দু’দফা নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে, তৃতীয় দফা নির্বাচন পর্বমিটতেও আর বেশী দিন নেই, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। যাঁদের দায়িত্ব ছিল, স্বচ্ছ একটি নির্বাচন পরিচালনা করার, তাঁরা মোটামুটি নিজেদের শাসকদলের কাছে, বিশেষতঃ তাঁদের প্রথম সারির নেতাদের কাছে সঁপে দিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহার পড়ে, শাসক বিজেপির মোটামুটি রাতের ঘুম উড়ে গেছে। যেদিন থেকে কংগ্রেসের এই ন্যায়পত্র প্রকাশিত হয়েছে, সেদিন থেকেই নির্বাচনী আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে, নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধ্যকতার সুযোগ নিয়ে, প্রধানমন্ত্রী থেকে বিজেপির তাবড় নেতানেত্রীরা কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ শুরু করেছেন।
একটি দেশের নির্বাচনে বিরোধী দলের নির্বাচনী ইস্তেহার যে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, তা এবারের লোকসভা নির্বাচন পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে। অনেকদিন ধরেই অনেক অর্থনীতিবিদ এবং নানান গণনাসংস্থা একটা কথা বলে চলেছেন — দেশে সম্পদ ক্রমশ আরো বেশি বেশি করে কুক্ষিগত হচ্ছে ধনী এবং অতিধনীদের হাতে। তারা যেমন আরো বড়োলোক হচ্ছে, তেমনি আরো গরীব হচ্ছে বাকি জনতা। সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অসমতার তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি এবং অন্যান্যরা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে — অর্থনৈতিকভাবে ধনীতর এক শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে দেশের চল্লিশ শতাংশ সম্পদ। এবং এক শতাংশের হাতে প্রতি বছর জমা হচ্ছে দেশের মোট বার্ষিক আয়ের বাইশ শতাংশ।
এখান থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। কংগ্রেস তাঁদের ন্যায়পত্রে ঘোষণা করেছে, যে তাঁরা এবং তাঁদের ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় আসলে, ভারতে অতিধনীদের সম্পত্তির একাংশের পুনর্বন্টন করা হবে। এই কথা প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তাঁদের দলের বড়, মেজ সেজ সব ধরনের নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এবং ক্রমাগত নানান নির্বাচনী সভা থেকে তাঁরা মানুষদের ভুল বোঝানো শুরু করেছেন। গত দশ বছরে, যাঁদের হাতে মূলত অর্থ, প্রতিপত্তি এবং বিত্ত কুক্ষিগত হয়েছে, তাঁরাই যে কংগ্রেসের এবং ইন্ডিয়া জোটের মূল লক্ষ্য, তা বোঝা গেলেও, বিজেপি এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, মধ্যবিত্তের দিকে। এমন প্রচার করছেন, যাতে মনে হচ্ছে, মধ্যবিত্ত এবং একটু উচ্চ মধ্যবিত্তের থেকে টাকা, সম্পত্তি এবং সোনাদানা যেন কংগ্রেস কেড়ে নিতে চাইছে। শুধু তাই নয়, কেড়ে নিয়ে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াটাই যেন কংগ্রেসের উদ্দেশ্য। যে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল, ধনী এবং অতিধনীদের সম্পত্তির পূণর্বন্টন করে কী করে সার্বজনিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, বাসস্থান ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করা যায়, তার বদলে আলোচনা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে কংগ্রেস হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে, মুসলমানদের, যাঁদের বেশী সন্তান, তাঁদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। এমন একটা ধারণা তৈরী করার চেষ্টা হচ্ছে, যে গত দশ বছরে যেন মধ্যবিত্তের সঞ্চয় বিশালাকারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কংগ্রেস এবং তাঁদের সহযোগী দলেরা যদি ক্ষমতায় আসে সেই সঞ্চয়ে টান পড়বে, জমিয়ে রাখা সোনার গয়না অবধি কেড়ে নেওয়া হবে।
অথচ তথ্য কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথা বলে। কিছুদিন আগে কলকাতায় একটি সভায় বক্তব্য রাখতে এসে অর্থনীতিবিদ পারাকালা প্রভাকর বলছিলেন, গত দশ বছরে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় কিন্তু শুধু কমেছে এমনটা নয়, তাঁদের দেনা অর্থাৎ গার্হস্থ্য ঋণ বেড়েছে। এই তথ্য কিন্তু শুধু তিনি বলছেন এমনটা নয়, অর্থনৈতিক নানান যে সমীক্ষা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে তাতেও কিন্তু একই তথ্য উঠে এসেছে। যতই প্রধানমন্ত্রী বলুন না কেন, কংগ্রেস মধ্যবিত্তদের জমানো সোনা এবং টাকা মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে, যতই টাকা পয়সা দিয়ে গালগোটিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা হোক না কেন, গত দশ বছরে, মানুষ কিন্তু অর্থনৈতিক বাধ্যবাধ্যকতার কারণে সবচেয়ে বেশী ঋণ নিয়েছেন সোনা বন্ধক রেখে। যদি তা না হতো, মুথুট ফাইন্যান্স, মনপ্পুরম গোল্ড লোন ইত্যাদি সংস্থারা এত দৃশ্যমাণ হতো না এবং তাঁদের বিজ্ঞাপণে অমিতাভ বচ্চন সহ অন্যান্যদের নেওয়া হতো না। আগেও যে বন্ধকী কারবার ছিল না এমনটা নয়, শহর থেকে মফস্বল এবং গ্রামে গঞ্জেও এই সুদখোর বন্ধকীদের দেখা যেত। ছোট ছোট সোনার দোকানের ব্যবসায়ীরা এই কাজটাই করতেন। কিন্তু তা ধীরে ধীরে কমে আসছিল, কিন্তু গত দশ বছরে, তা শুধু বাড়েনি, বরঞ্চ অনেক বেশী প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, শুধুমাত্র ২০২৩- ২৪ সালেই সোনা বন্ধক রেখে এক লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় এই ঋণের পরিমাণ প্রায় পাঁচ গুণ বেশী। এত দ্রুতগতিতে এই ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি যথেষ্টই আশঙ্কাজনক বলে রিজার্ভব্যাঙ্ক জানিয়েছে।
নোটবন্দী থেকে জিএসটি এই প্রতিটি পদক্ষেপ যে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে, তা আজকে আর নতুন করে বোধহয় কাউকে বলে দিতে হবে না, কিন্তু একটি পরিবার যখন তাঁদের শেষ সঞ্চয় বাড়ির গয়না বিক্রি বা বন্ধক রাখতে বাধ্য হয় এবং সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে বাধ্য হয়, তখন বোঝা যায় অবস্থা যথেষ্ট বেহাল। মোট ব্যক্তিগত ঋণের মধ্যে ২০১৯ সালে এই সোনা বন্ধক দিয়ে ঋণের পরিমাণ ছিল এক শতাংশ। কোভিডের সময়ে সেই ঋণ বেড়ে হয় ২.৫ শতাংশ। তার পরের বছরে তা কমে ২ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও এই ঋণের পরিমাণ ২ শতাংশের নীচে নামেনি। অর্থাৎ নোটবন্দী থেকে যে অর্থনীতির নিম্নগামী যাত্রা শুরু হয়েছে, তা ২০২৪ সালে এসে এতোটুকু কমেনি বই বেড়েছে। অর্থাৎ মোদী এবং তাঁর চেলা চামুন্ডারা যতই বলুক ভারত আগামী পাঁচ বছরে, বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসবে, দেশের অর্থনীতি পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোনও সম্পর্কনেই। দেশের মানুষ রোজদিন অর্থনৈতিকভাবে মারা যাচ্ছেন বা তা থেকে বাঁচার জন্য ঋণের জালে জর্জরিত হচ্ছেন। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার সমান কত টাকা, বা সেই সংখ্যায় কতগুলো শূন্য থাকে, তা বোঝার মতো ক্ষমতা কিন্তু সাধারণ মানুষের নেই।
এর সঙ্গে যদি সোনা কেনার প্রবণতাকে যুক্ত করে দেখা যায়, তাহলে কি সেক্ষেত্রেও বিরাট কিছু উলম্ফন ঘটেছে? সেই দিক থেকে দেখলেও কি বড় কোনও পরিবর্তন দেখা গেছে? তথ্য কিন্তু তা বলছে না। একদিকে সোনার দাম বেড়েছে, অন্যদিকে মানুষের আয় কমেছে, ফলত এক দশক আগেও মানুষজন যেভাবে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সোনা কিনে রাখতেন, তা কি দেখা যাচ্ছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর, এককথায়, না। উল্টে দেখা যাচ্ছে, সোনা আমদানিও গত পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ শতাংশ কমেছে। অনেকে বলতে পারেন, আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। ভারতের বহু মধ্যবিত্ত মানুষের আয় গত দশ বছরে এতোটাই কমেছে, যে তাঁরা সোনা কেনার কথা আর ভাবতেই পারছেন না। যতই ধনতেরাসের মতো উৎসব আসুক না কেন, মানুষ সোনা কেনার মতো উদবৃত্ত আয় করছেন নাবা সঞ্চয় করতে পারছেন না এটাই বাস্তব তথ্য। নরেন্দ্র মোদী তাঁর নির্বাচনী ভাষণ থেকে যতই তাঁর পূর্বসূরী প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করুন না কেন, যতই নির্বাচন কমিশনের আচরণ বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রচার করুন না কেন, যতই মধ্যবিত্তদের মধ্যে ভয় সঞ্চার করার চেষ্টা করুন না কেন, যে তাঁদের পরিবারের সোনার গয়না এমনকি মহিলাদের বিবাহের চিহ্ন মঙ্গলসূত্র কংগ্রেস কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিলি করে দেবে, সত্যিটা কিন্তু এটাই ভারতীয়রা এই দশ বছরে সবচেয়ে বেশী সোনা বিক্রি বা বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছে। যত জোরেই প্রচার করা হোক না কেন, শাক দিয়ে কিন্তু আর মাছ ঢাকা যাচ্ছে না। মানুষ কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে অর্থনৈতিকভাবে খুব ভালো নেই, আর সেই ভালো না থাকার বিষয়টা আর কেউ না বুঝুক, নরেন্দ্র মোদী বিলক্ষণ বোঝেন। বোঝেন বলেই, তিনি ভীত এবং সন্ত্রস্ত এবং সেইজন্যেই তিনি সারাক্ষণ হিন্দু মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতি করছেন কারণ তিনি এটা জানেন, মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং তাঁর দেওয়া ভাঁওতাগুলো বুঝতে শুরু করে, তাহলে সামনের দিন ভয়ঙ্কর। সেইজন্যেই তিনি ইদানিং আর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ বলছেন না। তাঁর ন্যারেটিভ এখন সম্পুর্ণমেরুকরণের ন্যারেটিভ, কারণ তিনি জানেন। জিততে হলে তাঁকে হিন্দুদের ভোটেই জিততে হবে। কিন্তু শেষ প্রশ্নটা থেকেই যায়, সমস্ত হিন্দুরা, যাঁরা বাধ্য হয়ে তাঁদের পরিবারের শেষ সম্বল বিক্রি বা বন্ধক দিয়েছেন, তাঁরা সবাই নরেন্দ্র মোদীর আজকের কথাগুলোকে বিশ্বাস করছেন তো?
- সুমন সেনগুপ্ত