ইজরায়েলি ও ভারত সরকারের বোঝাপড়ায় ইজরায়েলের নির্মাণ ক্ষেত্রে বেশ কয়েক হাজার ভারতীয় শ্রমিকের কাজ করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার ৬৪ জনের প্রথম ব্যাচটি ইজরায়েলে পৌঁছেছে এপ্রিলের গোড়ায়। এপ্রিল মাসের মধ্যেই ১,৫০০ ভারতীয় শ্রমিক ইজরায়েলে নির্মাণ কাজে যোগ দেবে বলে খবর। এই শ্রমিকদের এমন সময় ইজরায়েলে পাঠানো হলো যখন ছ’মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজার ওপর নিরন্তর আক্রমণে ইজরায়েল গাজাকে আক্ষরিক অর্থেই পরিণত করেছে ধ্বংসস্তূপে; হাজার হাজার নারী ও শিশু সহ ৩৩,০০০’রও বেশি প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করেছে; গাজাকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যাওয়া ট্রাককে ঢুকতে না দিয়ে ২০ লক্ষ গাজাবাসীকে ফেলা হয়েছে অনাহারের মুখে এবং সেখানে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা আর অবাস্তব নয়; ত্রাণ সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের ওপর অন্তত তিনবার হামলা চালিয়ে তাদের দশ ত্রাণকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং ঐ সংস্থা তাদের ত্রাণকাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে; আর ইজরায়েলে যে ৯০,০০০ প্যালেস্তিনীয় শ্রমিক নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করত তাদের কাজ থেকে উচ্ছেদ করে হামাসের ইজরায়েল বিরোধী সামরিক আক্রমণের বদলা নিয়েছে ইজরায়েল। অতএব, ইজরায়েলের নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য ভারতীয় শ্রমিকরা এমন পরিস্থিতির মধ্যে ইজরায়েল পৌঁছলেন যখন ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের ওপর মানবতা বিরোধী নির্মমতাকে উজাড় করে দিচ্ছে এবং প্যালেস্তিনীয় শ্রমিকদের রুটি-রুজির সংস্থানও হরণ করছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো ইজরায়েল গিয়ে ভারতীয় শ্রমিকদের কাজ করার উদ্যোগটির বিরোধিতা করে বলেছিল, এখন ইজরায়েলে ভারতীয় শ্রমিক পাঠালে তা হবে অনৈতিক, শ্রমিক সংহতির প্রতি প্রতারণা এবং ইজরায়েলি নির্মমতায় মদত দান। কিন্তু সেই অভিমতে কোনো গুরুত্ব মোদী সরকার দেয়নি। উল্টে এখন বলা হচ্ছে যে, ২০২৩’র মে মাসে ইজরায়েলি বিদেশমন্ত্রী এলি কোহেনের ভারত সফরের সময় সে বছরের ৯ মে ৪২,০০০ শ্রমিক পাঠানোর যে চুক্তি হয়েছিল (৩৪,০০০ নির্মাণ ক্ষেত্রে এবং ৮,০০০ রোগী পরিচর্যা বা নার্সিং ক্ষেত্রে) তারই অনুসরণে এই শ্রমিকদের ইজরায়েলে পাঠানো হয়েছে। এরসঙ্গে হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এগুলোও তো বাস্তব ঘটনা যে, ২০২৩’র অক্টোবরে ইজরায়েলের ওপর হামাসের সামরিক হানাদারির পরিপ্রেক্ষিতেই শুরু হয়েছিল ইজরায়েলি নির্মাণ ক্ষেত্রে কর্মরত ৯০,০০০ প্যালেস্তিনীয় শ্রমিকদের কর্মচ্যুত করার প্রক্রিয়া, কেননা, তখনই ইজরায়েলের নির্মাণ সংস্থাগুলো নেতানিয়াহু সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল যে নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য ভারত থেকে এক লক্ষ শ্রমিক আনা হোক। ভারতের অর্থমন্ত্রক স্থাপিত পিপিপি মডেলের সংস্থা ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএসডিসি) ২০২৩’র ১৫ নভেম্বর ইজরায়েলি সংস্থা পপুলেশন এন্ড ইমিগ্রেশন অথোরিটির কাছ থেকে সত্বর ১০,০০০ শ্রমিক পাঠাবার অনুরোধ পেয়েছিল। ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুও ঐ বছরের ডিসেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করে শ্রমিকদের ‘আগমনকে এগিয়ে আনার’ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এর পরই ইজরায়েলে পাঠাবার জন্য শ্রমিক বাছার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এ’বছরের ১৬ জানুয়ারি ইজরায়েলে পাঠাবার জন্য হরিয়ানায় ৯,৭২৭ জন শ্রমিককে বাছাই করে এনএসডিসি। অতএব, হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধ, প্যালেস্তিনীয় শ্রমিকদের কাজের লাইসেন্স বাতিল করা, ভারতীয় শ্রমিক পাঠানোর জন্য ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষের আর্জি, শ্রমিক প্রেরণ ত্বরান্বিত করার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর ফোন — এসবের সঙ্গে শ্রমিক পাঠানোর কোনো যোগ নেই বললে তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে?
তবে, শুধুমাত্র ইজরায়েলের নির্মাণ শিল্পের পরিত্রাতা হওয়াই নয়, প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলি হামলার অবসানে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাবেও সমর্থন জানাতে ভারত কুণ্ঠিত হয়েছে। গত ৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদ তাদের পেশ করা প্রস্তাবে বলে, ইজরায়েলকে অবিলম্বে গাজা বিরোধী হানাদারি বন্ধ করতে হবে; খাদ্যদ্রব্য প্রবেশের জন্য ইজরায়েলকে অবরোধ তুলে নিতে হবে; ইজরায়েলকে সর্বপ্রকারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি ও সরবরাহ সমস্ত রাষ্ট্রকে স্থগিত করতে হবে; পূর্ব জেরুজালেম সহ সমগ্ৰ প্যালেস্তাইনে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দায় নির্ধারণ করতে হবে। এই প্রস্তাবেও ভারত সমর্থন প্রদান করতে পারেনি। চিন, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ ২৮টা দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় ৬টা দেশ — আমেরিকা, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, বুলগেরিয়া, মালাওই ও প্যারাগুয়ে। আর ভারত, জাপান, ফ্রান্স, রোমানিয়া সহ ১৩টা দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ইজরায়েল গাজার ওপর শুধু বর্তমানের ধ্বংসলীলাতেই মেতে উঠেছে এমন নয়, ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর থেকেই প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ডের ওপর দখলদারি ও তাদের ওপর জুলুমবাজি চালিয়ে আসছে। প্যালেস্তিনীয়দের ধারাবাহিক উৎপীড়ন, তাদের ওপর হুমকিবাজি, তাদের দমিয়ে ও কোণঠাসা করে রাখার অবসান চাইলে, তাদের অবমাননা, অমর্যাদা, সম্ভ্রমহানির ন্যায়বিচার চাইলে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদের এই প্রস্তাবে অনুমোদন প্রদানে আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীরা তাদের মতাদর্শগত মিত্রর দানবীয় প্রতাপের কোনো ধরনের লাঘবকেই মেনে নিতে রাজি নয় এবং তারা যে ইজরায়েলি নৃশংসতার দোসর তা প্রকাশেও দ্বিধান্বিত নয়।
প্যালেস্তাইনের জনগণ, সেখানকার শ্রমিকদের প্রতি ভারতীয় জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে? নরেন্দ্র মোদী সরকার যেমন দেশের পরিস্থিতি থেকে, এখানকার কর্মসংস্থানের অভাবের চরম সংকটজনক অবস্থা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে ইজরায়েলে ভালো বেতনের কাজের দিকে শ্রমিকদের প্রলোভিত করতে চাইছেন, ভারতীয় শ্রমিকরাও কি তাঁদের বোধকে তার মধ্যেই আচ্ছন্ন করতে চাইবেন? অথবা, মোদী সরকার যেমন ইজরায়েলের ওপর হামাসের সামরিক হামলাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বলে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবে সেই কাজের সমালোচনা না থাকাকে অছিলা করে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় বা ভোটদানে বিরত থাকে, ভারতীয় জনগণও কি সেই ধারাতেই ভারতীয় বিদেশ নীতিকে দেখতে চাইবেন? দেশে কাজের সুযোগ না থাকায় বেকারির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ কিছু শ্রমিক ইজরায়েলে ছুটে যেতে চাইছেন ঠিকই, তবে সেটাই কিন্তু ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। একইভাবে ভারতীয় জনগণও কি ঔপনিবেশিক অতীত থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে, স্বাধীনতা সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য একটা ধারাকে বিস্মৃত হয়ে প্যালেস্তিনীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে? ইজরায়েল যদি প্যালেস্তাইনের জমি নিজেদের দখলে রাখে, যদি তাদের ওপর লাগাতার দমন চালিয়ে যায় তবে প্রতিরোধের অধিকার, এমনকি সশস্ত্র ধারাতেও প্যালেস্তিনীয়দের থাকবে এবং সে কথা রাষ্ট্রপুঞ্জও স্বীকার করে। ইজরায়েলে কাজে যোগ দিতে চাওয়া শ্রমিকদের ২ এপ্রিলের বিদায় সম্বর্ধনায় ইজরায়েলের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নাওর গিলন বলেন, “আমি নিশ্চিত, এই শ্রমিকরা ভারত ও ইজরায়েলের জনগণের মধ্যে মহান সম্পর্কের ‘রাষ্ট্রদূত’ হয়ে উঠবেন।” এই প্রসঙ্গে আমরা কুণ্ঠাহীনভাবে বলতে চাই, পেটের দায়ে কিছু শ্রমিক ইজরায়েল রওনা দিলেও সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েল এবং ফ্যাসিবাদী ভারত সরকারের এই যৌথ প্রযোজনার অংশীদার ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণী কখনই হবেন না। স্বাধীনতার পর থেকে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্যালেস্তাইনের মুক্তির সহচর থাকলেও ১৯৯২ সাল থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরিণামে ভারত তাদের এবং তার সাথে মার্কিন রণনীতির সহযোগী হয়ে উঠেছে। ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণী কিন্তু প্যালেস্তিনীয় জনগণের মর্মযন্ত্রণার সমব্যথী, তাদের মুক্তি সংগ্রামের সহযাত্রী। ভারত সরকারের কাছে ভারতীয় জনগণের তাই দাবি,
ইজরায়েলে শ্রমিক রপ্তানি বন্ধ কর!
ইজরায়েলি রাষ্ট্রের সামরিক হামলাকে ধিক্কার জানিয়ে প্যালেস্তাইনের মুক্তি সংগ্রামের পাশে দাঁড়াও!