কথায় আছে, “রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ”। প্রধানমন্ত্রী যখন সাজিয়ে গুছিয়ে হয়কে নয়, আর নয়কে হয় করে চলেছেন রোজ, তখন তাঁর অর্থনীতিবিদ পারিষদরা যে সেসব মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গবেষণাপত্র পেশ করবেন তাতে আশ্চর্যের কী আছে? অতি সম্প্রতি প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পর্ষদের ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অংশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, যা নিয়ে বিজেপি-আরএসএস হৈ-চৈ লাগিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেছে দেখেছ, ১৯৫০ থেকে ২০১৫, এই ৬৫ বছরে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ, আর হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে ৮ শতাংশ। যদিও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভারতের জনসংখ্যায় হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত হ্রাসের হার ৭.৮২ শতাংশ (৮৪.৬৮ শতাংশ থেকে কমে ৭৮.০৬ শতাংশ হওয়া যা মূলত ৬.৬২ শতাংশ, কিন্তু অঙ্কের আর একটু জটিল হিসেবে তা (৮৪.৬৮ - ৭৮.০৬)/৮৪.৬৮ = ৭.৮২ শতাংশ)। মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধির হার ৪৩.১৫ শতাংশ (৯.৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪.০৯ শতাংশ হওয়া যা মূলত ৪.২৫ শতাংশ, কিন্তু অঙ্কের আর একটু জটিল হিসেবে তা (১৪.০৯ - ৯.৮৪)/৯.৮৪ = ৪৩.১৫ শতাংশ)।
উপরের ওই জটিল হিসেব কেউ বুঝতে চাইবেন বলে মনে হয় না। ফলে মোদীজি-শাহজি-যোগীজি-রাজনাথজি-শুভেন্দুজি-সুকান্তজি (তিনি নাকি আবার পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক) স্বভাবসিদ্ধ ঢং’এ মিথ্যা বলে যাবেন যে দেখেছ, হিন্দু জনসংখ্যা কমছে, মুসলমান জনসংখ্যা বাড়ছে। আদতে কী হচ্ছে, হয়েছে? মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত অবশ্যই বেড়েছে। তবে মোট হিন্দু জনসংখ্যা ১৯৫১ সালের জনগণনার সময়ে ছিল ৩০.৩৭ কোটি, ২০১১ সালে তা হয়েছে ৯৬.৬৩ কোটি। অর্থাৎ মোট বেড়েছে ৬৬.২৬ কোটি। সমসময়ে মুসলিম জনসংখ্যা ৩.৫৪ কোটি থেকে ১৩.৬৯ কোটি বেড়ে ১৭.২৩ কোটি হয়েছে। ফলে গড়ে ৫ জন হিন্দু বাড়লে ১ জন মুসলিম বেড়েছে।
কিন্তু পরিসংখ্যানকে এভাবে দেখবে কে, যেখানে শাসক দলের প্রধান, দেশের প্রধানমন্ত্রী মুসলিমদের নিকৃষ্ট দেখানোর জন্য রোজ বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং তাঁর সাগরেদরা যথোচিত সঙ্গত করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার (সার্ক) ৯টি দেশ নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করেছেন। সেখানে ওই ৬৫ বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাচরণকারীদের মোট জনসংখ্যায় অনুপাতের শতকরা বৃদ্ধি বা হ্রাস (-) দেখানো হয়েছে। যেসব দেশে ওই অনুপাতের হ্রাস বেশি সেখানে সংখ্যালঘুদের ওই অনুপাতের বৃদ্ধি অবশ্যই বেশি। উপদেষ্টাদের (অবশ্যই তাঁরা জ্ঞানীগুণী বিদ্বজ্জন) মতে যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাচরণকারীদের মোট জনসংখ্যায় অনুপাতের শতকরা হ্রাস যত বেশি সেখানে সংখ্যালঘুরা ভালো আছে। তার ফলেই সংখ্যালঘুদের ওই অনুপাতের বৃদ্ধি ঘটেছে। জনসংখ্যার অনুপাতের বৃদ্ধির এই চমকপ্রদ ব্যাখ্যা অবশ্যই সঙ্ঘী বুদ্ধিজীবী সুলভ। এই মোদীর উপদেষ্টা বুদ্ধিজীবীদের দেখে পুরন্দর ভাটের সেই পদ্য মনে পড়ছে, “কী নির্জীব কী নির্জীব নির্ঘাত ওটা বুদ্ধিজীব!”
ওই ব্যাখ্যায় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধধর্মের দেশ মায়ানমার তাদের সংখ্যালঘুদের সর্বোত্তম রেখেছে কারণ বৌদ্ধধর্মাচরণকারীদের অনুপাত হ্রাস সেখানে সর্বাধিক। ওই উপদেষ্টারা মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপরে অত্যাচারের ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন কি? আরো বৃহৎ সমস্যা হল, তেমনটা যখন ঘটছে বিজেপির বহুল প্রচারিত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের গল্পটার কী হবে? একই মানদন্ডে আফগানিস্তানে সংখ্যাগুরুবাদ প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ সেখানে সংখ্যাগুরু ধর্মাবলম্বীদের অনুপাত বৃদ্ধির হার নগণ্য। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তেমনটাই বলা চলে। ওই একই যুক্তিতে ভূটান, যেখানে ধর্মীয় বিভাজনের তেমন কোনো উদাহরণ নেই সেখানেও সংখ্যাগুরুবাদ বিপজ্জনক স্তরে রয়েছে। কারণ তালিকা অনুসারে ভূটানে ওই অনুপাত বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ। এমন চমৎকার বিশ্লেষণ ওই উপদেষ্টাদের যুক্তি অনুসরণ করলে পাওয়া যায়। ওনারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ভারতে সংখ্যাগুরুবাদ নেই, সেটা অবশ্য প্রকাশ্য উদ্দেশ্য। তবে যে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তা করতে চেয়েছেন তা হাস্যকর সিদ্ধান্তসমূহে পৌঁছে দিচ্ছে।
তবে ওটা সামনের দরজার উদ্দেশ্য হলেও ভিতরের ঘরে উঁকি দিলেই ভিন্ন উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। নির্বাচন চলাকালীন হঠাৎ জনসংখ্যার অনুপাত নিয়ে এত আগ্রহ কেন হল উপদেষ্টাদের? দেশের মুদ্রাস্ফীতি, বৈষম্য, কর্মহীনতা ইত্যাদি সমস্যাগুলির সমাধান করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দেওয়ার কাজটা কি চলে গেছে, নাকি সেগুলি অত গুরুত্বের নয়? তাঁদের কি অজানা যে, যে ধর্মাবলম্বীদের অর্থনৈতিক অবস্থা যত সঙ্গীন তাদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে কম হারে হ্রাস পায়? ওই যে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত বাড়ছে কারণ মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমলেও তা হিন্দু জনসংখ্যার কর্মহ্রাসমান বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম কেন না, মুসলিমদের অর্থনৈতিক অবস্থা হিন্দুদের তুলনায় বেশি সঙ্গীন। ফলে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যার অনুপাতের পরিবর্তনের ধনাত্মক উচ্চহার আসলে তাঁদের খারাপ অবস্থার প্রতিফলন।
১৯৫০-২০১৫: সার্ক দেশগুলির সংখ্যাগুরু ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যার অনুপাতের পরিবর্তন
অপরদিকে, উপদেষ্টাদের এই প্রতিবেদন মনে হয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের অভিপ্রেত অস্ত্র তুলে দেওয়ার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। তারা ওখান থেকে উদ্দিষ্ট তথ্যটিকে সংগ্রহ করেছেন, অবশ্যই অসত্য মোড়কে জড়িয়ে। তারা প্রচার করতে শুরু করেছে, দেখেছ মুসলমান জনসংখ্যা ৪৩.১৫ শতাংশ বেড়েছে, হিন্দুদের যেখানে ৭.৮২ শতাংশ কমেছে। বলতে থাকছে, এভাবে চললে ভারতে হিন্দুরা অচিরেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা কি জানেন না যে, কোনো দেশের কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা অপর কোনো ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যাকের টপকাবে কিনা, বা টপকালেও কত দ্রুত টপকাবে তা নির্ভর করে মহিলাদের সামগ্রিক গর্ভধারণের হার ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেট’এর উপরে। এদেশে জনসংখ্যা বাড়লেও টিএফআর ক্রমাগত কমছে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ‘এনএফএইচএস’র প্রতিবেদন থেকে তা একদম পরিস্কার।
বিভিন্ন জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী মহিলাদের সামগ্রিক গর্ভধারণের হার(টিএফআর)
উপরের তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীদের টিএফআর ক্রমাগত কমছে। গত প্রায় তিন দশকে তা কমছে। মুসলমানদের কমার হার (৪৬.৫ শতাংশ) হিন্দুদের কমার হারের (৪১.২ শতাংশ) থেকে বেশি। এমনকি সাম্প্রতিক দুটি সমীক্ষার, এনএফএইচএস৪ (২০১৫-১৬) ও এনএফএইচএস৫ (২০১৯-২১), ক্ষেত্রেও মুসলমানদের কমার হার (৯.৯ শতাংশ) হিন্দুদের কমার হারের (৮.৯ শতাংশ) থেকে বেশি। এমনটা যদি চলতে থাকে অচিরেই দুটি হার সমস্তরে পৌঁছে যাবে।
তবে যেদিকে উপদেষ্টাদের দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল যে, টিএফআর রিপ্লেসমেন্ট লেভেল বা প্রতিস্থাপন হারের, অর্থাৎ ২.১’র নীচে নেমে গেছে, যা জনবিন্যাসে ক্রমাগত তুলনামূলকভাবে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের অনুপাত বাড়াবে, সেই সমস্যাকে কী ভাবে সামলানো যাবে তার কথা ভাবা। কিন্তু কী আর করা যাবে, রাজার পারিষদদের রাজত্ব টেকানোর গুরুদায়িত্ব রয়েছে তারা দেশের স্থিতিশীলতার দায়িত্ব নেবেন কেন?