২০২৪’র প্রলম্বিত নির্বাচন এখন মধ্যপর্বে। বিজেপি তার ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’এর বাগাড়ম্বরটুকুও বিসর্জন দিয়ে সরাসরি মুসলিম বিদ্বেষী ঘৃণাপ্রচারকে তাদের নির্বাচনী প্রচারের মূলমন্ত্র করে তুলেছে। বিরোধীপক্ষ সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদী ও অন্যন্য বরিষ্ঠ বিজেপি নেতাদের ছুঁড়ে দেওয়া অভিযোগগুলি আরো বেশি বিষাক্ত ও নির্লজ্জ হয়ে উঠছে। শুরু করেছিল এই অভিযোগ দিয়ে যে কংগ্রেস নাকি সাধারণ মানুষের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে — মহিলাদের বিয়ের মঙ্গলসূত্র, বাড়িঘর, গরুমোষ সবকিছু — এবং তা মুসলমানদের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দেবে। এরপর এল আরেক শয়তানি অপপ্রচার যে, এসসি/এসটি/ওবিসি কোটার সব সুযোগ মুসলমানদের দিয়ে দেওয়া হবে। এবং এখন ওরা ভোটারদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার ফিরে এলে তা পাকিস্তানের জন্য কত খুশির বিষয় হবে।
পাকিস্তান টেনে প্রচার অবশ্য বিজেপির চিরাচরিত পদ্ধতি। গুজরাটে মোদী ২০০২ সাল থেকে প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে পাকিস্তানের ধুয়ো তুলে প্রচার করেছেন। বিহারে ২০১৫’র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যখন নীতীশ কুমারের জেডিইউ’এর সমর্থন ছাড়াই ভোট লড়েছিল তখন ২৪৩ আসনের বিধানসভায় মাত্র ৫৩ আসন জিততে পেরেছিল। সেই নির্বাচনে অমিত শাহ বিহারের মানুষকে পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে সন্ত্রস্ত করার সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সব সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের দিয়ে দেওয়া হবে বলে সাধারণ হিন্দু জনতাকে ভয় দেখানোর এমন মোটা দাগের আকাট প্রচার মোদী ও বিজেপি আগে কখনও করেনি। এবং মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী, এদেশে ঢুকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেশ দখল করতে চাইছে — খোদ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক একটার পর একটা ভাষণে এইভাবে দেশের মুসলমান সমাজকে আক্রমণের নিশানা বানানো মারাত্মক ও চরম আপত্তিকর।
মোদী বুঝতে পেরেছেন যে সংরক্ষণ বিষয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ভারতের সংবিধানের ভবিষ্যৎ বিষয়ক কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। সংরক্ষণ বিতর্ককে বিরোধীপক্ষ হিসেবে ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতার নানান পরিসরে দেশের বিবিধ সামাজিক গোষ্ঠীর যথাযথ মাত্রার প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে উত্তরিত করতে পেরেছে। বিহারে জাত জনগণনা সম্পন্ন হওয়া এবং তার ফলশ্রুতিতে সংরক্ষণের সীমা ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রসারিত করা (ইডব্লুএস কোটার ১০ শতাংশকে হিসেবের বাইরে রেখে) সারা দেশের জন্য একটা কার্যমাণক হাজির করেছে। বিহারে এই জাত জনগণনাকে বিরোধিতা করার অবস্থা বিজেপির ছিল না, কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে জাত জনগণনার চরম বিরোধী বিজেপি। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে এসসি/এসটি/ওবিসি জনতাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে সংরক্ষণ প্রশ্নটিকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে।
ওবিসি কোটা মুসলিমদের দিকে চালান করে দেওয়া হচ্ছে বলার থেকে অসত্য ও শয়তানি আর কিছু হতে পারে না। গুজরাট সহ দেশের দশটিরও বেশি রাজ্যে বহুদিন ধরে মুসলমানদের মধ্যেকার বেশ কিছু জাত ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছে। তাঁরা মুসলমান হিসেবে সংরক্ষণ পান না, তাঁরা সংরক্ষণ পান তাঁদের পেশাগত, সামাজিক ও শিক্ষাগত পশ্চাদপদতার মাপকাঠিতে ওবিসি হিসেবে স্বীকৃতির কারণে। মুসলমানদের মধ্যে এরকম জাতের তালিকাটা সবচেয়ে দীর্ঘ সম্ভবত গুজরাট রাজ্যে এবং এএনআই সংবাদ সংস্থাকে ২০২২ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নরেন্দ্র মোদীকে দেখা যাচ্ছে গুজরাটে ৭০টি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ওবিসি’র সুযোগ দেওয়ার জন্য কৃতিত্ব জাহির করতে। বিহারে মুসলমানদের ওবিসি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেই কর্পূরী ঠাকুরের সময়ে, ১৯৯০ সালে ভি পি সিং সরকার কর্তৃক মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু করার ঘোষণারও আগে। ভি পি সিং সরকারও বেশ কিছু মুসলমান জাতকে ওবিসি ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস্য বিশিষ্ট সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৯২ সালে তার ঐতিহাসিক রায়ে ওবিসি সংরক্ষণের বৈধতা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।
সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপি স্বয়ং খুব চেষ্টা করেছে ‘পাশমান্দা’ (পশ্চাদপদ, বঞ্চিত) মুসলমানদের জন্য প্রচারাভিযান সংগঠিত করে এবং ‘সুফি সংবাদ’ (সুফি বার্তালাপ) কর্মসূচি চালিয়ে নিজের ‘সকলকে নিয়ে চলা’ (সবকে সাথ সবকে বিকাশ) ভাবমূর্তি তৈরি করতে। এই দলটির এটাও ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে ২০১৪ ও ২০১৯-এ তাদের প্রাপ্ত ভোট বহুলাংশে তাদের নিজস্ব জনভিত্তি পেরিয়ে অন্যান্য অংশ থেকে এসেছিল, যথাক্রমে দুর্নীতি ও জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্ন ঐ দুই নির্বাচনে প্রাধান্যকারী বিষয় হয়ে ওঠায়। এবারের নির্বাচনে বিজেপি মরিয়া হয়ে উঠেছে তার নিজস্ব জনভিত্তিকে চাগিয়ে দিতে কারণ বিজেপি এবারে তার ‘সকলকে নিয়ে চলা’, ‘বিকাশ ও সুশাসনের’ মুখোশটাও ঝেড়ে ফেলে নির্লজ্জভাবে মুসলমান-বিরোধী ঘৃণাপ্রচারের আশ্রয় নিয়েছে। গুজরাটে এই ফর্মুলা কাজে এসেছিল। ২০২৪ নির্বাচন এই ঘৃণা ও বিভাজনের ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করে সাংবিধানিক ভিত্তিমূল, সাংস্কৃতিক বিবিধতা এবং সম-নাগরিকত্বে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান হাজির করেছে।
বিজেপি অযোধ্যার রাম মন্দিরকে ২০২৪’র নির্বাচনে তাদের সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড বানাতে চেয়েছে। ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় অসম্পূর্ণ মন্দিরের উদ্বোধনকে এক চোখ ধাঁধানো দৃশ্য হিসেবে সাজানো হয়েছিল যে দৃশ্য নির্বাচনকে ছাপিয়ে ব্যাপ্ত হবে। ‘যো রাম কো লায়ে হ্যায় হম উনকো লায়েঙ্গে’ (যারা রামকে এনেছে আমরা তাদের আনব) গানটি ২০২৪’র নির্বাচনী সংগীত হয়ে উঠবে এমনটাই ভেবেছিল ওরা। কিন্তু মন্দিরের রাজনীতিকরণের এই অপচেষ্টা, একে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে ফয়দা লাভের অপচেষ্টা এই নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়েছে বলেই মনে হয়। তৃতীয় দফা ভোটের আগে মোদীর অযোধ্যা রোড-শো এবং ঠারেঠোরে বলা যে এসপি ও কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মন্দিরটিকে হাসপাতাল বানিয়ে দেবে — বিজেপির ক্রমবর্ধমান হতাশাকে দেখিয়ে দেয়। তৃতীয় দফার পর এখন মোট ৫৪৩ আসনের অর্ধেকে মতদান সম্পন্ন হয়েছে। শুরুর দফাগুলি ইন্ডিয়া জোটের নিশ্চিত এগিয়ে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে, আগামী চার পর্ব জুড়ে এই প্রবণতাকে এক নির্ধারক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দৃঢ়বদ্ধ করতে হবে স্বৈরতান্ত্রিক মোদী জমানার বিপর্যয়কর শাসনের অবসান ঘটাতে।
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৩ মে ২০২৪