পর এই দুটি প্রশ্ন ব্যাপক সামাজিক চর্চার বিষয় হয়েছিল।

প্রশ্ন উঠেছিল

১) যোগ্য-অযোগ্য বিভাজন আদালত কেন করল না! যোগ্যরা কেন অকারণে শাস্তি পাবে?

২) ১২% শতাংশ সুদ সহ অযোগ্যদের থেকে এতদিনকার বেতন ফেরৎ নেওয়ার যৌক্তিকতাও যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। সমাজের সর্বত্র বারবার এই প্রসঙ্গে সামনে এসেছিল ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার এই দার্শনিক ভিত্তিভাবনা, যা বলে কোন নিরপরাধী যেন শাস্তি না পায়, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এমনকি এরজন্য যদি অপরাধী ছাড়া পায়, তবুও। তবে এ কেমন রায়, যা যোগ্য -অযোগ্য বিভাজন করতে পারে না!

এমনকি রাজ্য সরকার ও এসএসসি যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি করেছে,তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট থাকার পরেও মানুষ কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মানতে পারেনি।

বিকাশবাবুরা পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াই বেআইনি বলে ৭ মে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেছেন। তারপরেও মাননীয় বিচারপতিরা একমত না হয়ে একাধিক স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। একথা এই কারণেও গুরুত্বপূর্ণযে ৭ মে বিচারপতিরা রাজ্য সরকার ও এসএসসির বক্তব্য এবং বিকাশরঞ্জনদের বক্তব্যই মূলত শুনেছেন, অন্যরা সেভাবেবলার সুযোগ পাননি; তারপরেও এসেছে এইসব স্হগিতাদেশ।

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজ্য সরকার ও এসএসসি যে ব্যাপক দুর্নীতি করেছে, তা আজ মানুষের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আর এই দুর্নীতিকে হাতিয়ার করেই ষড়যন্ত্রের গভীর জাল বুনেছে বিজেপি। তৃণমূল সরকারের প্রতি অন্ধ ক্রোধের কারণে কার্যত বিজেপির পরিকল্পনার অঙ্গ হয়ে গেছেন বিকাশবাবুরা। এই জটিল পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে লোকসভা নির্বাচনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ফ্যাসিস্টদের পরিকল্পনা চলমান সংকটকে গভীরতর করতে সেভাবে সক্ষম হতে পারল না মূলত কাজহারা শিক্ষকদের সামাজিক -রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে, রাস্তায় নেমে গড়ে তোলা তাঁদের গণপ্রতিরোধের কারণে, শুধুমাত্র আদালত মুখাপেক্ষী না থেকে একইসাথে রাস্তার লড়াইকেও সমান অগ্রাধিকারে রাখার কারণে। এই কারণেই বিজেপি প্রভাবিত সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই সংকটকে বিজেপির অনুকূলে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হল। এমনকি নিজেরাও কোন দাগ কাটতে ব্যর্থ, এখনও পর্যন্ত।

এই লড়াইয়ে আমাদের কিছু কমরেডের সচেতন হস্তক্ষেপ, পাশে থাকা, আন্তরিক সহযোগিতা নিশ্চিতভাবেই যথেষ্ট ইতিবাচক। এই আঘাতপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এক বিরাট অংশ একটি অধিকার মঞ্চকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। চলমান ঘটনাবলী, বাস্তব বিকাশ তাঁদের সামনে অনেক কিছুই স্পষ্ট করে দিচ্ছে। একদিকে বিজেপি, অন্যদিকে বিকাশবাবুদের ভূমিকা অনেক কিছু উন্মোচিত করেছে। আজকের এমন এক সময়ে বৃহত্তর শিক্ষক সমাজের মধ্যে পার্টির প্রভাব বিস্তার করতে ‘অধিকার মঞ্চ’ ধরনের অন্তর্বর্তী সাংগঠনিক ধাঁচা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা, নিয়মিত ও দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক তৎপরতা।

দুর্নীতি, আদালতের একপেশে বিচার, শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট, শিক্ষকদের নির্বিচার কাজ হারানো, ঘোলাজলে মাছ ধরতে ফ্যাসিস্ট সহ বিরোধী শিবিরের চক্রান্ত ইত্যাদি ঘটনাবলী রাজ্যের জনজীবনে ইতিমধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।

সমাজের এই যথেষ্ট সংবেদনশীল অংশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার আপাতত একটি সুযোগ এসেছে। পার্টিকে সেভাবে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

- সজল অধিকারি

খণ্ড-31
সংখ্যা-17