দেরীতে হলেও সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনী বন্ড বাতিল এবং অর্থদাতা ও গ্রহীতাদের নাম প্রকাশ্যে আনার ঘোষণা মোদী সরকারকে অস্বস্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ উকিলরা ক্রমাগত মুখ্য বিচারপতিকে হেনস্থা করে বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই হেনস্থাকার্যের পিছনে নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা অপরিসীম কারণ তিনি শুধুমাত্র এই সন্দেহজনক উকিলগোষ্ঠীর আবেদনপত্রটি প্রচারই করছেন না, সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী বন্ড, যেটিকে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেটির ক্রমাগত সাফাইও গেয়ে চলেছেন। যে সরকার সুপ্রিম কোর্টে বলে যে, দেশের জনগণের কোনো অধিকার নেই নির্বাচনী বন্ড নিয়ে প্রশ্ন করার, যে পার্টি নির্বাচন কমিশনকে জানায় যে, নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত কোনো তথ্যই তাদের কাছে নেই, তারাই এখন কর্পোরেট অনুদানের স্বচ্ছতার প্রশ্নে নির্বাচনী বন্ডের গুণগান গাইছে।
যখন স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসক হিসেবে মোদী সরকারের নাম উঠে আসছে, সেই সময় বিজেপি ক্ষমতার ভাষায় উন্মত্ত হয়ে বিরোধী জোটকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। নির্বাচনী বন্ডের এই দুর্নীতি এতটাই জটিল যে সরকার ভেবেছিল জনগণের কাছে এই সত্যি কখনও প্রকাশ পাবে না। আমরা এখন জানছি যে বেশ কিছু সংস্থা যেমন এই স্কিম ব্যবহার করে ঘুষ দিয়ে সরকারি চুক্তি আদায় করেছে, আবার তেমনই বেশ কিছু সংস্থা আইনের হাত থেকে বাঁচতে পার্টিকে অনুদান দিয়েছে। বেশ কিছু সংস্থা আবার সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে বিরোধী দলগুলিকে এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে ফেলার চক্রান্ত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে হওয়া দিল্লী লিকার পলিসি কেসে আমরা এই ঘটনার নিদর্শন দেখেছি যেখানে ইডি এবং সিবিআই-কে একযোগে ব্যবহার করা হয়েছে একটি বিরোধী দলকে আক্রমণ করার জন্য।
আজকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সহ আম আদমি পার্টির সামনের সারির নেতারা যখন জেলে বন্দী তখনই সেই দিল্লী লিকার পলিসি কেসেরই অন্য দুই অভিযুক্ত পি সারাথ রেড্ডি এবং রাঘব মাগুন্তা রেড্ডি কিন্তু জামিনে মুক্ত। দ্বিতীয়জন আবার তার বাবা মাগুন্তা শ্রীনিভাসুলু রেড্ডির হয়ে, যিনি এনডিএ’র অন্তর্গত টিডিপি’র পক্ষে ওঙ্গল কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছেন, দিব্যি প্রচার চালাচ্ছেন। প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্টকে হাতিয়ার করে ইডি ক্রমাগত বিরোধী দলের নেতাদের জামিন অযোগ্য ধারায় জেলে বন্দী করার চেষ্টা করছে। দিল্লী সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন গত দু’বছর ধরে জেলে বন্দী, শিক্ষামন্ত্রী মনীশ শিশোদিয়া গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে আটক রয়েছেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির ঘটনায় অবশ্য গোটা দেশজুড়ে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে এবং বিদেশেও মোদী সরকারের শাসনকালে ন্যায়ের অনুপস্থিতি নিয়ে তীব্র সমালোচনার সুর শোনা যাচ্ছে। আম আদমি পার্টির রাজ্যসভা সাংসদ সঞ্জয় সিং শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের জন্য জামিন পেয়েছেন এবং ইডিও সেই জামিনের রায়কে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায়নি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপির লড়াই যে আদতে প্রহসন তা আজ স্পষ্ট। হেমন্ত বিশ্বশর্মা, শুভেন্দু অধিকারী, অজিত পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল, নবীন জিন্দাল — এরা প্রত্যেকেই একসময় বিজেপির কাছে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে গণ্য হলেও আজকে বিজেপির সাথেই সসম্মানে কাজ করে চলেছেন। এমনকি এখন গোদি মিডিয়া পর্যন্ত এই প্রশ্নগুলি বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উদ্দ্যেশে করতে বাধ্য হচ্ছে। সম্প্রতি টাইমস নাউতে একটি সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নভীকা কুমারের সামনে অকপটে স্বীকার করেছেন যে, সমস্ত কালিমালিপ্ত নেতা মন্ত্রীরাই বিজেপির দরবারে স্বাগত। মধ্যপ্রদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা অবশ্য কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যুক্ত নেতাদের আবর্জনা হিসেবে ভূষিত করেছেন।
সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদীত ‘সিট’ (SIT) গঠনের দাবিও জোরালোভাবে উঠে আসছে। জাস্টিস বি ভি নাগারত্ন, যিনি বিমুদ্রাকরণ সম্পর্কিত সুপ্রিম কোর্টের ৪-১ রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, সম্প্রতি জানিয়েছেন বিমুদ্রকরণের মাধ্যমে কালো টাকা তেমনভাবে সাদা হয়ইনি। সমগ্র মুদ্রার ৮৬ শতাংশ ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করার মাধ্যমে বিমুদ্রিত এবং সেই অর্থের ৯৮ শতাংশ ব্যাঙ্কে জমা এবং পরিবর্তিত হয়। যদি নগদ কালো টাকা সত্যিই থাকত, তাহলে কোন তদন্ত বা আইনি পদক্ষেপ ছাড়াই সেটি সাদা হয়ে যাওয়ার কথা। ঠিক এইভাবেই লোকসানে চলা বা বন্ধ হয়ে যাওয়া যে কোনো সংস্থাকে নির্বাচনী বন্ড ক্রয় ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া আদতে অর্থের বেআইনি লেনদেন এবং নিয়মমাফিক দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করে। এই কারণেই নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত সকল তথ্য প্রকাশ্যে আসা উচিত যাতে ক্ষমতায় থাকা পার্টিগুলির বিশেষ করে বিজেপির বেআইনি শ্রীবৃদ্ধির শিকড়ে পৌঁছনো যায়।
উনিশ শতকে ইংরেজিতে প্রচলিত একটি কথা, ‘ক্ষমতা ডেকে আনে ভ্রষ্টাচার, আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ডেকে আনে চূড়ান্ত ভ্রষ্টাচার’, মোদীর আমলে ভারতবর্ষে অদ্ভুত ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের হাতে যেভাবে সকল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়েছে, যার ফলস্বরূপ বিমুদ্রাকরণ এবং নির্বাচনী বন্ডের মতো সিদ্ধান্ত লাগু হয়েছে, তা আদতে প্রকাশ্যে সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির পথই প্রশস্ত করে। বিভিন্ন অসংবিধানিক সিদ্ধান্ত এবং তার ভয়াবহ ফলাফলগুলিকে নিরাময় করার দায়িত্ব জনগণকে তাদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে নিতে হবে। মোদী সরকারের অসাংবিধানিক স্বৈরাচারের মুখোমুখি জনগণের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং ক্ষমতার আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। সময় বদলাচ্ছে, অত্যাচারের দিনও ঘনিয়ে এসেছে।
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ এপ্রিল ২০২৪