চার দফা নির্বাচনের পর ক্রমেই এটা স্পষ্ট হচ্ছে, মোদী ম্যাজিকের সেই ‘অলৌকিকতা’ এবারের নির্বাচনে ভূভারত থেকে উধাও। কর্পোরেট সংস্থাগুলো বেসরকারি ভাবে যে একজিট পোল করিয়েছে, তাতেই তারা বুঝে গেছে তৃতীয়বারের জন্য মোদীর ফিরে আসা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়েছে। আর তাই মে মাসের প্রথম দশ দিনের মাথায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের শেয়ার বাজার থেকে এক লপ্তে তুলে নিল ১৭,০০০ কোটি টাকা, রাজনৈতিক অস্থিরতার আঁচ পেয়ে!
এখন দেশ জুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত মোদীর অসহায়তা ও মানসিক অস্থিরতা। মোদী গ্যারান্টি, বিকশিত ভারত, বিশ্বের দ্রুততম বিকাশশীল অর্থব্যবস্থা যা ভারতকে নিয়ে যাবে তিন নম্বরে — প্রভৃতি সমস্ত কিছুই আম জনতার কাছে মিথ্যা রসিকতায় পর্যবসিত হওয়ার পর মরিয়া মোদী আরএসএসের চিরাচরিত মেরুকরণের হীন রাজনীতির কোলে আশ্রয় নিলেন। আজ পর্যন্ত দেশের কোনও প্রধানমন্ত্রী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষকে এতো নিচুতে নামিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ময়দানে নামেননি। আর কখনোই খোজা প্রহরীর মতো গলায় বকলশ পরা জাতীয় নির্বাচন কমিশন শাসক দলের পক্ষে দাঁড়িয়ে এইভাবে খোলাখুলি খেলতে নামেনি। আর কোনোদিনই একাধিক বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পাঠিয়ে গোটা দেশকে প্রকাণ্ড একটা কারাগারে রূপান্তরিত করে লোকসভা নির্বাচন হয়নি। কী অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে এবারের লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে আজ তা সারা বিশ্ব দেখছে।
এই প্রথম বার মোদী পরোক্ষে স্বীকার করলেন, নোটবন্দি কালো টাকা রুখতে পারেনি। আদানি আম্বানির টেম্পো ভর্তি কালো টাকার উল্লেখ একই সাথে আরও একটা প্রশ্ন তুলে দিল — কেন সেই কালো টাকা উদ্ধারে ইডি বা কেন্দ্রীয় এজেন্সি হাত গুটিয়ে বসে থাকল! দেশের চৌকিদার কেন নিজ কর্তব্য পালনে এই চরম গাফিলতির জন্য জবাবদিহি করবেন না? সন্দেশখালির একের পর এক স্টিং অপারেশন দেখিয়ে দিল, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতে বিজেপি অর্থবল, অস্ত্রবলের উপরই শুধু নয়, নারীর সম্ভ্রমকে হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে কত নিচে নামতে পারে। যে ভিডিও নিয়ে বিজেপি নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, তাদের জানিয়ে দেওয়া দরকার যে জেএনইউ’তে আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে কানহাইয়া কুমার, অনির্বাণ ভট্টাচার্যদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসাতে কীভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির ঘনিষ্ঠ এক নেত্রী ভুয়ো ভিডিও তৈরি করে, যা পরবর্তীতে আদালতে প্রমাণিত হয়। কীভাবে ভীমা কোরেগাঁও’এর মিথ্যা মামলা সাজাতে প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের পেগাসাসের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে ভুয়ো তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
মুসলিম বিদ্বেষকে কল্পনাতীত কর্দযতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই নির্বাচন পর্বে। উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকিতে বিজেপির নেতা রঞ্জিত বাহাদুর শ্রীবাস্তব এক নির্বাচনী সভায় বলেন, “গত পাঁচ বছর ধরে মোদী মুসলমানদের মনোবল ভেঙে চুরমার করার কাজে নেমেছেন। যদি মুসলমানদের নির্বংশ করতে হয়, তবে মোদীকে ভোট দিন। আর না দিলে তার ঠেলা সামলাতে আপনারা প্রস্তুত থাকুন।” এই সমস্ত ঘৃণা ভাষণ নির্বাচন কমিশনের কানে ঢোকে না!
বিবিধের মাঝে মহান ভারতের এটাই ঐতিহ্য, এবারের নির্বাচনে মেরুকরণের ঘৃণ্য রাজনীতিকে পেছনে ফেলে আবার বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে রক্ষা করার অ্যাজেন্ডাই সামনে চলে আসছে, মোদী ম্যাজিকের কাল্পনিক যাদুকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করে।
মোদীর ফ্যাসিবাদী জমানার নিশ্চিত পরাজয় এখন আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ দূরে!