কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার আগে নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রচারে যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তাঁর শাসনে বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি জনগণের, বিশেষভাবে যুব সম্প্রদায়ের কাজ পাওয়ার প্রত্যাশাকে উসকিয়ে তুলেছিল এবং লোকসভায় বিজেপির আসন সংখ্যাও উপচিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মোদীর দু’দশকের শাসনে কাজের পরিস্থিতি ঠিক কী রকম? প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে কি তিনি পেরেছেন? পরিসংখ্যানের প্রতি নিষ্ঠ হওয়াটা মোদী সরকারের ধাতে নেই এবং ভারত সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যানের ওপর আস্থা শুধু ভারতেই নয়, বিদেশের গবেষক ও বিশ্লেষকদের কাছেও তেমন ভরসাযোগ্য হয় না। মোদী সরকার ২০১৭ সালে কর্মে নিযুক্ত বেকারি সমীক্ষা তুলে দেয় এবং ২০১৮’র মার্চেও লেবার ব্যুরোর ত্রৈমাসিক কর্মোদ্যোগ সমীক্ষাকে পরিত্যাগ করে। অতএব, কর্মসংস্থান সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের লভ্যতা তেমন সহজ নয়। যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তার ওপর নির্ভর করেই বিষয়ের বিশ্লেষণে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
মোদী জমানায় বেকারির হার ২০১৭-১৮ বর্ষে পৌঁছায় ৬.১ শতাংশে যা ছিল ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর কোভিড১৯ অতিমারীর সময় ঐ হার গিয়ে দাঁড়ায় ২০.৮ শতাংশে। আর সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২-২৩ বর্ষে বেকারির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩.২ শতাংশে। কোন ক্ষেত্রে কীভাবে এত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হল যে ২০১৭-১৮’র অনুপাতে বেকারি অর্ধেক হয়ে গেল? আর কাজে যোগদানের হার যদি বেড়েই থাকে সেই কাজের গুণমান কী রকম? এ সম্পর্কে বিশ্লেষণে আমরা পরে আসব। তবে একটা কথা এখানে উল্লেখ্য যে, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির চালানো সমীক্ষা ও পরিসংখ্যানের ওপরই বেশি নির্ভর করেন।
মোদী সরকার ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ২০১৪ সালে নামায় ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও ২০২০ সালে শুরু করে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্প। কিন্তু উৎপাদকরা এই প্রকল্পগুলোয় তেমন সাড়া দেয়নি, ফলে প্রকল্পগুলো তেমন সচলও হয়নি। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৬ থেকে ২০২১’র মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান অর্ধেক হয়ে গেছে। পরিসংখ্যান থেকে এটাও প্রকাশ পেয়েছে যে কোভিড অতিমারী শুরু হওয়ার আগে থেকেই ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পেতে শুরু করে।
জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অফিস প্রদত্ত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, পরিকাঠামো ও বাড়ি-ঘর নির্মাণ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার ২০১১-১২ বর্ষে ছিল সমগ্রের ১০.৬ শতাংশ। সেই হারই ২০২২-২৩ বর্ষে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। এই ক্ষেত্রে কাজে যুক্ত আছেন ৭ কোটিরও বেশি মানুষ, এবং ২০৩০ সাল নাগাদ সেই সংখ্যাটাই বেড়ে ১০ কোটি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে, নির্মাণ ক্ষেত্রে কর্মীর সংখ্যা বেড়ে চললেও এখানে কাজের গুণগত মান উৎকৃষ্ট নয়, অর্থাৎ, কাজ থেকে আয় তেমন সম্মানজনক নয়। এই ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে চালানো সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, মোট শ্রমিকদের ৮৩ শতাংশই ঠিকা কাজ করেন, আর ১১ শতাংশ রয়েছেন স্বনিযুক্ত রূপে।
কৃষিক্ষেত্র থেকে কর্মরতদের একটা অংশের শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গমনই অর্থনীতির বিকাশের সাধারণ নিয়ম। ভারতে সেই ধারাকেই প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমশক্তির হার ২০০৪-০৫ বর্ষে যেখানে ছিল ৫৮.৫ শতাংশ, সেটাই কমে ২০১১-১২ বর্ষে আসে ৪৮.৯ শতাংশে। মোদী জমানায় সেটা আরও কমে ২০১৮-১৯ বর্ষে দাঁড়ায় ৪২.৫ শতাংশে। কিন্তু কোভিড অতিমারির সময়কালে এক বিপরীত ধারার পরিযান ঘটতে থাকে। ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণক্ষেত্রে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঐ সমস্ত ক্ষেত্রে কর্মরতরা গ্রামে ফিরে কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত হন। কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিতদের হার আবার বেড়ে ২০২১-২২ বর্ষে দাঁড়ায় ৪৫.৫ শতাংশে। আর কৃষিক্ষেত্র এমনিতেই সংকটজনক অবস্থায় এবং সেখানে নিযুক্তি থেকে আয় যে একেবারেই সন্তোষজনক নয় তা বলাই বাহুল্য।
মোদী জমানায় শ্রমজীবীদের আয় বৃদ্ধি একেবারেই নগন্য। মূল্যস্ফীতিকে হিসাবে নিলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ বর্ষে মজুরি বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম। বিজেপি যে দুটো ক্ষেত্রের ওপর জোর দিয়েছিল, সেই কৃষি ও নির্মাণক্ষেত্রে মজুরি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ০.৯ ও ০.২ শতাংশ। কিছু ক্ষেত্রে বৃদ্ধি একেবারেই হয়নি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বৃদ্ধি নেতিবাচকও হয়েছে। ২০২২-২৩’র অর্থনৈতিক সমীক্ষায় সরকারও স্বীকার করেছে যে, ঐ বছরে গ্রামাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধির হার নেতিবাচকই ছিল।
সবশেষে আসা যাক বেকারির হার কমা নিয়ে সরকারের দাবি প্রসঙ্গে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি আক্ষরিক অর্থেই অস্তিত্বহীন। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি দূরে থাক, লক্ষ লক্ষ যে সমস্ত পদ শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে সেগুলোও পূরণ হয় না। কোভিড অতিমারী ছাড়াও নোটবন্দি এবং তেমন বিবেচনা ছাড়াই অপ্রত্যক্ষ কর জিএসটি’র সূচনা অর্থনীতিতে প্রবল ধাক্কা দেয় যে ধাক্কা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তাহলে কি বেসরকারি ক্ষেত্রের বিপুল বাড়বাড়ন্ত ঘটে সেখানে প্রচুর নিযুক্তির মধ্যে দিয়েই বেকারির হ্রাস হয়েছে? কিন্তু ওপরে আমরা দেখেছি, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে বৃদ্ধি তেমন ঘটেনি, আর নির্মাণ ক্ষেত্রে কিছু বৃদ্ধি হলেও তার সম্ভাবনা তেমন জোরালো নয়। সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অতএব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। তবুও বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রমের বাজারে যোগদানের হার যদি কিছু বেড়ে থাকে তবে তার মূলে রয়েছে স্বনিযুক্তিতে যথেষ্ট বৃদ্ধি। বিশেষজ্ঞরা কর্মসংস্থানের তিনটে শ্রেণীকে নির্দিষ্ট করে থাকেন — নিয়মিত মজুরি বা বেতনের কাজ, ঠিকা কাজ এবং স্বনিযুক্তি। নিয়মিত বেতনের কাজ ও ঠিকা কাজ কমেছে, বা বাড়লেও তার হার সামান্য। স্বনিযুক্তিকে ভাগ করা যায় তিনটে ধারায় — যাঁরা নিজেদের চালানো ব্যবসায় শ্রমিক নিয়োগ করেন; যাঁরা নিজেদের ব্যবসা নিজেরাই চালান; আর যাঁরা অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমে নিযুক্ত হন। এরমধ্যে শ্রমিক নিয়োগকারী ব্যবসার বৃদ্ধি ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২’র মধ্যে ১ শতাংশেরও কম, ৩.৭৮ শতাংশ থেকে ৪.৫৭ শতাংশ। আর বিনা বেতনে পারিবারিক শ্রমে নিযুক্তির হার এই সময়কালে বেড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ — ২৬ শতাংশ থেকে ৩১.৪ শতাংশ। বেকারির হার যদি কম দেখায় তবে তা এই ধারাটির বৃদ্ধির জন্যই। আনন্দবাজার পত্রিকায় এ’বছরের ১ মার্চ অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক তাঁর ‘কাজের বাজারে অন্ধকার’ শিরোনামের উত্তরসম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেছেন, “যার জোরে... বেকারত্বের হার কমেছে, তা হল মূলত অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমে যোগদানের প্রবণতা বৃদ্ধি; ...যদিও কর্মসংস্থানের সার্বিক হার বেড়েছে, সেই কাজ তৈরি হয়েছে পারিবারিক অবৈতনিক শ্রমিক হিসাবে — যেমন, পরিবারের মালিকানাধীন মুদিখানায় কর্মী হিসাবে। যাঁরা স্বনিযুক্ত হিসাবে নিজেই কাজ করেন, পারিবারিক সদস্য ছাড়া অন্য কোনও শ্রমিক নিয়োগ করেন না —
যেমন চা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি — দেশের কর্মরত জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাতই সর্বাধিক, প্রায় ৩৫ শতাংশ।”
মোদী ভারতের ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’, অর্থাৎ, জনসংখ্যায় তরুণদের প্রাধান্য জনিত সুবিধা লাভের কথা বলে থাকেন। কিন্তু ভারতের যত বেকার তার ৮৩ শতাংশই যুবক। অতএব, যুবকরা যেমন কর্মসংস্থান ও আয় থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকছে, সেরকমই ভারতীয় অর্থনীতির তারুণ্যের সুবিধা লাভও কল্পকথা বলেই পরিগণিত হচ্ছে। ভারতে মোট কর্মসংস্থানের ৮২ শতাংশই হল অসংগঠিত ক্ষেত্রে, আর ঠিকা ক্ষেত্রে কাজ করা ৬০ শতাংশ শ্রমিকই ন্যূনতম মজুরি পান না। মোদী সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরণ গত ২৭ মার্চ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ও মানব উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা ‘ভারতের কর্মসংস্থান রিপোর্ট ২০২৪: যুব কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও কর্মদক্ষতা’ বিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, সরকার বেকারি সমস্যার সমাধান করবে তা প্রত্যাশা করা উচিত নয়। সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, জনগণের এই প্রত্যাশা তবে কি অমূলক? বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মোদীর প্রতিশ্রুতি তবে কি ‘জুমলাই’ ছিল? সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যানও সেই গোত্রেরই বলে ধরে নিলে তাকে কি মনগড়া বলা সঙ্গত হবে? দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার এ বছরের ৩০ মার্চ সংখ্যায় ‘বেকারি ব্যুরো’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে যথার্থভাবেই বলা হয়েছে, “জয়োল্লাসময় বুকনি, বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টের অলভ্যতা এবং অ-নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান ভারতে কর্মসংস্থানের ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আড়াল করতে পারবে না।”
- জয়দীপ মিত্র