আড়াইশো তিনশো বছরের পুরনো ইতিহাস নিয়ে কেন দেশব্রতীর পাতায় লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে এই লেখা লিখতে হচ্ছে সেটা প্রথমে বলি। লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে অমৃতা রায়কে। তাঁর যে পরিচয়টি কেন্দ্রের শাসকদল তুলে ধরছে সেটি হল কৃষ্ণনগরের যে রাজ পরিবার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উত্তরাধিকারী, তিনি সেই পরিবারের সদস্যা। লোকসভার প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন করেন। তাঁদের মধ্যেকার ফোনের বার্তালাপ প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
পলাশীর যুদ্ধ ও তাতে কার কতটা ভূমিকা ছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে যেমন বিতর্ক আছে, তেমনি বিতর্ক আছে সিরাজদ্দৌল্লা’কে নিয়েও। সিরাজকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্বটিতে নানা সময়েই ইংরেজ বিরোধী লড়াইয়ের প্রথম নায়ক হিসেবে দেখা হয়েছে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু শেষবার ব্রিটিশের হাতে বন্দী হবার অব্যবহিত আগে যে রাজনৈতিক কর্মসূচিটি নেবার চেষ্টা করেছিলেন, তা ছিল সিরাজের ইংরেজ বিরোধী ভূমিকার গৌরবকে স্মরণ করে সিরাজ দিবস পালন করা। স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলিতে সিরাজকে নায়ক করে নাটক লিখেছিলেন শচীন সেনগুপ্ত মহাশয়, যে নাটকের অংশ এখন মাধ্যমিকের বাংলা ভাষা সাহিত্যের সিলেবাসে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয়। এছাড়া সিরাজকে ইতিবাচক দিক থেকে বিশ্লেষণ করে বই লিখেছিলেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ঠিক দশ বছর আগে, ১৮৭৫ সালে পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে যে বিরাট আখ্যানকাব্য লিখেছিলেন সেকালের বিশিষ্ট কবি নবীনচন্দ্র সেন, সেখানেও সিরাজকে দেশপ্রেমিক বীর হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন। তবে কাব্যকবিতা, নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের বাইরে সিরাজকে নিয়ে অষ্টাদশ শতকে বা পরে যে সব ইতিহাস বা বিবরণী লেখা হয়েছে, সেখানে তাঁকে অনেকসময়েই একজন নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, খামখেয়ালী উদ্ধত মানুষ ও শাসক হিসেবে দেখা হয়েছে। ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরী লিখেছেন, “প্রায় সমসাময়িক সব ফারসি ইতিহাসে এবং ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকদের লেখায় এটা পরিষ্কার যে তরুণ যুবক হিসেবে সিরাজদ্দৌল্লা এমনই নিষ্ঠুর, দুর্বিনীত, নির্দয় এবং দুশ্চরিত্র ছিলেন যে সবাই তাঁর নবাব হওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।” (পলাশির অজানা কাহিনী, সুশীল রায়, পৃ-১৯)
গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে শুরু করে পরের অর্ধশতকে সিরাজ ও পলাশীর ষড়যন্ত্র নিয়ে বেশ কিছু গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণাগুলিতে পলাশীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মূলত দু’ধরনের মত রয়েছে। একটি মত অনুসারে সিরাজের প্রতি বিরূপ হয়ে রাজদরবারের অভিজাতরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সামিল হন। ইংরেজদের তাতে তাঁরা যুক্ত করে নেন। ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের ‘পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ’ নামক বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থে আমরা এই মতটি পাই। অন্য মতটি মনে করে ইংরেজরাই ছিলেন পলাশীর ষড়যন্ত্রের মূল ক্রীড়নক। নানা পদ্ধতিতে সভাসদদের ক্ষোভকে নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা ব্যবহার করে নিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরী মহাশয়ের ‘পলাশির অজানা কাহিনী’ নামক বিখ্যাত বইতে এই মতটি আমরা দেখতে পাই। কাদের ভূমিকা এই ষড়যন্ত্রে প্রধান ছিল আর কাদের ছিল খানিকটা সাহায্যকারী অবস্থান — বর্তমান প্রেক্ষিতে ইতিহাসবিদদের মধ্যেকার সেই বিতর্কের বিচার আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা এই ষড়যন্ত্রের কুশীলবদের অন্যতম কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কী ভূমিকা কেন পালন করেছিলেন, সেটাই মূলত বুঝতে চাইবো।
কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে জন্মগ্রহণ করেন। সেটা ১৭১০ সাল। তাঁর জন্মের তিন বছর আগে দিল্লীর শেষ মহাপ্রতাপশালী মুঘল শাসক ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়েছে৷ বাংলার নবার তখন মুর্শিদকুলি খাঁ। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে মুর্শিদকুলি খাঁই বাংলার একচ্ছত্র শাসক। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী মুঘল বাদশাহদের তিনি নামমাত্র স্বীকৃতি দিয়ে কার্যত স্বাধীন বাদশাহের মতোই শাসন চালাতেন। ১৭২৭এ মারা যান মুর্শিদকুলি খাঁ। তাঁর জায়গায় সিংহাসনে কে বসবেন তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব বিবাদ তৈরি হয়। এই সময়েই ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপ রাজবংশের রাজা রঘুরাম রায়ের মৃত্যু হয়। পিতা রঘুরামের মৃত্যুর পর কৃষ্ণনগরের মহারাজার আসনে বসলেন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সুজাউদ্দিনের পুত্র সফররাজ খানকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু পুত্রের দাবিকে অস্বীকার করে মুর্শিদাবাদের দিকে সেনা অভিযান পরিচালনা করেন সুজাউদ্দিন এবং অবশেষে বাংলার নবাব হয়ে বসেন। তৎকালীন মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহকে বিপুল পরিমাণ নজরানা পাঠিয়ে তাঁর সমর্থন আদায় করে নেন। বারো বছর পর সুজাউদ্দিনের মৃত্যু হলে অবশেষে তাঁর পুত্র সফররাজ খাঁ বাংলার নবাব হন। ১৭৩৯ সালে সফররাজ খাঁ সিংহাসনে বসলেও এক বছরের বেশি সময় রাজত্ব চালাতে পারেননি। আলিবর্দি খাঁর বিরাট বাহিনী তাঁকে আক্রমণ করেন। গিরকার যুদ্ধে সফররাজ খাঁ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। বাংলার নবাব হন আলিবর্দি খাঁ।
আলিবর্দি খাঁর শাসনামলে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার বন্দী হন। সেটা ছিল ১৭৫৪ সাল। মারাঠা হানাদের সন্তুষ্ট করতে আলিবর্দি তাঁদের শুধু উড়িষ্যার অধিকারই ছেড়ে দেননি, বেশ কয়েক লক্ষ টাকা নজরানা দিতেও বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে কোষাগারের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে এবং সেই চাপের মোকাবিলা করতে জমিদার, মনসবদার, ভূস্বামীদের প্রদেয় করের পরিমাণ অনেকটা বাড়ানো হয়। বাড়তি কর প্রদানে অক্ষম হওয়াতে আলিবর্দি কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দী করেছিলেন বলে শোনা যায়। কিছুদিন পর কৃষ্ণচন্দ্র আলিবর্দির কারাগার থেকে মুক্তি পান। কিন্তু আলিবর্দির সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বসংঘাত সমাপ্ত হয়নি। আলিবর্দির পর তাঁর নাতি সিরাজদ্দৌল্লা ১৭৫৬ সালে সিংহাসনে বসেন। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে তাঁরও দ্বন্দ্বসংঘাত অব্যাহত ছিল।
ইতিহাসবিদরা অনেকেই সিরাজকে উদ্ধত ও অত্যাচারী বলেছেন। সিরাজ তাঁর রাজ্য ও রাজসভার শক্তিশালী নানা ব্যক্তি — যেমন ব্যাঙ্কার জগৎ শেঠ পরিবার, রাজবল্লভ, সেনাপতি মীরজাফর প্রমুখদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তাঁদের বিরাগভাজন হন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গেও তাঁর বিবাদ চরমে ওঠে। সিরাজের বিরোধীরা তাঁকে গদিচ্যুত করার জন্য নিজ নিজ স্বার্থকে সামনে রেখে একজোট হয়ে যান। অল্পবয়সী উদ্ধত নবাব সিরাজ এই জোটের মোকাবিলা করতে না পেরে পলাশীর যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত হন।
এবার আসা যাক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ইতিহাস প্রসঙ্গে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য বইটি লেখেন রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮০৫ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে। বইটির নাম ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’। এই বই লেখার মাত্র বাইশ বছর আগে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রয়াত হয়েছেন। ফলে সেকালের খ্যাতনামা ব্যক্তি কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনের তথ্যাবলী পেতে রাজীবলোচনের বিশেষ সমস্যা হয়নি।
রাজীবলোচনের উপরোক্ত বই থেকে আমরা জানতে পারি সিরাজের রাজদরবারের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন রাজা মহেন্দ্র। তাঁর কাছে বিভিন্ন দেশীয় রাজারা এসে নতুন নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সলতে পাকানো শুরু করেন। যাঁরা এই পরিকল্পনা শুরু করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বর্ধমানের রাজা, নবদ্বীপের রাজা, দিনাজপুরের রাজা, বিষ্ণুপুরের রাজা, মেদিনীপুরের রাজা প্রমুখ। (রাজীবলোচনের উক্ত বইয়ের পৃ-২৯ দ্রষ্টব্য।) মহারাজা মহেন্দ্র এই সমস্ত রাজাদের পক্ষ থেকে এরপর শলা পরামর্শ করেন সিরাজের রাজসভা তথা মুর্শিদাবাদের কিছু ক্ষমতাসীন ব্যক্তির সঙ্গে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণদাস, সিরাজের প্রধান সেনাপতি বর্ষীয়ান জাফর আলি খাঁ বা মীরজাফর, ধনকুবের জগৎ শেঠ প্রমুখ। রাজীবলোচন তাঁর বইতে লিখেছেন এই শলাপরামর্শ চলাকালীন জগৎ শেঠ বাকিদের প্রস্তাব দেন সিরাজ বিরোধী জোটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরামর্শ গ্রহণের (উক্ত গ্রন্থের পৃ-৩১ দ্রষ্টব্য)। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে দূত আসে এবং সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিরাজ বিরোধী মন্ত্রণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি কালীপ্রসাদ সিংহকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেন। কিছু আলাপ আলোচনার পর গুরুত্বপূর্ণ এই আলোচনাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁরা স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্রের সশরীরে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হওয়া জরুরি বলে মনে করেন। কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর প্রতিনিধি কালীপ্রসাদ মনে করেন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা’কে না জানিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের মুর্শিদাবাদে চলে আসাটা সন্দেহের জন্ম দিতে পারে। কৌশল অবলম্বন করে রাজা মহেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে কালীপ্রসাদ নবাব সিরাজের কাছে যান এবং কৃষ্ণচন্দ্রের মুর্শিদাবাদে এসে নবাবের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থণা করেন। এই অনুমতি প্রাপ্তিকে সামনে রেখেই কৌশলী ও সাবধানী কৃষ্ণচন্দ্র সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রে শান দিতে মুর্শিদাবাদে আসেন। (উক্ত গ্রন্থের পৃ-৩৪-৩৬ দ্রষ্টব্য।) সিরাজকে কীভাবে অপসারিত করা যায় সেই প্রসঙ্গে মন্ত্রণাসভায় কৃষ্ণচন্দ্র রায় কী প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই সম্পর্কে রাজীবলোচন লিখছেন, “রাজা (কৃষ্ণচন্দ্র রায়) কহিলেন বিলাত নিবাসী জাতিতে ইঙ্গরাজ কলিকাতায় কোঠী করিয়া আছেন। যদি তাঁহারা এদেশের রাজা হন তবে সকল মঙ্গল হইবে।” (উক্ত গ্রন্থের পৃ-৩৯ দ্রষ্টব্য।) এরপর এই ষড়যন্ত্রের অগ্রগতি কীভাবে হল, তার বিস্তারিত বর্ণনা রাজীবলোচনের বইতে আছে।
এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, না ইংরেজ পক্ষ না দেশীয় অভিজাতবর্গ — কেউই সে সময় মনে করেননি পলাশীর যুদ্ধ তথা সিরাজকে অপসারণের মধ্যে দিয়ে বাংলা বিদেশী শাসনের নিগড়ে বাঁধা পড়তে চলেছে। সেকালে মুঘল দরবারের রাজধানী দিল্লীতে ও বিভিন্ন সুবাতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ছিল প্রচলিত ঘটনা। সিরাজের দাদু আলিবর্দি নিজেই নবাব সফররাজ খাঁর বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রমূলক অভিযান চালিয়ে তাঁকে গদিচ্যুত ও হত্যা করে নিজে নবাব হয়ে বসেছিলেন। সিরাজের সিংহাসন আরোহণ পর্বেও পরিবারের মধ্যে থেকেই আসা ঘসেটি বেগমের চ্যালেঞ্জ তাঁকে সামলাতে হয়েছিল।
সাধারণ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের চেয়ে পলাশীর ঘটনাটি একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে ইতিহাসের পরবর্তী গতিস্রোতের জন্য। সেই স্রোত প্রথমে বাংলাকে এবং পরে গোটা ভারতকে প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির, পরে সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই উদ্ধত, দুর্বিনীত, খামখেয়ালী অত্যাচারী চরিত্র সত্ত্বেও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন সিরাজ, কেননা তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। একাধিকবার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তিনি বিবাদ ও যুদ্ধে জড়িয়েছেন, আর এটাই পরবর্তীকালে তাঁকে উপনিবেশ বিরোধী মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অন্যদিকে পলাশীর মুখ্য ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম হিসেবে মীরজাফরের নামটি বিশ্বাসঘাতক শব্দের প্রায় প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে বাংলায়। তবে জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ বা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্ররা একই ষড়যন্ত্রে সামিল থাকলেও খলনায়ক হিসেবে মীরজাফরের মতো আলোচিত ও ধীকৃত হননি। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের একজন সদস্যা কেন্দ্রের শাসক দলের তরফে প্রার্থী হয়েছেন বলে নির্বাচনের তপ্ত আবহাওয়ায় বিষয়টি এখন নতুন করে চর্চার মধ্যে এসেছে। বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায় এবং তাঁর দল এই অভিযোগটিকে হালকা করে দিতে চাইছেন। তাঁরা একদিকে বলছেন কৃষ্ণচন্দ্রের নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক অবদানগুলি বিবেচনা করতে। শাক্ত পদাবলীকার রামপ্রসাদ সেন এবং অন্নদামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তা তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এও মনে করিয়ে দিতে চাইছেন চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলন এবং বাংলার বিভিন্ন জায়গায় দুর্গাপুজো প্রসারের ক্ষেত্রে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। অন্যদিকে পলাশীর ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে বলছেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সহ অন্যান্য হিন্দু রাজারা মুসলমান শাসনের হাত থেকে হিন্দু বাঙালিকে বাঁচাতে এই ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের অবস্থানের সাফাই গাইতে গিয়ে যেভাবে সাম্প্রদায়িক তাস খেলেছেন বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায় ও তাঁর দল, মুসলমান নবাবের হাত থেকে হিন্দুকুলকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণচন্দ্রদের ষড়যন্ত্র সংগঠিত হয়েছিল বলে যে কথা তাঁরা প্রচার করছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা। ইতিহাসবিদরা প্রায় সকলেই বলেছেন যে পলাশীর ষড়যন্ত্রের পেছনে যে যে কারণই থাকুক না কেন, বিভিন্ন স্বার্থের দ্বন্দ্ব যে পরিমাণেই ক্রিয়াশীল থাকুক না কেন, হিন্দু মুসলিম প্রশ্ন একেবারেই কোনও বিবেচনাধীন বিষয় ছিল না। পলাশীর ষড়যন্ত্রকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণে হিন্দু মুসলিম বিরোধ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া একদিকে যেমন ইতিহাসবিকৃতি, তেমনি অন্যদিকে বিজেপির ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ও সমাজকে বিভাজনের ধারাবাহিক অপচেষ্টার আর এক চরম নিন্দনীয় প্রয়াস।
- সৌভিক ঘোষাল