আমাদের দেশের অর্থনীতির হাল কেমন এখন তা একটু বোঝার জন্য এই লেখাটা বানানো। আমরা মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে পড়ি ভারত অর্থনীতির মাপে একদিন ৩ নম্বর দেশ হয়ে যাবে।
এই দাবিটার মাঝে কয়েকটা ফাঁক ফোকর আছে, সেটা বোঝা দরকার।
এর একটা মানে হতে পারে অর্থনীতিতে সামনের সারির দেশগুলো এগোচ্ছে বা একজায়গায় রয়ে গেছে, আর আমরা তাদের থেকে বেশি এগিয়ে যাচ্ছি।
আসলে তা নয়।
আমরা এগোচ্ছি না।
আমাদের আগে থাকা দেশগুলোয় সংকট চলছে, তারা মাপে পিছিয়ে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে। আমরা যেখানে থাকার সেখানেই আছি, ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে বলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা আমাদের আগের মাপের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছি না।
এ হল অঙ্কের মারপ্যাঁচ।
অন্যরা পিছিয়ে যাচ্ছে, আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, আর তাই বলা হচ্ছে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আমি আমারটা বাড়িয়ে বলছি।
আর একটা মাপের কথা বলা হচ্ছে।
আমাদের দেশে গরিবের সংখ্যা কমছে, কমবে। বেশ তাই যদি হবে তাহলে দেশের একটা বড়ো মাপের মানুষজনকে বিনা দামে খাবার, চাল, ডাল এমন সব দিতে হচ্ছে কেন? তারা নিজেদের আয়ে খাবার কিনতে পারছে না বলেই তো সরকারকে দিতে হচ্ছে। এই ধাঁচের অর্থনীতিকে বলে ‘ডোল অর্থনীতি’ বা ‘ভিক্ষে অর্থনীতি’।
কেন বিনা দামে দিতে হচ্ছে?
কারণ তারা কিনতে পারছে না বলে।
কেন তারা কিনতে পারছে না?
তারা কেনার মতো আয় করতে পারছে না বলে।
কেন তারা আয় করতে পারছে না?
আয় করার মতন অর্থনীতির অবস্থা নেই, অবস্থা বানানো যায়নি বলে। আয় করার মতন অবস্থা বানানো দরকার।
শুরু করা দরকার কৃষি থেকে।
কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের আয় কৃষি থেকে। সে গ্রামে চাষেই থাকুক, কী চাষের সাথে জড়িয়ে থাকা কাজেই থাকুক। সরকার চাষিদের জন্য কোনো নীতি বানায়নি। আমাদের দেশে কোনো ‘কৃষিনীতি’ নেই। এখানেই বেশিরভাগ মানুষের থাকা, কাজ করা, আর এখানকার জন্য কোনো সরকারি নীতি নেই।
এর ফলে আর একটা কাণ্ড হয়ে চলেছে। কৃষি ছেড়ে, চাষ ছেড়ে লোকজন চলে যাচ্ছে। যাদের এখন দেওয়া নাম ‘পরিযায়ী শ্রমিক’। ‘পরিযায়ী শ্রমিক’রা যে কাজ করে, তা আজ আছে, কাল নেই, আজ এতোটা আছে, কাল অতোটা নেই, এ মাসে এবারে এতোটা টাকা রোজগার হলো, ও বারে/ও মাসে অতোটা টাকা হবে, তার কোনো ঠিক নেই। আজ এখানে আছো, কাল বাড়ি ফিরে যাও।
গ্রামকে, গ্রামের চাষবাসকে অবহেলা করার আর একটা উদাহরণ গ্রামের ভিতর দিয়ে, গ্রামকে ভেঙ্গে, গ্রামকে নষ্ট করে ‘হাইওয়ে’ বানানো। হাইওয়ে থেকে গ্রামে নামা যায় না, গ্রাম থেকে হাইওয়েতে ওঠা যায় না। গ্রামের একটা জায়গা থেকে আর একটা জায়গায় যাওয়া যায় না। গ্রাম টুকরো হয়ে যাচ্ছে। তুলনায় গ্রামে রাস্তা তেমনটি বানানো হচ্ছে না। গ্রামের রাস্তা বানানো না হলে চাষবাসের ক্ষতি, গ্রামের অর্থনীতির ক্ষতি, গ্রামের মানুষজনের ক্ষতি।
উল্টোদিকে হাইওয়েতেই সরকারের বিরাট টাকা খরচ করা। তা বড়োলোকেদের জন্যই আর সাধারণ মানুষকে আটকানোর জন্য। আর একভাবে দেখা দরকার বিষয়টাকে। স্বাধীনতা পাবার পর থেকে কৃষিতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ, লগ্নী কমেই চলেছে।
কারণ ধরে নেওয়া হচ্ছে, আমাদের মনে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রাম, কৃষি এসব মানেই অউন্নয়ন, না-উন্নয়ন।
আর এই ‘না-উন্নয়ন’এর ভাবনাতেই আমরা ফেঁসে গেছি।
গ্রাম, চাষবাস মানে অ-উন্নয়ন, ফলে এখানে বিনিয়োগ কমিয়ে দাও।
বিনিয়োগ কমালে আয় কমবে, আয় কমলে চাহিদা কমবে। ব্যস্ এই ফাঁদে গ্রামকে, গ্রামের মানুষজনকে ফেলে দেওয়া। অবশ্যই গ্রামে বড়োলোকেরা, বড়ো চাষি, বড়ো ব্যবসাদার আছে। তাদের টাকা গ্রামে খরচ হয় না। হয় শহরে।
ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষজনের দু’বেলা ঠিকঠাক খাবার জোটে না। খাবার জোটে না বলে শরীরের দরকারি পুষ্টি নেই, পুষ্টি নেই বলে অসুখ বিসুখ, অসুখ বিসুখ হলে ওষুধ কেনার, ওষুধ পাবার উপায় নেই। যতটুকু কাজ করা তাও কমে যাওয়া, আরও গরীব হয়ে যাওয়া।
এখানেই সরকারি জোড়াতালি।
গ্রামবাসীরা নিজেরা খাবার যোগাড় করতে পারছে না, ঠিক আছে, বিনা পয়সায় খাবার দাও। ভিখারি বানিয়ে দাও।
গ্রামে স্বাভাবিক ভাবে কাজ বানানো যাচ্ছে না, ঠিক আছে, ১০০ দিনের কাজের ভিক্ষে দাও। খাবার-ভিখারি, কাজ-ভিখারি বানাও।
কাজ নিয়ে আর একটা দিক আছে। জরুরি দিক।
ভারতে ‘কাজ না-পাওয়ার’ পাশে রয়েছে দরকারের তুলনায় ‘কম কাজ পাওয়া’, কম মজুরিতে কাজ পাওয়া, আজ কাজ আছে, কাল কাজ নেই।
গ্রামের মানুষ গ্রামে ‘তেমন আয়ের কাজ’ না পেয়ে শহরে আসছে। শহরে আবার ঠিক তেমনি, শহরে ‘তেমন আয়ের কাজ’ না পেয়ে গ্রামে ফিরে আসছে। সব মিলিয়ে ‘ঠিকঠাক খেয়ে পরে থাকার কাজ’ না-থাকা।
আর একটা খারাপ দিক রয়েছে। গ্রামের লোকেরা কাজ পেতে পারতো ঠিকঠাক পড়াশোনা করতে পারলে। গ্রামে শিক্ষার দায় অবশ্যই সরকারের। আর শিক্ষাখাতে সরকারের খরচ সবসময় কম হয়েছে। এর সাথে মিলিয়ে দেখা দরকার গ্রামে সরকারের স্বাস্থ্য খাতে খরচ। এই খাতে খরচের পরিমাণ সব সময় দরকারের তুলনায় কম।
এবার, দুটো যোগ করে কি দাঁড়াচ্ছে?
খারাপ স্বাস্থ্য থাকলে খারাপ শিক্ষা পাওয়া, ঠিকঠাক লেখাপড়া করতে না পারা। খারাপ শিক্ষার জন্য যে কাজ পাওয়া তাতে রোজগার কম। রোজগার কম বলে শরীর খারাপ। শরীর খারাপ হলে কাজ না পাওয়া। একটার সাথে অন্যটা জড়িয়ে।
অন্য একটা দিক দিয়েও দেখা যায়।
মা বাবা অসুস্থ হলে সন্তান অসুস্থ হয়। সন্তান অসুস্থ হলে তার লেখাপড়া ঠিকঠাক হয় না। লেখাপড়া ঠিকঠাক হয় না বলে ঠিকঠাক কাজ পায় না। এইভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা চাকরি এক চলমান সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। দারিদ্রের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে।
ফলে ‘দারিদ্রের মাপ’ শুধুই ‘আয়’ নয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজ, খাবার, আয় সব মিলিয়েই দারিদ্রের মাপ।
আর দারিদ্রের একটা মাপ হয় না। নানা মাপ হয়। ‘হত দরিদ্র মানুষ’, ‘সরকারের কষে দেওয়া দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষজন’, ‘যে কোনো সময় দরিদ্র হয়ে যেতে পারে এমন লোকজন’।
অন্য আর একভাবেও দেখা যায়।
‘উপরে থাকা’দের সাথে ‘নিচে রেখে দেওয়া’দের তুলনার মাপে।
উপরে থাকা দেশের ১০ শতাংশ লোকের অবস্থা প্রতিদিন ভালো, আরও ভালো হয়ে চলেছে। আর নিচে রেখে দেওয়া ৫০ শতাংশ দেশবাসীর অবস্থা খারাপ, আরও খারাপ হয়ে চলেছে। এখানেও ‘একটা’ হচ্ছে বলেই ‘আর একটা’ হচ্ছে। একটার সাথে অন্যটা জড়িয়ে আছে।
ধরা যাক দেশের মোট আয় ১০০ টাকা। তলার দিকে থাকা লোকেরা যত কম আয় করবে, সেই টাকাটা উপরের দিকে থাকা লোকেদের হাতে চলে যাবে। এদের কমলে ওদের বাড়বে। আর তলার দিকে থাকা লোকেদের তো কোন অধিকার নেই। ফলে যে কোনো বিষয়ে তাদের ওপর আঘাত নামিয়ে আনা যায়। কয়েকটা উদাহরণ, নোটবন্দি, জিএসটি বসানো, কোভিডে অনেক দিন সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া। এসব তলার দিকে থাকা লোকজনকে আঘাত করেছে। আর এই তলার দিকেই রয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের লোকজন। এদের কোনো অধিকার নেই, এদের জন্য কোনো আইন নেই, সরকারি মদত নেই। আর এটা বুঝতে পেরেই আস্তে আস্তে অর্থনীতির একটা বড় অংশকে ‘অসংগঠিত’ করে তোলা হচ্ছে, ‘অ-আইনি’ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, না-অধিকারে নিয়ে ফেলা হচ্ছে। কৃষি ‘অসংগঠিত’ বিষয়, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ‘অসংগঠিত’ বিষয়, পরে কারখানা খোলা সে’ও ‘অসংগঠিত’ বিষয়, শিক্ষা ‘অসংগঠিত’ বিষয়।
সবচেয়ে বেশি ‘অসংগঠিত’ করে তোলা হচ্ছে সরকারি কাজের জায়গাকে। ফলে সেখানে যারা কাজ পাচ্ছে তাদের সংখ্যাটা কাজ-না-পাওয়াদের তালিকায় নেই, কাজ পাওয়াদের তালিকায় আছে। আর সেই তালিকার সংখ্যাটা দেখিয়ে আমাদেরকে কাজ পাওয়ার ভুল অঙ্কটা দেখানো হচ্ছে। বেকারের সংখ্যা কম দেখানো হচ্ছে। ভিতরের গল্পটা আড়াল করা হচ্ছে, আমরাও ভুল বুঝছি। যারা কাজ পেয়েছে বলা হচ্ছে, তাদের বেলায় বলা হচ্ছে না তাদের কোনো সামাজিক সুরক্ষার অধিকার নেই। আমাদের কাছে যা দেখানো হচ্ছে, আমরা তার বাইরেটা দেখে মেনে নিচ্ছি, ভেতরটা দেখছি না, ভেতরটা চেপে রাখা হচ্ছে। ফলে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকারের দাবি, তথ্য, অঙ্ক, হিসেব, কথা মেনে নিচ্ছি।
যা নয়, তাই মেনে নিচ্ছি।
এবার যাচাই করে নেওয়া শুরু করা যাক।
সবাই মিলে। যে যার জায়গার হাল নিজেদেরই বুঝে নেওয়া দরকার।
অন্যদেরকে জানানো দরকার।
- বিশ্বজিৎ ধর এবং শুভেন্দু দাশগুপ্ত