নির্বাচন কমিশনের অপমৃত্যু — গভীর সংকটে গণতন্ত্র
democracy-in-deep-crisis

গত ৩০ বছরের মধ্যে এবারে সবচেয়ে বিষাক্ত, বিভেদকামী বিদ্বেষপূর্ণ নির্বাচনী ভাষণ দিলেন নরেন্দ্র মোদী, রাজস্থানের বাঁশওয়ারায়। যিনি এই ক’দিন আগে পর্যন্ত বুক ঠুকে বলে আসছিলেন ‘আবকি বার, চারশো পার’, সেই মোদী এই প্রথম বললেন, “কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় ফিরে আসে তবে সবার ধনসম্পত্তি, মা-বোনেদের ধনসম্পত্তি বা মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়ে যারা অনুপ্রবেশকারী (পড়ুন মুসলিম) ও অনেকগুলো বাচ্চা কাচ্চা আছে, তাদের মধ্যে বিলি করে দেবে।”

২০০২ সালে সংখ্যালঘুদের নিকেশ করতে মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময় গুজরাটে যে গণহত্যা সংগঠিত হয় তখন আক্রান্ত, ঘরবাড়ি জ্বলে পুড়ে যাওয়া মুসলিমদের জন্য আলাদা আশ্রয়স্থল তৈরি করার দাবি ওঠে। তখন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে তিনি বলেছিলেন, “আমি চাই না ওই আশ্রয়স্থলগুলো সেই সম্প্রদায়ের সন্তান উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে উঠুক, যারা বিশ্বাস করে হাম দো, হামারা পঁচিশ (আমরা দুই, আমাদের পঁচিশ)”। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি এত তীব্র ঘৃণা সযত্নে লালন পালন করে চলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, যা অকল্পনীয়, অভূতপূর্ব।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে উদ্ধব ঠাকরেকে নোটিশ পাঠিয়ে জানানো হয়, তিনি যেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ‘হিন্দু’ ও ‘জয় ভবানী’ শব্দবন্ধগুলো ব্যবহার না করেন। তিনি সরাসরি ওই প্রস্তাবকে খারিজ করে জানান, এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম মোদীর হাতে নোটিশ ধরানো হোক। আরও উল্লেখ্য, মোদীর ওই ঘৃণা ভাষণের পর একাধিক সংবাদমাধ্যম এ’প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনারকে ফোন করে প্রতিক্রিয়া জানতে চায়। তারা সরাসরি জানান, এনিয়ে কোনো উত্তর দেবেন না।

ভারতবর্ষে সংখ্যালঘুদের বৃহত্তম সম্প্রদায়কে নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে দাগানো, গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘যৌন পিপাসু, গাদা গাদা সন্তান উৎপাদনকারী’ বলে চিহ্নিত করে উগ্র মুসলিম বিদ্বেষকে ইন্ধন দেওয়া — এটাই হল বিজেপি-আরএসএস’এর শতাব্দী ব্যাপী ঘৃণ্য ছক। মোদী নির্বাচনের প্রাক্কালে তা আবার উস্কে দিলেন।

মোদী-অমিত শাহ আবার এই ধর্মীয় মেরুকরণে মরিয়া হয়ে ময়দানে নামলেন কেন? প্রথম পর্বের নির্বাচনের শেষে দেখা যাচ্ছে জীবন-জীবিকা, বেকারত্ব মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি জ্বলন্ত বিষয়গুলোই ক্রমে প্রধান ইস্যু হয়ে সামনে উঠে আসছে। দেখা যাচ্ছে, প্রথম দফার নির্বাচনে গো-বলয়ে বিশেষ করে এনডিএ শাসিত বিহার-উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং পশ্চিম মহারাষ্ট্রে দলের পক্ষে ভোট কম পড়ায় নড়ে চড়ে বসেছে বিজেপি নেতৃত্ব। প্রবল দাবদাহকে উপেক্ষা করে সংঘবদ্ধভাবে মুসলিম সম্প্রদায় যেভাবে ভোট দিতে বেরিয়েছিলেন, তুলনায় সেই উৎসাহ অনুপস্থিত ছিল হিন্দু সমাজের মধ্যে। দলীয় নেতৃত্ব মনে করছে, কর্মীদের বড় অংশের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রবল অনীহা লক্ষ্য করা গেছে, যা মোদী-অমিত শাহকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। দক্ষিণে তো বটেই, উত্তর ভারতেও রামমন্দিরের আবেগের কোনো তরঙ্গ সেইভাবে চোখে পড়ছে না। বহু ঢাক পেটানো ‘মোদী গ্যারান্টি’র লম্বা ফিরিস্তি থেকে তাই সরে এসে চিরাচরিত ধর্মীয় মেরুকরণের রাস্তায় মোদী হাঁটা শুরু করলেন।

নির্বাচনী আদর্শ আচরণ বিধিকে এই ভাবে দুই পায়ে মাড়িয়ে দেওয়ার পরও জাতীয় নির্বাচন কমিশন এখনও পর্যন্ত কোনো নোটিশ মোদীকে ধরালো না। বাম দলগুলি দিল্লীর মন্দির মার্গ থানায় নালিশ দায়ের করলে তা গ্রহণ না করে পরামর্শ দেওয়া হয় দিল্লীর পুলিশ কমিশনারের কাছে তা দায়ের করতে। ওই ঘৃণা ভাষণের পরই ২২ এপ্রিল ২২,০০০ নাগরিক জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে গণনালিশ পাঠান, যা নজিরবিহীন।

কিন্তু, গলায় বকলশ লাগানো জাতীয় নির্বাচন কমিশন এখনো মোদীর বিরুদ্ধে একটা সাদামাটা কারণ দর্শনোর নোটিশ পর্যন্ত পাঠালো না। সাংবিধানিক এই সংস্থাটির এমন অপমৃত্যুই আজ মোদী শাসিত ভারতবর্ষের আসল ছবি — যেখানে অস্তাচলে পাঠানো হয়েছে সমস্ত গণতান্ত্রিক, সংবিধান স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলিকে।

এবারের জাতীয় নির্বাচন সেই গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের নির্বাচন। সংবিধান, ভারতবর্ষের বহুত্ব, সংসদকে বাঁচানোর নির্বাচন। আপামর ভারতবাসী সেই অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলেছেন।

খণ্ড-31
সংখ্যা-15