সাধারণ নির্বাচন ২০২৪’র চ্যালেঞ্জ : স্বৈরাচারী উৎপীড়ক মোদী শাসনকে উৎখাত করুন
2024-general-elections

‘মোদী ভক্তি’ ঘিরে বিরাট প্রচার ঝড় আর অভূতপূর্ব টাকার খেলা। গত ২০১৩তে ‘মোদী ফর পিএম’ প্রচার শুরু হওয়া থেকে এটাই হয়ে উঠেছে ভোট প্রচারে মোদীর একেবারে নিজস্ব ঢং, যাকে বলে, স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন। গত দশ বছরে এই দুটো বৈশিষ্ট্যই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেছে। কিন্তু এবার মোদী ৪০০+ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আগ্রাসী দাবি নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরার নিলাম হেঁকে রেখেছেন; এক্ষেত্রে অঘোষিত উদ্দশ্য হল — ভারতের সংবিধানকে গভীরতর সর্বনাশের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। দাবি তো করেছেন, কিন্তু একটা ব্যাপারে তিনি আগের যে কোনো সময়ের থেকে বেশি ভীত হয়ে পড়েছেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন, তার সরকারকে গদিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীশক্তিকে ঘিরে বিপুল জনসমাবেশ দেখে। তাই কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে হাতিয়ার করা আর বিরোধী নেতৃত্বকে নির্যাতন-নিগ্রহ করাই হয়ে উঠেছে মোদীর ২০২৪-এ তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার মরিয়া চেষ্টার বর্শামুখ!

গত ১৬ মার্চ নির্বাচন কমিশন লোকসভার ১৮তম সাধারণ নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করার সময় মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বার বার ‘লেভেল প্লেয়িং ফীল্ড’ অর্থাৎ নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু আদর্শ আচরণবিধির বিজ্ঞপ্তি ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমরা দেখতে পেলাম, ভারতের আরেক অ-বিজেপি রাজ্যসরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে ইডি দিয়ে গ্রেফতার করানো হল! ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্তের পর, দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালকেও হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘোর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ইডি আজ পর্যন্ত, মনোজ সিসোদিয়া থেকে কেজরিওয়াল — আপ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আবগারী দুর্নীতি মামলায় একটা সাক্ষ্য প্রমাণও পেশ করতে পারেনি, অথচ এখন এসবিআই’এর ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসা নির্বাচনী বন্ডের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে বিজেপি ঐ বন্ডের এক প্রত্যক্ষ ও প্রধান দানগ্রহীতা। বন্ডটি কিনেছিল হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক এক সংস্থা অরবিন্দ ফার্মা লিমিটেড, যার ডিরেক্টর অভিযুক্ত পি শরৎ চন্দ্র রেড্ডী দিল্লী লিকার পলিসি মামলায় এখন রাজসাক্ষী।

মনীশ সিসোদিয়াকে জামিন না পেয়ে এক বছরের ওপর জেলে পচতে হচ্ছে, অথচ পি শরৎ রেড্ডী এই মামলায় ২০২২ সালের নভেম্বরে গ্রেপ্তার হয়ে ২০২৩’র মে’তে জামিন পেয়ে যায়। সে গ্রেপ্তার হওয়ার মাত্র ৫ দিন পরে তার কোম্পানি বিজেপি’কে ৫ কোটি টাকা দেয়। মে মাসে জামিন পাওয়ার পর শরৎ রেড্ডী জুন মাসে রাজসাক্ষী হয়ে যায় এবং দু’’মাসের মধ্যে বিজেপি’কে আরও ২৫ কোটি টাকা চাঁদা দেয়। শরৎ রেড্ডীর বাবা পিভি রামপ্রসাদ রেড্ডী — প্রতিষ্ঠিত অরবিন্দ ফার্মা সর্বমোট ৫২ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে যার মধ্যে বিজেপি পায় ৩৪.৫ কোটি টাকা, বিআরএস ১৫ কোটি এবং টিডিপি পেয়েছে ২.৫ কোটি টাকা। কোম্পানিগুলোকে শুধু বলপ্রয়োগ করে মোটা টাকার ঘুষ দিতেই বাধ্য করা হচ্ছে না, বিরোধীপক্ষকে নিশানা করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতেও বাধ্য করা হচ্ছে।

এ’পর্যন্ত যেভাবে নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হয়েছে, তাতে মোদী সরকার স্পষ্টতই যথেষ্ট উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তিতে আছে, তাই এই ঘোটালা থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত এসবিআই’এর পেশ করা তথ্য থেকে প্রকাশ পেয়েছে যে ইলেক্টোরাল বন্ড টাকার বেআইনি পাচারের এক লাগামহীন বেপরোয়া ব্যবস্থা যা কোনো আইনের তোয়াক্কা করে না এবং যা দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেছে। সাংবাদিকরা দাতা কোম্পানিগুলোকে ট্র্যাক করে নির্মাণ, ওষুধ উৎপাদন, খনি ইত্যাদি ক্ষেত্রে একই রকম সুপরিচিত বেশ কিছু কর্পোরেট সংস্থা, কিছু ছায়াবৃত সংস্থা, কিছু আবার সদ্য তৈরি হওয়া সংস্থাকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন যেগুলি বিপুল পরিমাণে বন্ড কিনেছে। বন্ডের মূল্য অনেক ক্ষেত্রে তাদের অর্জিত মুনাফার বহুগুণ বেশি, আবার লোকসানে ডুবে থাকা কোম্পানিও আছে।

নিঃসন্দেহে এই প্রকল্পটি বন্ডগুলির ‘অসদুপায়ে অর্জিত টাকার বেআইনি পাচারের রাস্তা’ হয়ে ওঠার আরবিআই’এর সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাটিকে সত্য বলে প্রমাণ করেছে; সত্য প্রমাণ করেছে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার অপলাপ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক সতর্কীকরণকে; সত্য প্রমাণ করেছে, বন্ডগুলোর দাতা কোম্পানিগুলোর ‘এটার বদলে ওটা’ পদ্ধতিতে শাস্তি থেকে অব্যাহতি ‘কেনার’, চুক্তি এমনকি অনুকূল পলিসি-পরিবর্তনকে নিশ্চিত করার ব্যবস্থা হয়ে ওঠা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণকেও! সমস্ত ইঙ্গিত থেকে এটা স্পষ্ট, নির্বাচনী বন্ড স্কিম স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্র-পোষিত ও বৈধতাপ্রাপ্ত আর্থিক ও রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের সবচেয়ে বেপরোয়া বেশরম এক ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। এসবিআই বন্ড সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রকাশকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বা কালহরণের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের সামনে বার বার মিথ্যে বলেছে এবং সমস্ত রকম বাজে ওজর দেখিয়ে গেছে। এই ঘটনা নির্বাচনী বন্ড স্কিমের কলূষ উদ্দেশ্যকেই আরও নিশ্চিত করেছে।

প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচার নিয়ে সমস্ত তথ্য ও আলোচনা বেমালুম চেপে গেছে — যেন এমন কিছুই ঘটেনি! একমাত্র বিকল্প সংবাদমাধ্যমগুলোর মাধ্যমেই মানুষ এই কেলেঙ্কারির সম্পর্কে জানতে পেরেছে, যা উদ্ঘাটন করেছেন অনুসন্ধানকারী সাংবাদিক, সত্যান্বেষী গবেষক এবং স্বচ্ছতার প্রচারকদের একটি একনিষ্ঠ নিবেদিতপ্রাণ টিম। সরকার তাই বিকল্প মিডিয়ার শ্বাসরোধ করতে উদ্যত — দম্ভভরে নিজেকে ‘তথ্য যাচাই’ কর্তৃত্ব হিসেবে জাহির করে এবং যে কোন সমালোচনামূলক তথ্যকে ‘মিথ্যা’, ‘জাল’ তকমা দিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সেইসব তথ্য প্রচার বন্ধ করে। এই দানবীয় চেষ্টায় স্থগিতাদেশ দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সমাজমাধ্যম সাময়িকভাবে অন্তত কাজ করে যেতে পারছে। কিন্তু বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অল্টারনেটিভ মিডিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে।

তৃতীয়বারের মোদী শাসনের অর্থ — আরও বেপরোয়া বেশরম দুর্নীতি, আরও অবাধ কর্পোরেট লুঠ, সংবিধানের ঘোরতর বিপর্যয় এবং গণতন্ত্রের আরও ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করা। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রের অন্য সব বৈশিষ্ট্য — ধর্মনিরপেক্ষতার বুনোট, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষয়কেও ত্বরান্বিত করা, বাড়তি উৎসাহ যোগানো। কুড়ি বছর আগে, ভারত অটল-আদবানি যুগের এনডিএ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। সময়টা ছিল গুজরাটের সাম্প্রদায়িক গণহত্যার পর, যখন কৃষিতে ঘনিয়ে উঠছিল গভীর সংকট আর প্রতিদিন অসংখ্য কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছিলেন। ২০২৪-এ ভারতকে আবার উঠে দাঁড়াতে হবে, মোদী-শাহ রাজকে উপড়ে ফেলতে — যে জমানা লাফিয়ে বেড়ে চলা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় আর স্বৈরাচারী শাসনে জর্জরিত! 

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ এপ্রিল ২০২৪

খণ্ড-31
সংখ্যা-12