জন্মবার্ষিকীতে ফুলে ও আম্বেদকর স্মরণে
ambedkar-on-birth-anniversary

১১ এপ্রিল ও ১৪ এপ্রিল যথাক্রমে ফুলে ও আম্বেদকর জন্ম জয়ন্তী। ভারতে সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জ্যোতিরাও ফুলে ও বাবাসাহেব আম্বেদকর সর্বাগ্রগণ্য দু’টি নাম। এ’বছর আমরা ফুলের (১১ এপ্রিল ১৮২৭ - ২৮ নভেম্বর ১৮৯০) ১৯৭তম ও ডক্টর আম্বেদকরের (১৪ এপ্রিল ১৮৯১ - ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬) ১৩৩তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপন করছি। বর্তমান সময়ে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তির ওপর যে ধরনের আক্রমণ ও সামন্তী পিতৃতান্ত্রিক পশ্চাদপদতার নাগপাশ যেভাবে নতুন করে গ্রাস করছে আধুনিক ভারতকে সেখানে দাঁড়িয়ে ফুলে ও আম্বেদকরের বার্তা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণাদায়ী হয়ে উঠেছে।

দুনিয়া জুড়ে প্রগতিশীল মানুষ ১৯৪৮ সালকে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশের বছর হিসেবে জানে। ঐ একই বছরে তরুণ জ্যোতিরাওও (জনপ্রিয় পরিসরে জ্যোতিবা নামে পরিচিত) ফুলে মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর ১৭ বছর বয়স্কা স্ত্রী সাবিত্রী ফুলের সাথে মিলে ভারতে মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন পুণে শহরের ভিদেওয়াড়াতে। সেই বছরই ফুলেরা আমেরিকান দার্শনিক টমাস পাইনের ‘রাইটস অব ম্যান’ বইটি পড়েন। এই বইটি ফরাসি বিপ্লবের সমর্থনে লেখা। নিপীড়িত জাত ও নারীদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারে ফুলেদের উদ্যোগ মনুস্মৃতি অনুসরণকারী সংরক্ষণশীল উচ্চবর্ণ অভিজাতদের হিংসার উদ্রেক করে এবং ফুলেরা এমনকি তাঁদের নিকটজনদের দ্বারাও একঘরে হয়ে যান। ফুলেরা তাঁদের নারীশিক্ষা অভিযান চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন তাঁদের দুই মুসলমান বন্ধু ফাতিমা শেখ ও আঁর দাদা উসমান শেখের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী পৃষ্ঠপোষকতায়।

এখান থেকেই শুরু হয় বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সামাজিক ন্যায় ও নারীশিক্ষার এক মহতী অধ্যায়। নারীশিক্ষা হয়ে ওঠে নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার, বিধবা বিবাহের পক্ষে ও নবজাতক হত্যার বিরুদ্ধে ওঠে জোরালো আওয়াজ। আজকের দিনের নারীবিদ্বেষী শক্তিদের দ্বারা ভণ্ড ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ জুমলার তীব্র বৈপরিত্বে ফুলেদের উদ্যোগ ছিল নারীশিক্ষা ও সমতার লক্ষ্যে এক আদি ও অকৃত্রিম অভিযান যা প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তী ব্যবস্থাপনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৮৭৩ সালে জ্যোতিরাও ফুলে তাঁর প্রজনক গ্রন্থ ‘গুলামগিরি’ রচনা করেন ভারতের নিজস্ব সামাজিক দাসত্ব ব্যবস্থা জাত প্রথার বিরুদ্ধে এবং গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন আমেরিকার সেইসব মানুষদের প্রতি যারা সেখানকার বর্ণবাদী দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়ছেন।

জ্যোতিরাও ফুলে ১৮৯০ সালে প্রয়াত হন। ওই সময়েই আম্বেদকরের জন্ম। ১৯২০’র দশকে এসে সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের মহান প্রবক্তা তথা নতুন নেতৃত্ব হয়ে ওঠেন আম্বেদকর। তিনি তখন ইংল্যাণ্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতি ও আইনের ডিগ্রি নিয়ে ভারতে ফিরেছেন। আম্বেদকর ফুলেকে তাঁর তিনজন মহান শিক্ষকদের একজন হিসেবে গণ্য করেন, অন্য দু’জন হলেন বুদ্ধ ও কবীর। ১৯২৭ সাল ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ বছর। আম্বেদকর সে বছর মার্চ মাসে মাহাড় সত্যাগ্রহ সংগঠিত করেন সবরকম বৈষম্য ভেঙ্গে পানীয় জলকে সর্বসাধারণের অধিকার হিসেবে তুলে ধরতে, এবং ডিসেম্বর ১৯২৭-এ মনুস্মৃতিকে দাসত্বের সংহিতা বলে অভিহিত করে তা পোড়ানোর কর্মসূচি সংগঠিত করেন। ১৯৩৬-এ আম্বেদকর তাঁর রণধ্বনি ‘জাতের বিনাশ’ ঘোষণা করেন। সেই বছরই তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন জাতব্যবস্থা ও পুঁজিবাদ — এই জমজ শত্রুকে নিশানায় রেখে।

পরবর্তী দুটি দশকে, ঔপনিবেশিক ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জনের দিকে এগোচ্ছিল, আম্বেদকর বৃহত্তর ভূমিকা নেন একসারি বৈপ্লবিক চিন্তা ও উদ্যোগকে রূপ দিয়ে এবং আম্বেদকরের সভাপতিত্বে সংবিধানসভা স্বাধীন ভারতের সংবিধান গ্রহণ করে যে সংবিধানের খসড়া লিখেছিলেন আম্বেদকর। সংবিধান গ্রহণেই আম্বেদকরের পথচলা শেষ হয়ে যায়নি। নবলব্ধ সংবিধানের ভিত্তিতে সুবিচার ও সামাজিক সমতার লড়াই চলতে থাকে। হিন্দু ব্যক্তিগত আইনের আধুনিকীকরণের মাধম্যে হিন্দু মহিলাদের জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘হিন্দু কোড বিল’ আনা ছিল তাঁর বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের আগের শেষ বড় লড়াই। সংবিধানে নিজের ধর্ম নিজে বেছে নেওয়ার যে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে তা প্রয়োগ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।

আজ ভারত তার ইতিহাসের সর্বাধিক নির্ধারক নির্বাচনী সংগ্রামের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র বিপন্ন। এখন আমাদের ফুলে ও আম্বেদকরের অনুপ্রেরণা ও বৈপ্লবিক ধারার প্রতিটি শক্তিবিন্দুকে একত্রিত করতে হবে। আমাদের অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে বাবাসাহেব আম্বেদকর আমাদের সংবিধান ও সংরক্ষণ দিয়েছেন এমনটাই শুধু নয়, তিনি আমাদের সতর্ক করে গেছেন রাজনীতিতে ভক্তি প্রয়োগের মারাত্মক ফলাফল সম্পর্কে, যাকে তিনি বর্ণনা করেছেন স্বৈরতন্ত্রের নিশ্চিত রাস্তা হিসেবে। এবং তিনি বিশেষভাবে সতর্ক করে গেছেন সেই চরম বিপর্যয় সম্পর্কে যা আমাদের গ্রাস করবে যদি হিন্দুরাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয়। ফুলে ও আম্বেদকরের জন্মবার্ষিকী পালনের সাথে সাথে আসুন আমরা আম্বেদকরের এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বাণীগুলিও স্মরণ করি এবং আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে ভারতের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষা করি।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৯ এপ্রিল ২০২৪

খণ্ড-31
সংখ্যা-14