মোদীর ভারতে কুৎসিত অসাম্য, প্রকট দারিদ্র
ugly-inequality

ট্রেনের ইঞ্জিনটা দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু পেছন দিকের কামরাগুলি অতি দ্রুত বেগে এগোতে পারছে না। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক এই উপমা সামনে এনে হায়দ্রাবাদের এক আলোচনাসভায় বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, বহু ঢাকঢোল পেটানো ভারতীয় অর্থব্যবস্থার যে ফানুস ওড়ানো হচ্ছে, তা ঠিক নয়। দেশের এক বৃহৎ অংশের মানুষ, ওই ট্রেনের কামরার মতো দ্রুত বেগে সামনের দিকে এগোতে পারছেন না। কারণ প্রকট আর্থিক অসাম্য দেশের অর্থব্যবস্থার এক অন্যতম অসুখ।

সম্প্রতি মোদীর আমলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে প্রথম সারির বেশ কিছু অর্থশাস্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন। আইএমএফ’এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জি-২০’র কুড়িটি দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারত সবচেয়ে নীচে! মানবোন্নয়ন সূচকের নিরিখে ভারত ২০টি দেশের মধ্যে ২০তম স্থানে। শিশুমৃত্যুর হারে ভারতের অবস্থা সামান্য ভালো — ১৯তম স্থানে।

স্বঘোষিত ‘বিশ্বগুরু’র দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কই পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে ভারতে যত কম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, ২০০৭-০৮’র পর তা কখনও এত কম হয়নি। জিডিপি’র অনুপাতে এই বিনিয়োগের পরিমাণও ২০০৫-০৬ সালের পর সর্বনিম্ন। এমনকি মোদীর আমলে বেসরকারি বিনিয়োগও ক্রমশই নীচের দিকে গড়িয়ে পড়েছে। মোদী ক্ষমতায় আসার আগে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের গড় হার ছিল ৩৩.৪ শতাংশ। কিন্তু মোদী আসার পর তা দাঁড়ায় ২৮.৯ শতাংশ, আর তারপর থেকে এমন একটা বছরও দেখানো যাবে না যেখানে এই বিনিযোগের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের এই অত্যন্ত মন্থর গতি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের উপরও প্রভাব ফেলেছে, তারাও এদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। দেশের গ্রামীণ বাজারে হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের মতো বৃহদায়তন সংস্থার ষাট শতাংশ পণ্য বিক্রি হোত। গত দশ বছর যাবত এই বৃহৎ বাজারে থমকে রয়েছে। সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্টের মতো পণ্যগুলোর নিশ্চিত আভ্যন্তরীণ বাজার সংকটে। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ পর্যায়ে সমস্ত ধরনের মজুরি থমকে রয়েছে, বা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। ক্ষয়িষ্ণু ক্রয় ক্ষমতা ভোগব্যয়ে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা মোদী সরকারের পা-চাটা অর্থনীতিবিদেরা স্বীকার করেন না।

গোটা দুনিয়ায় ভারতের মতো আর কোনো উন্নয়নশীল দেশে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ স্বরোজগারের সাথে যুক্ত নয়। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ পর্যায়ে পারিশ্রমিকবিহীন কাজে (আনপেইড লেবার) নিয়োজিত হওয়ার সংখ্যা ৪ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯.৫ কোটিতে পৌঁছেছে। আর, এই অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া পারিশ্রমিকবিহীন পেশার সাথে যুক্ত সিংহভাগই হলেন নারী শ্রমিক। সরকারি নথিতে এই বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকদের ‘কর্মরত’ হিসাবেই দেখানো হয় যা বিরাট মাপের এক ভাওতা। আইএলও’র পরিভাষায় সেই পেশাগুলোই ‘কাজ’ (এমপ্লয়মেন্ট) হিসাবে স্বীকৃত যেখানে বেতন/মজুরি প্রদানের বন্দোবস্ত রয়েছে।

কিছুদিন আগে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দপ্তর ২০২২-২৩’র জন্য যে পরিবারভিত্তিক ভোগব্যয় সমীক্ষা প্রকাশ করল, তাতেই দেখা যাচ্ছে দেশের গরিবরা দৈনিক খরচ করেন মাত্র ৪৬ টাকা!

বিভিন্ন সমীক্ষায় আরও প্রকাশ, দেশে আর্থিক অসাম্য ঔপনিবেশিক আমলকেও ছাপিয়ে গেছে, তরুণ প্রজন্মের বেকারত্বের মাপকাঠিতে ভারত সিরিয়া, আর্মেনিয়া, লেবানন, ইয়েমেন বা ইরানের মতো গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ বিধ্বস্ত দেশগুলির সঙ্গে এক সারিতে রয়েছে।

সমস্ত ক্ষেত্র মোদী আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত। আইন-সংবিধান, বহু বছর ধরে সযত্নে লালিত ভারতীয়ত্ব, তার বহুত্ববাদ আজ বিপর্যয়ের কিনারায়।

মোদীর এই অপশাসন, প্রগতি-বিরোধী, গণতন্ত্র রোধকারী জমানাকে আসন্ন নির্বাচনে পরাস্ত করাটাই আজ ভারতবাসীর কেন্দ্রীয় কর্তব্য।

খণ্ড-31
সংখ্যা-12