আর্থিক অসাম্য উঠে এল অ্যাজেন্ডা হয়ে
inequality-came-up-as-the-agenda

পুনর্বন্টনের ধারণার মূলেই এবার খোদ মোদী আঘাত নামালেন চলমান নির্বাচনী প্রচার অভিযানে।

সরকার কর্তৃক সাধারণ মানুষের জন্য আইনত নানান বরাদ্দকে কটাক্ষ করা কিন্তু অতি ধনী কর্পোরেটদের জন্য লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক ছাড়কে ইন্সেনটিভের তকমা দেওয়া, কর্পোরেটদের সম্পদ সৃষ্টিকারী হিসাবে চিহ্নিত করা মোদী জমানায় এক দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মোদীর জমানায় আর্থিক ও আয়ের নিরিখে ভারতবর্ষবিশ্বের সবচেয়ে অসম দেশ হিসাবে জগৎ সভায় উঠে এসেছে, যেখানে দেশের এক শতাংশ অতি ধনীর কব্জায় চলে গেছে দেশের ৪০ শতাংশেরও বেশি আয় ও সম্পদ! এতো উৎকট অসাম্য বিশ্বের আর কোথাও নেই। ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়ে এক শতাংশ অতি ধনীর হাতে ছিল দেশের মোট সম্পদের পনেরো শতাংশ। আজ তা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। ব্রিটিশ রাজের থেকেও ভারতের বর্তমান অবস্থা যে কত বেশি খারাপ তা দেখিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব রিপোর্ট। ওই সমীক্ষাই বলেছে, যদি এদেশের ১৬৭ অতি ধনী পরিবারের রোজগারের উপর মাত্র দু’শতাংশ কর ধার্য করা যায়, তা হলে তা থেকে ০.৫ শতাংশ জাতীয় আয়ের সমতুল টাকা পাবে সরকার, আর তা দিয়ে স্বাস্থ্য-শিক্ষা আর পুষ্টি এই তিনটি খাতে বেশ খানিকটা সরকারি বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে।

অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) জানাচ্ছে সমস্ত দেশেই সম্পত্তি (প্রপার্টি) কর রয়েছে, বেশিরভাগ দেশেই রয়েছে উত্তরাধিকার কর, আর কিছু কিছু দেশে আছে সম্পদ কর। আমাদের দেশে নাম কা ওয়াস্তে সম্পত্তি কর আছে। এছাড়া, সবচেয়ে উঁচু স্তরে রয়েছে তুলনামূলক কম হারে (৩০ শতাংশ) আয়কর। আর দেশের অতি ধনীরা বিরাট মাত্রায় ভর্তুকি ভোগ করে থাকেন। পুনর্বন্টন পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিতে খুবই প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবস্থাপনা যেখানে আয় ও সম্পদ নিজের নিয়মে পরিচালিত হয়। ওইসিডি সঠিক ভাবেই বলেছে, “মুনাফার থেকে অর্জিত সম্পদের আহরণ নিজের নিয়মেই ক্রমাগত বেড়ে চলে। সম্পদ কর এই প্রক্রিয়াকে থামাতে পারবেনা, কিন্তু কিছুটা মন্থর করে দেয়।” নির্বাচনের সময়, তা বিধানসভা বা লোকসভা হোক না কেন, কিছু জনমুখী প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে, যেমন মনরেগা অথবা জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন।

অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক কৌশিক বসুও ভারতের উৎকট আয় ও আর্থিক অসাম্য নিয়ে অনেক নিবন্ধ লিখেছেন। তিনিও দেখিয়েছেন অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বে দ্রুততম বিকাশশীল দেশ, পঞ্চম বৃহৎ অর্থব্যবস্থা এই ভারতে বহুল প্রচারিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি রোজগার ও কর্মসংস্থান দিতে পারছে না, খাদ্যপণ্যের চড়া মূল্যস্ফীতি (৮.৫ শতাংশ) আম জনতার প্রকৃত আয়ের উপর থাবা বসিয়েছে, কমেছে ব্যাপক ক্রয় ক্ষমতা, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র ও ঋণের বোঝায় ২০২২ সালে ১১,২৯০ জন চাষি আত্মঘাতী হয়েছেন। আজ ভারতের কর্মহীনতা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কোভিড-উত্তর দুনিয়া যখন বিশ্বজুড়েই বিরাট এক আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হল, বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ যখন রুটি রুজি হারিয়ে দারিদ্রের খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে, তখন সরকারগুলির সংকটাপন্ন রাজকোষ ভরাতে অতি ধনীদের উপর সম্পদ, সম্পত্তি প্রভৃতি কর বসানোর এক জোরালো বয়ান সামনে আসে দুনিয়া জুড়ে। আমাদের দেশেও কোভিড কালে আদানি আম্বানি কী বিপুল সম্পদ কুক্ষিগত করে তা সেই সময় ব্যাপক চর্চিত হয়।

কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে কয়েকটা প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। যেমন, প্রতিটি গরিব পরিবারকে বছরে এক লক্ষ টাকা নগদ তাঁদের অ্যাকাউন্টে পাঠানো, যা ২০১৯’র ন্যূনতম আয় যোজনারই আরেকটা সংস্করণ। এর পাশাপাশি শহরে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প, সমস্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রভৃতি। মোদী সচেতন ভাবেই এই পদক্ষেপগুলোকে সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে ডাহা মিথ্যা প্রচার শুরু করেছে।

ভারতবর্ষের কুৎসিত কদর্য অসাম্য আজ রীতিমতো আলোচ্যবিষয় হয়ে উঠেছে। আয় ও সম্পদের পুনর্বন্টনের দাবি সমাজের ভেতর থেকে, অর্থনীতিবিদদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের ও উদারপন্থী মহল থেকে উঠে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে কিছুটা সংযত ও ভারসাম্য ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’এর মধ্যে দিয়ে চলার জন্য ওই ধরনের সংস্কারের দাবি ভেতর থেকেই উঠে আসে।

আমাদের দেশে যথাসময়ে এই উৎকট আর্থিক অসাম্য উঠে এল আলোচ্যসূচিতে। নির্বাচনী ফলাফল যাই হোক না কেন, আগামী দিনে এই বিষয়টাকে ধরেই রাজনৈতিক আন্দোলনের সলতে পাকানো দরকার।

খণ্ড-31
সংখ্যা-17